তাঁরা জীবিত না মৃত ৩ বছরেও অজানা

568

আরাফ হোসেনের বয়স এখন আড়াই বছর। তিন বছর আগের ডিসেম্বর মাসে সে যখন মায়ের গর্ভে, তখনই তার বাবা ছাত্রদলের নেতা পারভেজ হোসেনকে তুলে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ধারী একদল লোক। এখন আরাফ আর তার পাঁচ বছরের বোন আদিবা ইসলামকে নিয়ে তাদের মা ফারজানা আক্তার নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। একদিকে স্বামী জীবিত না মৃত, সেই ধন্দে আটকে আছে জীবনের অনেক কিছুই। আরেক দিকে নিজের কোনো আয় নেই, দুই সন্তান নিয়ে বাবার বাড়িতে একরকম আশ্রিত হয়ে আছেন। ছেলেকে না দেখেই গত নভেম্বরে মারা গেছেন পারভেজের বাবা শফিউদ্দীনও।
এ রকম নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছে গুমের শিকার আরও কয়েকটি পরিবার। গতকাল রোববার এ রকম ২০ জনের পরিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে জড়ো হয়েছিল গুম হওয়া স্বজনদের ফেরত পাওয়ার দাবি নিয়ে। তিন বছর ধরে স্বজনদের ফেরত পেতে নানা চেষ্টা-তদবির আর সভা-সমাবেশ একসঙ্গে আয়োজন করতে গিয়ে পরিবারগুলোর মধ্যে গড়ে উঠেছে অন্য রকম এক সহমর্মিতার বন্ধন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে এই ২০ জনকে রাজধানী ও সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই থেকে পরিবারগুলো সরকারের মন্ত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে। পুলিশ, র‍্যাব, ডিবি—সবার কার্যালয়ে গিয়ে ধরনা দিয়েছে। প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন জায়গায় সমাবেশ করে প্রতিবাদ জানিয়েছে। গুম হওয়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগই বিএনপি বা ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দিতে গিয়ে স্বজনদের সবাই কেঁদেছেন। কেউ কেউ কোনো কথাই বলতে পারেননি। গুম হওয়া ব্যক্তিদের ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী চারটি শিশুসন্তানও সংবাদ সম্মেলনে কথা বলে।
নিখোঁজ এম এ আদনান চৌধুরীর বাবা রুহুল আমিন গতবারই অনেক অসুস্থ ছিলেন। এ বছর আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না, দৃষ্টিও কমে আসছে। কথা বলতে গিয়ে দাঁড়িয়েই কাঁদলেন অঝোরে। তিনি বলেন, ‘ডিসেম্বরের শীতের এক গভীর রাতে ছেলেটাকে দিয়ে যাবে বলে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গেল। সেই ছেলে আর ফিরল না। ছেলে আমার কোথায় আছে, সেই খোঁজ নেই; বেঁচে আছে কি মরে গেছে, তা-ও জানি না।’ প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে আবেদন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনি তো সবার খবর রাখেন। আমাদের দয়া করে বলুন, আমাদের ছেলেদের ভাগ্যে কী ঘটেছে।’

গুম হওয়া মাজহারুল ইসলামের ভাই মশিউর রহমান বলেন, ‘আমরা শুধু ভাইকেই হারাইনি। আমাদের পুরো পরিবারের সুখ-স্বচ্ছন্দ আর আনন্দ হারিয়ে গেছে চিরতরে। আমাদের বাবা-মা ছেলে হারিয়েছেন। মা এখনো গভীর রাতে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকেন ছেলে আসবে বলে। বৃষ্টি হলে মায়ের দুশ্চিন্তা হয়, ছেলে ভিজে গেল কি না। ভাইয়ের শোকে আমার বাবা-মায়ের অবস্থা এখন ভালো না।’

গুম হওয়া সবুজবাগ থানা ছাত্রদলের সভাপতি মাহাবুব হাসানের ভাই জাহিদ খান বলেন, ‘একেকটা গুম হওয়া পরিবারের কী কষ্ট, তা অন্য কেউ ভাবতেও পারবে না। আমরা খারাপ শঙ্কাটাও করতে পারি না, আবার ভালো কিছু আশাও করা যায় না। একেকটা দিন যে কী দুঃসহ! কারও পরিবারের কেউ গুম হলে পুরো পরিবারটিই দুর্বল হয়ে যায়। আত্মীয়স্বজনকেও আর পাশে পাওয়া যায় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্বাধীন দেশে আমাদের করের টাকায় চলা বাহিনীগুলো আমাদের ভাইদের গুম করলে আমরা কার কাছে যাব বিচার চাইতে? এটা কেমন গণতন্ত্র?’

