চিরায়ত দৃশ্য বদলে দেয়া এক সরকারি কর্তার গল্প

1324

ভুমি অফিস। এই নামটা শুনলে এক বিলম্বের চিত্র চোখে ভেসে ওঠে। গ্রাহকের দিনের পর দিন হাজিরা দেওয়া সত্বেও কার্যসিদ্ধি না হওয়া এক প্রতিষ্ঠান! এরকমই একটা প্রতিষ্ঠান ছিলো গাজীপুরের ভূমি অফিস। একটা নথি নিতে গ্রাহককে ৮ মাস পর্যন্ত ঘুরতে হয়েছে বলে জানান, উত্তর ছায়াবীথি নিবাসি কৃষক আতাউর রহমান।

শিমুলতলীর জমি মালিক ওয়াজেদ শেখ বলেন, “আমাদের এই অফিসের চিত্র বদলে গেছে। আগে নথি তুলতে মাসের পর মাস লাগতো। এখন মুহূর্তেই পেয়ে যাই। এর কারণ হলো শৃঙ্খলা। আমাদের সাব রেজিষ্টার সাহেব আসার পর সব দলিল নির্দিষ্ট তাকে রাখার ব্যাবস্হা করেছে। এখন সহজেই দলিল ও নথি খুঁজে পাওয়া যায়।”

বৃদ্ধ এনায়েত কাজী এসেছেন নথি তুলতে। সাথে আছেন ১৯ বছর বয়সী নাতি রিপন। এনায়েত সাহেব বলেন, “আমগো আমলীগ সরকার সব সুবিধা দিয়ে দেয়। আমিতো শেখ সাহেবের আমলও দেখছি। উনি থাকতেও এইদেশে নিয়ম শৃঙ্খলা ছিলো। কিন্তু কু্ত্তার পেটে তো ঘিঁ সয় না। তারে মাইরা ফালাইলো। এহন তার মাইয়া ইনশাল্লাহ আবার সব নিয়মের ভিতরে নিয়া আইতাছে। শেখের বেডি শেখ সাহেবের মতই ভালা মানুষ”। রিপন বলে, “আগে এই অফিসের সামনে চায়ের দোকানে দালালরা দাঁড়ায় থাকতো। আমি নানার সাথে অনেকবার আসছি। তাদেরকে টাকা দিতে হতো কাজের জন্য। এখন কাউকে একটা টাকাও দিতে হয় না”।

এই সকল কর্মকান্ডের নেপথ্যে একজন রয়েছে। তিনি গাজীপুর সাবরেজিস্ট্রি অফিসের কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম। কীভাবে বদলালেন একটি ভূমি অফিসের চিরায়ত দৃশ্য? উত্তরে হেসে জানান, “শুধুই সদিচ্ছা। সদিচ্ছা থাকলে সবকিছু বদলে দেয়া সম্ভব বলে আমি বিশ্বাস করি। একসময় শিক্ষকতা করেছি। ছাত্রদের পড়িয়েছি সদিচ্ছার সক্ষমতার কথা। আমি সেদিন থেকে উপলব্ধি করেছি যেদিন থেকে শেখ হাসিনা বাস্তবে ডিজিটালাইজেশনের বাস্তবায়ণ দেখিয়েছেন।” “ডিজিটাল বাংলাদেশ” এই শব্দরা রাজনৈতিক ইশতেহার থেকে বের হয়ে বাংলার আনাচে কানাচে যেদিন ছড়িয়ে পড়েছে সেদিনই টের পেয়েছি সদিচ্ছা থাকলে সত্যিই আকাশ ছোঁয়া যায়। বলেন তিনি।

মনিরুল ইসলাম বলেন,যখন প্রথম গাজীপুর সাবরেজিস্ট্রি অফিসে আসি তখন এখানকার দৃশ্য এরকম ছিলোনা। বালামগুলো এলোমেলো ছিলো। একটা নথি খুঁজে পেতে ১৫ দিন ১ মাস বা তারও বেশি সময় লেগে যেত। গ্রাহকের চোখে মুখে বিরক্তি লেগেই থাকতো। বাইরে দালালদের দ্বারাও প্রতারিত হওয়ার সংবাদ এসেছে। কয়েকজনের সাথে আলাপ করি। কেউ কেউ নিরুৎসাহিত করে। অনেকে বলে দালালদের চক্র অনেক বড় এই সিস্টেম ভাঙলে ঝামেলা হতে পারে। তখন আরও জিদ চেপে যায় ভেতরে। আমাদের একজন প্রধানমন্ত্রী দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে দেশটাকে সুশৃঙ্খল বানানোর লক্ষ্যে সেইখানে একটা চক্রের ভয়ে আমি পিছিয়ে যাবো। তখনই সিদ্ধান্ত নেই এই অফিসটাকে আদর্শ অফিস বানাবো। কোনরকম বাঁধা এলে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে অবগত করার চেষ্টা করবো। এইতো এরপর কাজ শুরু করি। এখন তো দেখছেনই বেশ খানিকটা গুছিয়ে এনেছি। তবে ভালোর তো শেষ নেই। আপাতত চোখ কান বুঁজে কাজ করে যেতে চাই। যেন এখানে আসা প্রত্যেকটা গ্রাহক হাসিমুখে সালাম দিয়ে ঢুকতে ও বের হতে পারে এখনকার মতই। আমি যে ক্যাটালগিং সিস্টেম চালু করেছি, তাতে একটা দলিল খুঁজে পেতে ৬ মিনিট লাগে। আগে যা গ্রাহকের হাতে পৌঁছতে ৫ থেকে ১৫ দিন লাগতো”।

