তোমারে চাই না ভুলিতে…

1181
সাইফ হাসনাত

স্মৃতি যতো কষ্টেরই হোক, মানুষ তা ধরে রাখতে চায়। সেই স্মৃতি যদি হৃদয় এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয়, যখন তখন মনকে ডুবিয়ে দেয় বেদনার গভীর বালুচরে, যেখান থেকে চাইলেই সহজে উঠে আসা যায় না, তাতেও কোনো অনীহা নেই। স্মৃতি লাগবেই।

কদিন আগে একটা ছবি প্রিন্ট করাতে গেলাম স্টুডিওতে। আজকাল লোকজনকে তেমন যেতে দেখা যায় না ওসবে। কিন্তু আমার যেতে হলো। স্টুডিওর মেশিন থেকে প্রিন্ট করা ছবির প্রয়োজন পড়ে ছিলো। সাধারণ প্রিন্টার থেকে বের করা ছবিতে কাজ হবে না বলে স্টুডিওতে যাওয়া ছাড়া উপায়ও ছিলো না। সেখানেই স্মৃতি ধরে রাখার জন্য মানুষের দুর্ণিবার আকর্ষণের আরো একটা উদাহরণ দেখলাম।

Saif Hasnat Logo

লোকটির বয়স ৫০ পেরিয়ে গেছে অন্তত পাঁচ বছর আগে। মুখাবয়ব দেখে তাই মনে হয় আমার। মোটাসোটা শরীর। ভুড়ির আকারও বেশ বড়সড়। মাথায় নতুন টাক। জুলফিতে পাক ধরে গেছে। হালকাপাতলা চুলগুলো স্টুডিওর দেয়াল ফ্যান থেকে আসা বাতাসে উড়ে উড়ে তার কান ঢেকে দিচ্ছে।

দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো কোনো উপস্থিতি নয়, তারপরও লোকটার উপর দৃষ্টি পড়লো। লোকটার উপর নয় ঠিক, আমার দৃষ্টিটা পড়লো আসলে তার হাতে ধরা ফটো ফ্রেমের উপর। খেয়াল করলাম অনেক অনেক দিন আগের একটা ছবি তাতে। ফেলে আসা সুদীর্ঘ সময়ের প্রমাণ দিতেই যেনো ছবিটা ঝলসে গেছে। সেখানে একজন নারী ও পুরুষ। তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছয় সাত বছরের এক শিশু। কারোর মুখই স্পষ্ট নয়।

তিনি এসেছেন ছবিটা নতুন করতে! যেনো স্টুডিওতে এলেই পুরোনো ঝলসে যাওয়া ছবির মুখগুলো ঝলমল করে উঠবে! যেনো বহুদিন বাদে একটা দুইটা কথাও শুনিয়ে দিবে অস্ফুটে!

এই ছবি তো খুব বেশি ঠিক করা যাবে না! স্টুডিওর কম্পিউটার অপারেটর বললেন এই কথা। লোকটির গোল গোল মুখটায় কেমন বিষাদ ছড়িয়ে পড়লো। কতোটুকু হবে? সংশয়পূর্ণ জিজ্ঞাসা তার। অপারেটর বললেন, খুব বেশি ঠিক করা যাবে না। যেমন আছে, হয়তো এর চেয়ে একটু ভালো হবে। মুখ বোঝা যাবে না।

লোকটির মুখেও দুর্বোধ্য রেখা ফুটে উঠলো। কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে ফটো ফ্রেমটা দুই হাতে ধরলেন তিনি। কম্পিউটার অপারেটর তার কাজে ব্যস্ত। আশপাশে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকা লোকজনও খেয়াল করছে না কিছু। লোকটি এক দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইলেন ফটোটার দিকে। যেনো জিজ্ঞেস করতে চাইলেন— এই ফটো, কেনো ঠিক হবে না তুমি!

না, তিনি ফটোটাকে এ কথা বললেন না। সকরুণ দৃষ্টিতে তাকালেন অপারেটরের দিকে। ভাই, মুখগুলো বোঝা যাবে এমন কিছু করা যাবে না? অপারেটর এবার বিরক্ত, ভাই আমি মুখ বানিয়ে দিবো নাকি? যা আছে, তাই একটু পরিস্কার হবে। আর কিছু হবে না।

একটু পরিস্কার হবে— এই কথাটাই যেনো আনন্দ নিয়ে এলো তার মনে। বললেন, কতো টাকা লাগবে? অপারেটর চোখের ইশারায় দোকানমালিককে দেখিয়ে দিলেন। রিমলেস ফ্রেমের চশমা পরা দোকানমালিক জানালেন, ৫০০ টাকা। ৫০০ টাকা? বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করেও লোকটি রাজি হয়ে গেলেন এবং ছবিটা জমা দিয়ে দিলেন। তাকে জানানো হলো দুদিন পর এসে নিয়ে যেতে। ভাই একটু দেইখেন যতোটা সম্ভব মুখটা যাতে বোঝা যায়। তার এই কথা কারো কানে গেলো না সে দিকে খেয়াল না করে লোকটি চোখেমুখে অচেনা একটা শূন্যতা নিয়ে বের হয়ে গেলেন।

