ধূসর কৈশোর নয়, রৌদ্রজ্জ্বল তারুণ্য চাই — রকিবুল ইসলাম ঐতিহ্য

1302

ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপ তথা পশ্চিমাদেশ গুলো সমগ্র পৃথিবীতে তাদের উপনিবেশ স্থাপন করে চলেছিল। ব্যবসাকে পুঁজি করে মূলত সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রই চরিতার্থ করত। সামরিক পট পরিবর্তনের সেই অস্থির সময়ে চীন সাম্রাজ্য ছিল স্বাধীন। সেখানে বিদেশী বণিকদের চীন সম্রাট কে নজরানা দিয়ে মাথা নত করে ব্যবসা করতে হত।

সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকে ইউরোপিয়ানরা প্রথম আফিমের বাণিজ্য শুরু করে। চীনারা তা প্রথমদিকে ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করত।

কিন্তু ১৮০০ সালের প্রথম দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চীনে আফিম চোরাচালান শুরু করছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সেখানে প্রথম এটার নেশার উপজাত হিসেবে ব্যবহার শুরু করে। চীনারা ক্রমশ তাতে আসক্ত হয়ে যায়। যার ফলে, ১৮০০ সালে চীনে আমদানিকৃত আফিমের পরিমাণ ছিল দুই হাজার পেটি। ১৮৩৮ সালে সেটি চল্লিশ হাজারে পৌছায়। এক একেকটি পেটিতে ১৪০ থেকে ১৬০ পাউন্ড আফিম থাকত। পুরো চীন সাম্রাজ্য তখন আফিমে বুদ হওয়ার উপক্রম হয় । কোন কোন প্রদেশে ৯০% শতাংশ মানুষ আফিমের নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

১৮৪০ সালের ইতিহাস বিখ্যাত “আফিম যুদ্ধ”র সারসংক্ষেপ প্রেক্ষাপট ছিল এটা। শুধুমাত্র আফিম চোরাচালান রোধ করার জন্য চীন সম্রাট ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। প্রায় দুই বছর যুদ্ধ চলার পর ১৮৪২ সালের ২৯ আগস্ট নানকিং চুক্তির মধ্য দিয়ে প্রথম আফিম যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে এবং চীনে ব্রিটেন পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করে। তবুও আফিম বিস্তার রোধ করতে পারে নি চীনারা। এজন্য তাদের আবার দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ করতে হয়েছিল।

প্রতিটি দেশের সময়ের তাগিদে কিছু জাতীয় সমস্যা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। সেই সব জাতীয় সমস্যাগুলো চিহৃিত করে তার প্রতিকার করার ব্যবস্থা করে থাকে সরকার। মাদক বাংলাদেশের সমসাময়িক কালে অন্যতম প্রধান জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে বাংলাদেশের মাদকাসক্তের পরিমাণ প্রায় ৭০ লক্ষাধিক। যার ৮০% যুবক। মাদকের টাকা যোগাড় করতে শতকরা ৫০ ভাগ মানুষ বিভিন্ন অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে প্রতিদিন।

জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী, অবৈধ মাদকদ্রব্য আমদানির জন্য প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ১০ হাজার কোটিরও বেশী টাকার মুদ্রা বিদেশে পাচার হচ্ছে।

বাংলাদেশে আশির দশকে জনপ্রিয় মাদক ছিল ফেনসিডিল। নব্বই দশকে তার পাশাপাশি হিরোইন জায়গা দখল করে নেয়।
২০০০ সালের পর থেকে ইয়াবা জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশের মাদকাসক্তের মধ্যে ইয়াবা সেবনকারী হচ্ছে প্রায় ৮০ শতাংশ। তুলনামূলক দামে কম এবং কার্যকারিতা বেশি হওয়ায় ইয়াবাকে প্রথম পছন্দ হিসেবে বেছে নিচ্ছে মাদকাসক্তরা।

দুই যুগের বেশি সময় পরে প্রযুক্তির সহস্র আবিস্কার আর জ্ঞান বিজ্ঞানের চরম উত্‍কর্ষতা সত্ত্বেও মানব সভ্যতা যেন প্রশ্নের সম্মুখিন । অর্থলোভী মাদকব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের হাতে দেশের তরুণসমাজ আজ বিপন্ন। মাদকের অর্থ জোগাড় করতে তারা খুন, ছিনতাই, চুরিসহ নানা অপরাধ করছে। এমনকি নিজের পরিবারের সদস্যদেরকেও তারা খুন করছে। ছাত্ররা মরণনেশায় পরে পড়ালেখা শেষ করতে পারছে না। বখাটে হয়ে সমাজের, পরিবারের বোঝা হচ্ছে। বিবাহিতদের সংসার ভেঙে যাচ্ছে নিত্যদিন। মাদকাসক্তরা পরিবারে থেকেও যেন যোজন যোজন দূরের কেউ। তারা কেউ পরিবারের না, তারা কেউ সমাজের না, তারা কেউ দেশের না। তারা অন্য অচেনা কেউ। নিজেই নিজেকে তারা চিনতে ব্যর্থ হচ্ছে।

মাদকাসক্তের এই নির্লজ্জ মরণ যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অধিকতর ব্যস্ত , নৈতিকতা এবং বিবেক বোধ ক্ষতবিক্ষত।

চীনদেশ বছরের পর বছর পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিল। দুটি ভয়াভহ যুদ্ধে তাদের চরম মূল্য দিতে হয়েছে। যার ঐতিহাসিক কারন ছিল শুধুমাত্র মাদক আফিম।
বাংলাদেশে যেভাবে ইয়াবার বিস্তার শুরু হয়েছে অনতিবিলম্বে তা গতিরোধ করতে না পারলে প্রিয় স্বদেশকে এজন্য চড়া মূল্য দিতে হবে। যার ভয়াভহ রূপ আমরা হয়ত কল্পনাও করতে পারছি না।

তাই সময় আজ মাদকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর। পারিবারিকভাবে, সামাজিকভাবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের মাদকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। আমাদের সমাজকে, আমাদের রাষ্ট্রকে আমাদেরই বাঁচাতে হবে।
আমাদের স্বপ্নগুলোকে, আমাদের মায়ের নিত্য ভালোবাসাগুলোকে আমাদেরই জিইয়ে রাখতে হবে।

এলোমেলো পরিচর্যাহীন কোন ধূসর কৈশোর নয়।
সুন্দর ঝকঝকে আলোকিত রৌদ্রজ্জ্বল তারুণ্য চাই।

লেখক – সহ-সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