ওয়াসার প্রকল্পে শেষ নেই, কেবল সঙ্কট বিশুদ্ধ পানির

1326

ওমর ফারুক।।

রাজধানীতে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য ১৯৬৩ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড স্যুয়ারেজ অথরিটি বা ঢাকা ওয়াসা। এরপর থেকে সত্তর দশক পর্যন্ত তেমন অভিযোগ না থাকলেও আশির দশকের শুরুতে পানি সমস্যা প্রকট হয়ে উঠে নগরীতে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ওয়াসা একের পর এক প্রকল্প গ্রহণ করতে থাকে। কিন্তু বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ আর নিশ্চিত করতে পারেনি।

জানা গেছে, বর্তমানে ঢাকা মহানগরী ও নারায়ণগঞ্জে ওয়াসার কমপক্ষে ছয়টি প্রকল্প চলমান থাকলেও নিশ্চিত হয়নি বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ। বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে একটার পর একটা প্রকল্প চলছে। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সময় বাড়ানো হচ্ছে প্রকল্পের। এতে জনগণের ওপর ঋণের বোঝা চাপলেও পেট মোটা হচ্ছে কর্তাদের। কিন্তু যে উদ্দেশ্য নিয়ে এতসব প্রকল্প সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

ওয়াসা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, চলমান প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে- ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট, নারায়ণগঞ্জ শহরের পানি সরবরাহ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও পুনর্বাসন প্রকল্প, সাভারের তেঁতুলঝড়া-ভাকুর্তা সংলগ্ন এলাকায় ওয়েলফিল্ড নির্মাণ (১ম পর্ব) প্রকল্প, পদ্মা (জশলদিয়া) পানি শোধনাগর প্রকল্প, ঢাকা এনভায়রনমেন্টালি সাসটেইনেবল ওয়াটার সাপ্লাই প্রজেক্ট এবং সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার প্রকল্প ফেজ-৩।

ওয়াসা জানিয়েছে, রাজধানী ঢাকায় পানি সরবরাহের পুরনো পাইপ লাইন পুনর্বাসনের জন্য এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে ‘ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ নামের একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পের প্রাক্কলন ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৭৩৪ কোটি ১ লাখ টাকা। এ বছর জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এই মেয়াদ ডিসেম্বর পর্যন্ত টেনে নেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে প্রকল্পের কাজ হয়েছে মাত্র ৬০ ভাগ। জানা গেছে, সময় মতো প্রকল্পটি বাস্তবায়ন না হওয়ায় নগরীর বেশির ভাগ এলাকায় ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি সরবরাহ হচ্ছে।

‘নারায়ণগঞ্জ শহরের পানি সরবরাহ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও পুনর্বাসন প্রকল্পে’র নামে ৮১ কোটি ১৪ লাখ টাকা ব্যয় করা হলেও সুফল আসেনি। নারায়ণগঞ্জ শহরের বহু এলাকার পুরনো পাইপ পরিবর্তন হয়নি। দুষিত ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি আগের মতই সরবরাহ হচ্ছে।

বৃহত্তর মিরপুর এলাকার পানির চাহিদা পূরণে ‘সাভারের তেতুলঝারা-ভাকুর্তা সংলগ্ন এলাকায় ওয়েলফিল্ড নির্মাণ করার একটি প্রকল্প রয়েছে ওয়াসার। দক্ষিণ কোরিয়ার আর্থিক সহায়তায় প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ৫২১ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে প্রতিদিন ১৫ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করতে পারবে ওয়াসা। জানা গেছে, ২০১২ সালের জুলাই থেকে এ বছর জুন পর্যন্ত মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার কথা। কিন্তু বাস্তবে এই প্রকল্পের অগ্রগতিও ভালো নয়।

মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার মাওয়া সার্কেল থেকে তিন কিলোমিটার পশ্চিমে জশলদিয়া গ্রামে শোধনাগার স্থাপনের মাধ্যমে পাইপ লাইন দিয়ে পদ্মার পানি ঢাকা নিয়ে আসার কথা। এ জন্য ‘পদ্মা (জশলদিয়া) পানি শোধনাগার প্রকল্প’ নামে ৩ হাজার ৫০৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকার একটি প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে ওয়াসা। ২০১৩ সালের জুন থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ নির্ধারণ রয়েছে প্রকল্পটির। সর্বশেষ পাওয়া খবরে জানা গেছে, এই প্রকল্পের কাজ অর্ধেকও হয়নি। যদিও প্রকল্পের জন্য পাইপ কেনা নিয়ে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে কর্তাদের বিরুদ্ধে। প্রকল্পটি থেকে দৈনিক ৪৫ কোটি লিটার পানি সরবরাহ হওয়ার কথা।

মেঘনা নদীর পানি ঢাকা নিয়ে আসতে ওয়াসার রয়েছে ‘ঢাকা এনভায়রনমেন্টালি সাসটেইনেবল ওয়াটার সাপ্লাই প্রজেক্ট’ নামের আরেকটি প্রকল্প। ৫২৪৮.০৬ কোটি টাকার এ প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এ প্রকল্পের মাধ্যমে মেঘনা নদীর পানি শোধন করে দৈনিক ৫০ কোটি লিটার ঢাকা মহানগরীতে সরবরাহ করা হবে। কিন্তু বাস্তবে এ প্রকল্পের অগ্রগতিও ২০ শতাংশ ছাড়াতে পারেনি।

সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার প্রকল্প ফেজ-৩ প্রকল্পের মাধ্যমে মেঘনা নদী থেকে আরও প্রায় ৫০ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করা হবে। এ প্রকল্পটি ২০২১ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা। এ টাকায় সায়েদাবাদে পুরনো শোধনাগারের পাশে নতুন শোধনাগার নির্মাণ করা হবে।

যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওয়াসার একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, যেসব প্রকল্পের কথা বলে নগরবাসীকে আশ্বস্ত করা হচ্ছে সেগুলোর একটাও সময় মতো বাস্তবায়ন করা সম্ভব না। বারবার সময় বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদও বাড়ানো হবে। তারা বলেন, প্রকল্পের কাজ যখন শেষ হবে তখন আরেক সমস্যা এসে দেখা দেবে। তখন ওই সমস্যা সমাধানেও আরেক প্রকল্প হাতে নিতে হবে। কর্মকর্তারা বলেন, যথাযথ পরিকল্পনার অভাব এবং শীর্ষ কর্মকর্তাদের অদক্ষতাই ওয়াসার পানি প্রকল্পগুলোর এ বেহাল দশা চলছে।

অন্যদিকে ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী এএসএম আবদুল আজিজ শনিবার সন্ধ্যায় বলেন, ওয়াসার সবগুলো প্রকল্পের কাজই চলছে এবং এগুলো সময় মতই শেষ হবে।

অন্যদিকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন জাতীয় সংসদে বলেছেন, ওয়াসার অধীনে বর্তমানে পদ্মা (জশলদিয়া) পানি শোধনাগার, ঢাকা এনভায়রনমেন্টালি সাসটেইনেবল ওয়াটার সাপ্লাই প্রজেক্ট এবং সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার প্রকল্প ফেজ-৩ নামের তিনটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে ২০২১ সালের মধ্যে ঢাকা ওয়াসার মোট উৎপাদনের ৭০ শতাংশ পানি ভূপৃষ্ঠ থেকে সংগ্রহ করার সম্ভব হবে। তিনি জানান, চারটি শোধনাগারের মাধ্যমে ওয়াসা ২২ শতাংশ পানি ভূপৃষ্ঠ থেকে এবং গভীর নলকূপের মাধ্যমে ৭৮ ভাগ পানি ভূগর্ভ থেকে সংগ্রহ করা হয়।
সাংবাদিক: বাংলা ট্রিবিউন।