নকল আর নিম্নমানের ‘উৎকৃষ্ট’ পরিবেশনা

রমজানের টিভি অনুষ্ঠান

693

1782279_3875782469690_704723300_oমুনিফ আম্মার

পবিত্র মাহে রমজান উপলক্ষে বাংলাদেশের প্রতিটি টিভি চ্যানেলেই ইসলামিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিলো। বিশেষ করে ইফতারের আগে-পরে এবং সেহরির আগে এসব অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো। এরমধ্যে কোরআন তেলাওয়াত, হামদ-নাত ও ইসলামিক আলোচনার প্রাধান্য ছিলো বেশি। কয়েকটি চ্যানেলে আবার হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতার ‘রিয়েলিটি শো’ও চলেছে। এসব অনুষ্ঠানগুলোর অধিকাংশই ছিলো নকল আর নিম্নমানের। কোনো কোনো অনুষ্ঠান দেখার অযোগ্য, কোনোটা আবার দায়সারা। কোনটায় ভর করেছে জামায়াত-শিবির। এসব অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো দর্শক যেমন হারাচ্ছে, তেমনি নির্লজ্জ দৈন্যতারও প্রকাশ ঘটিয়েছে।

ইসলামিক রিয়েলিটি শো: হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতা কি ইসলাম সমর্থন করে?
কয়েকটি টিভি চ্যানেলে হাফেজদের অংশগ্রহণে ইসলামিক রিয়েলিটি শো’য়ের মাধ্যমে হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতা চালিয়েছে। প্রথমত, প্রশ্ন হচ্ছে- এ ধরণের প্রতিযোগিতার বৈধতা কোরআনে কতোখানি দেয়া হয়েছে? কারণ, এ প্রতিযোগিতার অন্যতম উদ্দেশ্য বাণিজ্যিক। আর পবিত্র কোরআন নিয়ে বাণিজ্য করার বিষয়ে কোরআনেই স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা আছে। যেটাকে হারাম বলা হয়েছে। প্রশ্ন আসতে পারে, এ প্রতিযোগিতায় বাণিজ্যিক বিষয়টি কী? কয়েকটি এ ধরণের অনুষ্ঠান দেখে ও সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে আলোচনা করে আমার কাছে যেটা স্পষ্ট হয়েছে, এমন একটি আয়োজনে কোটি টাকারও বেশি খরচ হয়। এসব টাকার জোগাড় দিতে বিভিন্ন পণ্য ও প্রতিষ্ঠানের স্পন্সর নেয়া হয়েছে। স্পন্সরদাতা প্রতিষ্ঠান/ব্যক্তি এমন কিছু শর্তে স্পন্সর দিয়েছেন, যাতে অনুষ্ঠানের টাইটেল, কো টাইটেল কিংবা বিজ্ঞাপন বিরতিতে তাদের প্রতিষ্ঠান ও পণ্যের নাম তুলে ধরতে হবে। স্পন্সর পেয়ে আয়োজকরা এমন কিছু ব্যক্তিকে বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে এনেছেন, যারা কোরআন সম্পর্কিত জ্ঞান রাখেন না। শুধু টাকার বিনিময়ে তারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে প্রতিযোগী হাফেজদের বিষয়ে নানা ধরণের মন্তব্যও করেছেন। এখানে স্পষ্ট যে, বাণিজ্যিক স্বার্থ ছাড়া কেউ এসব অনুষ্ঠানে স্পন্সর করেননি। কেউ যদি বিনা শর্তে স্পন্সর করতেন তাহলে বাণিজ্যিক প্রসঙ্গটি আসতো না। কোরআন নিয়ে এমন বাণিজ্য আসলেই কি বৈধ?

দ্বিতীয়ত, রিয়েলিটি শো’র বিচারক, অতিথি, আয়োজন সবকিছুই প্রচলিত গান, নাটক, সিনেমার রিয়েলিটি শো’র আদলে তৈরি। কেবল ব্যাকড্রপ আর ডেকোরেশনে পরিবর্তন ছাড়া মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। একজন প্রতিযোগী কোরআন তেলাওয়াত করার পরে বিচারক ও একজন অতিথি তাকে নিয়ে কিছুক্ষণ মন্তব্য করেন, তারপরেই অতিথি আরেকজন প্রতিযোগীকে ডেকে আনেন। বারবার ঘোষণা দেন চমকপ্রদ সব পুরস্কারের। পার্থিব এসব পুরস্কারের প্রলোভন দেখিয়ে কোরআনের প্রতিযোগিতা ইসলাম কি সমর্থন করে? তারউপর পুরো আয়োজনটিই এমন সব অনুষ্ঠানের নকল, যেসব অনুষ্ঠান দেখা, শোনা বা সমর্থন করা ইসলামে হারাম।

