ঋতুপর্ণের সঙ্গে প্রথম প্রেম

1079

সাবেরা তাবাসসুম।।

ঋতুপর্ব এক
“৯ নম্বর গলফ ক্লাব রোড…আমার শ্বশুর বাড়ির এ্যড্রেস… আমার নতুন ঠিকানা… ১২/১৪ ফুটের একটা সিকিউরিটি” – কী বুঝেছিলাম কে জানে। পরীক্ষার খাতায় উত্তর দিয়েছিলাম কিনা তাও মনে নেই। শুধু জানি প্রথম পরিচয় ২০০০ সালে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের জেন্ডার কোর্সের তৎকালীন শিক্ষক রেহনুমা আহমেদ জানালেন কোর্সের টেক্সট হিসেবে আমরা দুটো ছবি পাঠ করতে যাচ্ছি- বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘লাল দরজা’ আর ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘দহন’। লালমাটিয়ায় চারতলার বসার ঘরটাতে কোনো এক দুপুরে আমরা শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জমিয়ে পড়তে বসে যাই। জীবনে ঐ প্রথম সিনেমাকে পড়া। ঋতুপর্ণের সাথে আমার প্রথম দেখা।

দহন ছবিতে ৯ নম্বর গলফ ক্লাব রোডের বাসার সামনে যে কদম গাছটা দেখিয়েছিল যার তলায় বসে একদিন একটা কুকুর ভিজছিল ওর পাশে কি আমিও দাঁড়িয়ে ছিলাম? ওল্ডহোমে ঠাম্মি তো আমাকেই বলছিল, না – “ঠিক তোর মনের মতো কাউকে দেখেছিস দিদি? তুই কাউকে দেখেছিস যে ঠিক তোর মনের মতোন? তোর বাবা, মা, ছোটন, আমি – ঠিক তোর মনের মতোন? তুই নিজে কি ঠিক তোর মনের মতোন, দিদি?” খুব চেনা খুব কাছের মানুষগুলো আর একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনা যেগুলোকে মনে হয় স্বাভাবিক- যেগুলো আমাদের মাথায় বুকে আঘাত করে যেতে থাকে- সত্যিই কি স্বাভাবিক? আসলে স্বাভাবিক ব্যাপারটা কী? আমাদের মধ্যশ্রেণির সাহস-ভীরুতার সীমাগুলোর ওপারে কী থাকে? থাকে কাঙ্খিত সত্য-চেষ্টিত সত্য। যেমন করে সত্যকে নির্মাণ করলে আমাদের সুবিধা হয়, শোষণটা লাভজনকভাবে বজায় থাকে, তেমন করেই আমরা সত্যকে পেতে চাই। তত্ত্বের খাতা উড়ে গেল। আমার চোখের সামনে পর্দা ওঠালো ঋতু। দহনের পর ঋতুর সাথে একটু একটু আলাপ বাড়লো। তারপর ঊনিশে এপ্রিল- তারপর বাড়িওয়ালী- উৎসব- শুভ মহরৎ- অন্তরমহল- চোখের বালি- বাড়ছে একটু ভাব-ভালোবাসা। তারপর আবার দূরে কোথাও যেন ছিটকে পড়ি।

শ্রেণিবিভাজিত সমাজে আধিপত্যের সমাজে আমার হিক্কাতোলা বুদ্ধিমত্তা চাপা খেয়ে থাকে। যে যার মত ঘা খেতে থাকি, তত্ত্ব ভুলতে থাকি, ভুলের চর্চা করতে থাকি। তারপর কোত্থেকে ভুলোমনা মেঘগুলো আমাদের ডেকে নিয়ে এলো। পরীক্ষার খাতা থেকে ততদিনে ঋতু চলে এসেছে মনে মননে। পর্দা থেকে সোজা বুকের ভেতরে। ঋতুকে দেখে বিশ্বাস করি মানুষ ভালো- মানুষ মন্দ – মানুষ স্বাধীন। এই স্বাধীন মানুষটাকে দেখে পড়তে ইচ্ছে করে লিখতে ইচ্ছে করে গাইতে ইচ্ছে করে- খামোখাই নিজের মত থাকতে ইচ্ছে করে। আমার ইচ্ছে কি তোমার নাগাল পেলো ঋতু? তার আগে ঘুম চোখে করে তুমি কোথায় চলে গেলে?