জাহিদ বলেন, চার বছর আর আট বছরের দুটি সন্তান নিয়ে মাহাবুবের স্ত্রী এখন টিকে থাকার যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। মাহাবুব গুম হলেও তাঁর পুরোনো রাজনৈতিক মামলাগুলো এখনো সচল। প্রতি দুই মাসে অন্তত একবার পুলিশ বাসায় আসছে, এ নিয়েও সবাই আতঙ্কে থাকে। একবার মালপত্র ক্রোক করতেও এসেছিল। মাহাবুবের নিজের কোনো সম্পত্তি না থাকায় পুলিশ ফিরে গেছে।
সংবাদ সম্মেলনে বেসরকারি সংস্থা অধিকারের পরিচালক নাসিরউদ্দীন বলেন, বিগত কয়েক বছরে গুমের শিকারের সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়েছে। গুমের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা দায়মুক্তি ভোগ করছেন। কিন্তু যাঁরা এসব করছেন, তাঁদের বোঝা উচিত যে বিচার একদিন হবেই।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির গুম হওয়া সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম ওরফে সুমনের বোন মারুফা ইসলাম ফেরদৌসি। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, গুমের শিকার ব্যক্তিদের এবং তাঁদের পরিবারগুলোকে সব ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। এমনকি তারা আইনি সুরক্ষা থেকেও বঞ্চিত। তাঁদের স্ত্রী-সন্তানেরাও আর্থিক ও সামাজিক প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়।
সাজেদুল ইসলামের আরেক বোন আফরোজা ইসলাম বক্তব্য দিতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। বলেন, ‘আমাদের কষ্টের কথাগুলো প্রধানমন্ত্রীকে, দেশবাসীকে জানাতে এ তিন বছরে আমরা বহু সংবাদ সম্মেলন করেছি, জমায়েত করেছি। কিন্তু কেউ আমাদের বলতে পারেনি তারা কোথায় আছে। প্রত্যেকটা লোকের দ্বারে দ্বারে গিয়েছি, দেশে-বিদেশে চেষ্টা করেছি। একসময় আমাদের সঙ্গে অনেকেই ছিলেন। এখন কেউ নেই। গুম হয়ে যাওয়া দুই তরুণের বাবা ছেলেদের শোকে এ বছর মারা গেছেন। আপনারা আমাদের কষ্ট বুঝতে পারছেন না। একটা পরিবারের একটা সন্তান গুম মানে পুরো পরিবারটিই নেই। এটা চোখে দেখা যায় না।’

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সারাক্ষণ ছেলের চিন্তায় থাকা সাজেদুলের মা হাজেরা খাতুন এখন ঠিকমতো জিনিসপত্র ঠাহর করতে পারেন না। ঠান্ডা পানি ভেবে গরম পানি গায়ে ঢেলে হাত-শরীর পুড়িয়ে ফেলেছেন। এই শরীর নিয়েই সংবাদ সম্মেলনে এসেছিলেন তিনি। তাঁর হাতে মাইক্রোফোন দিয়ে যখন কথা বলতে বলা হলো, তখন কেবলই কাঁদলেন এই মা।

সংবাদ সম্মেলন শেষে এসব পরিবারের সদস্যদের একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে দেখা যায়। চঞ্চলের মা বিবি হাজেরার হাত ধরে কেঁদে ফেলেন মাজহারুলের ভাই মশিউর রহমান। আদনান চৌধুরীর বাবা রুহুল আমিনের শরীর কেমন, নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছেন কি না—সব খবর রাখছিলেন পারভেজ হোসেনের স্ত্রী ফারজানা। বাড়ি যাওয়ার সময়ও পরিবারগুলো একে অন্যের সঙ্গে গাড়ি, মোটরসাইকেল ভাগাভাগি করে।

এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল বলেছেন, ‘গুম বলে কোনো শব্দ নেই। গুম বলে আমাদের কোনো কিছু জানা নেই। যাঁরা গুম রয়েছেন বলে অভিযোগ করা হচ্ছে, তাঁরা বিভিন্ন কারণে আত্মগোপনে রয়েছেন। আমরা অতীতে দেখেছি, তাঁদের অনেকেই ফিরে এসেছেন।’ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে আয়োজিত এক আলোকচিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।

গত বছর (২০১৫ সাল) জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে মোট ১৫টি গুমের অভিযোগ করা হয়। গত ২৯ আগস্ট জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেছিলেন, এগুলোর মধ্যে কয়টি অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়েছে, তা তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না।

বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দিয়ে ৭৫ জনকে ধরে আনার অভিযোগের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ৮ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে, ৩ জনকে পরে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, ১৮ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যদের খোঁজ নেই। ২০১৫ সালে গুম হন ৫৫ জন। পরে তাঁদের ৭ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়, ৫ জন ফিরে আসেন, লাশ উদ্ধার হয় ৮ জনের। ২০১৪ সালে গুম হন ৮৮ জন। তাঁদের ২৩ জনের লাশ উদ্ধার হয়, ১২ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়, গ্রেপ্তার দেখানো হয় ১ জনকে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান গতকাল বলেন, পাঁচ-ছয় বছর ধরে গুমের ঘটনা অস্বাভাবিক মাত্রা পেয়েছে। এর মধ্যে গুমের শিকার পরিবারগুলো এবং যাঁরা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, তাঁদের কাছ থেকে একই রকম বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। তাঁদের যে বর্ণনা, তাতে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে এ ঘটনার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্টতা আছে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা প্রমাণ করে, এ ধরনের গুমের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। রাষ্ট্র এর দায় এড়াতে পারে না।