ইসলামি সঙ্গীতের নামে এসব কী?
অনেকগুলো চ্যানেলে হামদ- নাত ও ইসলামি সঙ্গীত আয়োজনের ব্যবস্থাও করেছে। এক্ষেত্রে কয়েকটি চ্যানেল বিটিভি আমলের হামদ-নাত দিয়ে চালিয়ে গেছে অনুষ্ঠান। আর যারা একধাপ এগিয়েছে, তারা আটকে গেছে জামাত-শিবিরের জালে। ইসলামি সঙ্গীতের নামে জামায়াত-শিবিরের গানই পক্ষান্তরে প্রচার করেছে তারা। এ বিষয়টির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে একটু পেছনে যেতে হবে। একযুগ আগেও জামায়াত-শিবিরের ব্যবস্থাপনায় দেশজুড়ে সরব ছিলো বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। এসব সংগঠনের মাধ্যমে বিকল্প পথে শিবিরে কিশোরদের টানা হতো। সেখানে তাদের তৈরি বিভিন্ন ধরণের ইসলামিক গান চর্চা হতো। এগুলোর সিডি/ ক্যাসেটও একটা সময় ছড়িয়ে পড়েছিলো সবখানে। দীর্ঘদিন এসব সংগঠনগুলো প্রকাশ্যে সরব না থাকলেও অন্য উপায়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এবারও বাংলাদেশের কয়েকটি টিভি চ্যানেলে শিবিরের আওতাধীন সংগঠনগুলো প্রকাশিত ইসলামিক গানগুলোই প্রচার করতে দেখা গেছে। এর কারণ হিসেবে ধারণা করা যেতে পারে- এক. হয়তো অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি/ব্যক্তিরা একসময় শিবির করতেন, দুই. হয়তো তারা খরচ বাঁচানোর জন্য সহজে যা পেয়েছেন তা-ই প্রচার করেছেন, তিন. অথবা তারা জানেনই না এগুলো শিবিরের প্রোডাকশন। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব কারণের কোনো একটি কারণও যদি সঠিক হয়, তাহলে আর বুঝতে বাকি নেই আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো কতোটা সংকটের মধ্যে আছে।

আর যারা আদিযুগের ইসলামিক গান, হামদ-নাম নিয়েই ছিলেন, তাদের দৈন্যতা তো স্পষ্ট। অনুষ্ঠান করতে হবে, তাই করেছেন। এ অনুষ্ঠান নিয়ে নতুন করে ভাবনা কিংবা বাজেট বরাদ্দ নেই। ফলে ‘সামনে যা পেয়েছেন’ তা দিয়েই কাজ দায় সেরেছেন, প্রচার করেছেন নিম্নমানে ‘উৎকৃষ্ট’ পরিবেশনা।

ইসলামিক আলোচনা আর মুনাজাতে ‘আহাজারি’
প্রায় সব টিভিতেই ইসলামিক সুওয়াল-জওয়াব, আলোচনা ও মুনাজাত অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। হাতে গোনা এক/দুইটা টিভি ছাড়া বাকিগুলোর এ ধরণের আয়োজন ছিলো দেখার অযোগ্য। অতিথি নির্বাচনে এমন সব আলেমদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, যাদের নিয়ে রয়েছে নানাবিধ বিতর্ক। কেউ জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, কেউ ‘অমুক’ মতাদর্শের আবার কেউ ‘অমুক’ পীরের খলিফা। কোনো আলেমকে নিয়ে প্রতারণা আর মানুষ ঠকানোর অভিযোগও রয়েছে। বাহারি টুপি আর রঙ বেরঙের জামা পরে এ ধরণের আলেমরা যখন টিভির সামনে বসে সুর করে বয়ান দেন, তখন সেটা দেখার যোগ্যতা হারায়। কেউ কেউ তো যাত্রাপালার জামা পরে অনুষ্ঠানে অংশ নেন। এ ধরণের কোনো কোনো অনুষ্ঠানে শিল্পপতি, টাকাপতি কিংবা হোমড়া চোমড়াদের গেস্ট করে আনা হয়েছে। ফলে এগুলো দেখে দর্শক কিছু জানার চাইতে বিভ্রান্তই বেশি হয়েছে।

আর মুনাজাতের নামে কয়েকটি অনুষ্ঠানে হুজুরদের অযাচিত ‘আহাজারি’ দেখে তো প্রশ্ন জেগেছে, এটা কি টিভিতে দেখানোর জন্য নাকি সত্যিই আল্লাহর কাছে চাওয়ার জন্য?

তবে, এরমাঝেও কিছু চ্যানেল রমজানের জন্য সুন্দর অনুষ্ঠান বানিয়েছে। যেখানে সুমধুর কোরআন তেলাওয়াত মুগ্ধতা ছড়িয়েছে, চোখের কোণে জল এনেছে। গঠনমূলক ইসলামিক আলোচনাগুলো ছিলো অতি প্রাসঙ্গিক এবং সময় উপযোগী। অতিথি নির্বাচনসহ সামগ্রিক আয়োজন ছিলো নান্দনিক। তাদের চেষ্টা ছিলো যথাসম্ভব ইসলামিক নিয়ম মেনেই অনুষ্ঠানগুলো প্রচার এবং তথ্য প্রদানের। এমন অনুষ্ঠোন সংখ্যায় কম বলে দর্শকও তুলনামূলক অল্প, তবে মানের দিকে এসব অনুষ্ঠানই বিস্তর এগিয়ে।

মুনিফ আম্মার: সাংবাদিক