ঋতুপর্ব অসমাপ্ত
প্রথম জানলাম এর নাম আত্মপরিচয়গত সংকট। সালটা ২০০১ই হবে। চোখের সামনে দুলে দুলে যাচ্ছে সমস্ত ভারী ভারী পর্দা – শ্রেণি, দ্বন্দ্ব, ব্যক্তি পর্যায়ের ভাবনা বনাম অনুশীলন, অধঃস্তনতা, সমতা, বিয়ে, পরিবার, ফিজিক্যাল স্পেস, বিমূর্ততা, পুরুষত্ব, নির্মাণ আর সবকিছুর মূলে ক্ষমতা ক্ষমতা ক্ষমতা। হেলে দুলে হেসে খেলে বেশ মিহিন চকচকে জীবনের একুশটা কি বাইশটা বছর পেরিয়ে এবং জীবনের চড়াই-উৎরাই সম্পর্কে প্রায় কিছুই না জেনে মানুষ কদ্দূর এগুতে পারে? কাজেই ফেল মারতে শুরু করলাম। প্রশ্নে এবং উত্তরে। তত্ত্ব থেকে দূরে প্রেমের পেছনে হোঁচট খেতে খেতে ছুটে চলা আর অনুশীলনীতে বিবাহজনিত আঘাতের মহড়ায় অংশ নেয়া সবই চলছে তখন সমান তালে। তবু দিন শেষে সেই জবুথবু দশা। নিজের কাছে ফিরতে ইচ্ছে করে। এই ‘নিজ’টা কী জিনিস? ঋতু যে এক ধাক্কায় সব নাড়িয়ে দিয়েছিল ব্যাপারটা এমন না। সহজে কিছু তৈরি হয় না সহজে কিছু নড়েও যায় না। তবে ও একটা পোকা ঢুকিয়ে দিল। আর পোকাটা যে ঢুকে যাচ্ছে সেটা দেখা গেল খুব পষ্ট করে। ও পোকা, তুই কী কাটিস? ক্লাসনোটের পাতা? মাথার ভেতর জাল ফেলে বসে থাকা মাকড়সাটার বিদ্রুপ? আমার ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ? আমাদের ছানি পড়া চোখ?

চৈতন্য- পুনরুদ্ধার- বিপ্লব! আমরা পড়েছিলাম ক্যাথরিন হল – দ্য হিস্ট্রি অফ হাউজ ওয়াইফ। গৃহিণীর ইতিহাস। দেখলাম দহন। খানিকটা ঋতুকে। নতুন করে বুঝতে শিখলাম মুক্তির পথ খোঁজার চেয়ে শত্রু/প্রতিপক্ষকে বোঝা জরুরি। পড়ছিলাম জোন কেলি। তিনি প্রশ্ন করছেন- ঐতিহাসিক কালবিভাগ, সামাজিক বিশ্লেষণ পর্ব এবং সামাজিক পরিবর্তনের তত্ত্ব নিয়ে। শিক্ষকের বয়ানে টের পাই নারীর সত্তা একটা সামাজিক প্রশ্ন। আর সমাজ আমার মাথায় কাঁঠাল ভাঙার প্রস্তুতি নিতে থাকে প্রতিনিয়ত। এদিকে রোজ রিকশার ছই তুলে ছেলেটা আমাকে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে। দিন দিন ভেবেই চলেছি – আমি সুন্দর! মনে আকাঙ্খা দানা বাঁধছে ফাঁদে পা দেবার। নতুন নতুন তত্ত্ব নতুন অনুশীলনের ভারে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়া অবস্থা আর পেটে ককটেল ঢেলে দাঁতে লেবু চেপে পার করে দেয়া কাঁচা-মিঠা জীবন- যেন এটাই শ্রেষ্ঠ সময় ঋতুর সাথে প্রথম দেখার- একটু আভাস- অনেকখানি আলাপ।