ভূমি অফিসে আসা লোকজন আপনার ভূয়সী প্রশংসা করছে। এটাতে আলাদা কোন আনন্দ অনুভব করেন? উত্তরে তিনি বলেন, “একদম না। এটা আমার দায়িত্ব। সরকারের বেতনের বিনিময়ে নাগরিককে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়া। নিজের দায়িত্ব পালনের বীপরিতে প্রশংসা আসলে প্রাপ্য না। তবে হ্যা মানুষ আমাকে যে ভালোবাসছে এটার বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাই। ব্যাপারটা ভালোলাগার মত। ভালোবাসা তো আর কেউ কখনো উপেক্ষা করতে পারে না।” তিনি আরও বলেন, “জমির শ্রেণীপরিবর্তন করে নাম মাত্র মূল্যে দলিল রেজিষ্ট্রি করার একটা প্রথা বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গাতেই দৃশ্যমান। এটাতে সরকারের রাজস্ব কমে যায়। এটা আমি সম্পুর্ণভাবে বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছি। এজন্য আমাকে এখনও প্রাণনাশের হুমকির সম্মুখীন হতে হয়।” বালাম রাখার তাক সংগ্রহের কথা বলছিলো সামনের চায়ের দেকানদার। এগুলো নাকি গণঅর্থায়নে কেনা হয়েছে। বিষয়টা কী? “হ্যা। আমি তাকের জন্য রিকুজিশন দিয়েছিলাম। কিন্তু সব প্রক্রিয়া পাড় করে তাক আসা বেশ সময়সাধ্য ব্যাপার। তখন কয়েকজন গ্রাহক এসে তাক দান করতে চাইলেন। নিতে অসম্মতি জানালে একজন বললেন, ‘দেখেন সরকারি অফিস তো আমাদের সেবা দেয়ার জন্যই হয়েছে। আগে এখানে আসলে দালালকে টাকা দিতে হতো, অফিসের ভেতরে টাকা দিতে হতো। এখন সেটা আর হচ্ছে না। এখন তাকটা যদি দ্রুত স্থাপন করা হয় তাহলে আমাদেরই দলিল পেতে সুবিধা হবে। মনে করেন এটা সরকারকে দেয়া আমার ট্যাক্স”। তাদের এই যুক্তির কাছে হার মেনে আমি তাকগুলো নিতে বাধ্য হই এবং প্রায় তিনমাস সময় নিয়ে বালামগুলো সাড়িবদ্ধভাবে সাজাই”।

দালাল উচ্ছেদের পর কোন বাঁধার সম্মুখীন হয়েছিলেন? এরকম প্রশ্নে তিনি বলেন, “কয়েকটা খুচড়ো ফোন এসেছিলো। পাত্তা দেই নি। কারণ হাজার হাজার মুখের হাসির শক্তির কাছে ওই কয়েকটা হুমকিকে খুব হালকা লেগেছিলো”।

আপনার সহকর্মী অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্দেশে কিছু বলতে চান? শুধু সরকারি কর্মকর্তা না। দেশের সব স্তরের সকল জনগণকে বলতে চাই একজন মানুষ তার পরিবার পরিজন হারিয়েছেন একসাথে, নিজেও হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছেন। প্রাণে বেঁচে ফিরেছেন অল্পের জন্য। সেই মানুষটা সব বাদ দিয়ে আমার, আপনার, আমাদের কথা ভেবে যাচ্ছে। আমি কড়জোরে সবার কাছে অনুরোধ জানাই, আমাদের হাসি ফোঁটানোর জন্য যিনি নিরলস নিজেকে ব্যায় করছেন, আসুন না তার মুখে আমরা একটু হাসি ফোঁটানোর চেষ্টা করি। শুধু মাত্র সৎ থেকে নিজের কাজটা করে গেলেই মুজিবকন্যা হাসবেন, হাসবে বাংলাদেশ।