দুই.
দক্ষিণ দিকে মুখ করা নানাবাড়িতে ছোটবেলার অনেক অনেক দিন কেটে গেছে। সেই সব দিনের স্মৃতিরা এখনো এতোটাই জীবন্ত যে, বহু দিন পরপর গেলেও মনে হয় যেনো একদিন আগেই ঘুরে গেছি। যদিও সব কিছু আর আগের মতো নেই। কিন্তু মানুষ আসলে স্মৃতি ধরে রাখতে চায়।

এই চাওয়ার তীব্রতা অত্যন্ত প্রবল। ফলে স্মৃতির কাছে কখনো কখনো বাস্তবতা হার মানে। এ কারণেই হয়তো, যে খেলার মাঠের চারপাশ ঘিরে ছিলো সবুজ আর সবুজ, সেই খেলার মাঠটা এখন কংক্রিটের জঙ্গল হয়ে গেলেও পুরোনো মায়া কমে না। সেই কংক্রিটের স্তুপের পাশ দিয়ে হাঁটার সময় কোত্থেকে যেনো শব্দ ভেসে আসে, যেনো ছোট মামা চিল্লিয়ে ওঠে— ওই ক্যাচটা ধর, কিপারের কাছে মার কিপারের কাছে!

কদিন আগে নানা চলে গেলেন ইহধাম ছেড়ে। সারাটা জীবন বারবার এমন হয়েছে, আমি নানাবাড়ির স্টেশনে নেমেই সামনে পেয়েছি নানাকে। চেক লুঙ্গি আর সাদা গোল গলার পাঞ্জাবি। সেই কোলে চড়ে বসে থাকার বয়স থেকে আমার মনে নানার এই একটাই ছবি। চেক লুঙ্গি আর সাদা গোল গলার পাঞ্জাবি।

মৃত্যুর খবর শুনে এবার যখন গেলাম, নানা তখন সোজা হয়ে শুয়ে থাকা একটা দেহ ছাড়া আর কিছু নন। কিন্তু আমার স্মৃতি এই বাস্তবতাকে কিভাবে যেনো ছাড়িয়ে গেলো। নিজ হাতে নানাকে কবরে শুইয়ে দিলাম। বিগত জীবনের ক্লান্তি ভর করা মুখটা ছুঁয়ে দিলাম বারবার। কিন্তু এ কথা মনেই হলো না যে, নানাকে আর কখনো নানা বলে ডাকা হবে না। চেকের লুঙ্গি আর সাদা গোল গলার পাঞ্জাবি পরা আমার নানা আর ইহধামে নেই।

আমি বরং স্মৃতির শক্ত শরীরটা ধরে রাখলাম। যা বাস্তবতার কঠিন সময়টাকে হারিয়ে দিলো। অদ্ভুত একটা ব্যাপার তাই না! কিন্তু যৌক্তিকও কি নয়? ২৭ বছর ধরে জমানো স্মৃতি কয়েক ঘণ্টার অন্য বাস্তবতার কাছে কেনো হার মানবে?

তিন.
লোকটি সেই ছবি দুদিন পর নিয়ে গিয়েছিলো কিনা জানা হয়নি। সেই ছবিতে যে তিনজন মানুষ, তারা তার বাবা-মা কিনা, সে কথাও জানার সুযোগ ঘটেনি। কিন্তু মনটা কেমন আনচান হয়ে আছে তবু।

বারবার নিজের অজান্তেই একটা প্রশ্ন উঠছে মনে— ছবিটার মুখগুলো কি কিছুটা জীবন্ত হয়ে উঠেছিলো? লোকটি কি তার মুখের অচেনা শূন্যতা আড়াল করতে পেরেছিলেন ছবিটার একটু জীবন্ত হওয়া দেখে? নাকি স্টুডিও থেকে বলে দেয়া হয়েছে যে কাজটি তারা করতে পারছে না?

প্রায় রাতে আজকাল লোকটির কথা মনে পড়ছে। যদিও তার সাথে কোনোদিন আর দেখা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। মানুষের জীবন কেমন অদ্ভুতভাবে চলে! কতো কতো স্মৃতি না চাইলেও মস্তিষ্কে একটা জায়গা ঠিকই দখল করে রাখে। এই স্মৃতি ধরে রাখারাখির ব্যাপারে মানুষ বড্ড দুর্বল।

সাইফ হাসনাত : ক্রীড়া সাংবাদিক ও গীতিকার।