CHOKHER-BALতত্ত্বের চাপে সিগারেটের ধোঁয়ায় ঐসব আলোঅন্ধকার সিনেমা, চাকভুম নাচগান আর শাহরূখ-কাজলের প্রেম শেখা-এর বাইরে দর্শকের সাথে চোখে চোখ রেখে সাধারণ কথা বলা আর এইসব আপাত সাধারণ-স্বাভাবিক কথার আড়ালে চিন্তা আর চিত্তের অবস্থান পষ্ট করে চেনানোর মত আর কাউকে পাই নি- ঋতুছাড়া। পষ্ট করে বললে ঋতু সৎ, সাহসী। কারণ ঋতু মানুষ চেনায়। যা আমরা সভ্যতার নামে প্রথার নামে প্রচ্ছন্ন রাখি ঋতু তার প্রকাশ ঘটায়। আর ঋতুর প্রকাশ সুন্দর। মধ্যশ্রেণির দর্শকেরা সুন্দরকে নতুন করে চিনলো। বেখাপ্পা শোনাতে পারে, তারপরও ঠিক এইখানটায় চলচ্চিত্র সমালোচনায় যিনি প্রণম্য সেই চিদানন্দ দাশগুপ্তের একটা কথা তুলে দিতে খুব ইচ্ছে করছে- “সমস্ত বাধাবিঘ্ন সত্ত্বেও সৎ চলচ্চিত্র যে কেবল টিকে আছে তা নয়, চলচ্চিত্রে শিল্পীর কণ্ঠস্বর এখনো এই বিরাট বাজারে সমাবেশের মধ্যে যথেষ্ট শুনতে পাওয়া যায়, এটাই আশ্চর্যের বিষয়। এবং সৎ চলচ্চিত্রেই এই মাধ্যমের প্রকৃত ইতিহাস ও পরিচয়; কেননা উদ্ভাবনী শক্তির উৎস এখানেই, এবং শিল্পীজনের উদ্ভাবন থেকে ধার নিয়েই চলচ্চিত্রের ব্যবসায়ী-সত্তা বেঁচে থাকে।”

ঋতুর সিনেমা সৎ-সিনেমা- একজন শিল্পীর সিনেমা একজন মানুষের সিনেমা- নারী বা পুরুষের বা তৃতীয় লিঙ্গের কারো সিনেমা নয়। ঋতুর সিনেমা ব্যবসা করে ঋতুর সিনেমা আমাদের প্রশ্ন করতে শেখায় আমাদের মানবিক হতে শেখায়। এই পনের বছরে ঋতুর হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছি শ্রেণিবদ্ধঅন্দরমহলে- ঘুরছি ঠাকুর বাড়ি ঠিক সেই দরোজা দিয়ে যাও ছাড়া আর কারোর চোখেই পড়েনি। বিরাট সংসারগুলোর সংকটে উদযাপনে রৈ রৈ মেতে উঠছি। গলি ঘুপচি পার হয়ে ঢুকছি আমাদের অন্তরমহলে। আবার সেই দোলার মধ্যে খানিকটা দুলিয়ে দিল-বাস্তব আর কল্পনা- কে তবে কার? এই ‘ভাগ করো আর ভোগ করো’র সময়ে ব্যক্তির চাওয়া-পাওয়া আর সমাজের দাবি-শাসন- কী করে মিলবে মনের মতন কারুর দেখা? কেউ কি নিজেও নিজের মনের মতন হল দেখতে? মনটাও কি আমাদের মনের মতো? দহন সিনেমায় দেখা ঠাম্মির বড় প্রয়োজন আমাদের জন্যে। এই আত্মপরিচয়গত সংকটে!

বেশ চলছিল আমার বেড়ানো। এই পথটুকু যেতে যেতে হঠাৎ ঋতুকে থামতে হল। থেমে যাওয়ার আগে বলতে হল “…কোনটা পার্মানেন্ট মা, এই যে আমাদের শরীর, এটা পার্মানেন্ট?” খুব জরুরি ছিল এসব বলা, ঋতু? নাকি টের পাচ্ছিলে সব- ভেতরে ভেতরে? ভাবছি, আমার বেড়ানো কি বন্ধ হল তাতে? মনে হয়, না। আমি চলচ্চিত্রের মানুষ নই, শিল্পীও না। আমার পেশা আমি গৃহিণী। কবিতার প্রতি ভালোবাসা আছে। আছে বস্তাপচা ছবি থেকে শুরু করে ঋতুর সিনেমা পাঠ করার রোগ। শরীরটা না ছুঁতে পারি, নতুন কথাগুলো না শুনতে পারি আর, তবু ঘোষ এন্ড কোম্পানির সাক্ষাৎকারগুলোয়, ঋতুর কবিতায় কিংবা চিত্রাঙ্গদার ইচ্ছের গল্পে আমি ঋতুর কাছ থেকে মানুষ হয়ে ওঠার মন্ত্র শিখতে চাই। আমার ছেলেকে শোনাতে চাই। বলতে চাই “যার যেটা স্বভাব সেটাই তো স্বাভাবিক, না? স্বভাবেরও তো একটা ইচ্ছে আছে।” ইচ্ছে। জানি কোনো রূপান্তরই সহজ নয়। তবু ঋতুর এ যাওয়া আমার কাছে রূপান্তর। হাহাকারে নয়, চলে যাওয়াতে নয়, উদযাপনে ঋতুপর্ণের ফিরে আসাকে আমি রাখলাম।