এমনও দিন কেনো যে আসে

778
নামঞ্জুর গল্প

যেখানেই নামেন ভাড়া কিন্তু ২৬ টাকা। কী অদ্ভুত এবং গোয়ার্তুমির কথা! আপনার গন্তব্য হয়তো দুই কিলোমিটার দূরে, এই দূরত্ব পারি দিতে ঢাকায় খরচ হওয়ার কথা অন্তত পাঁচ টাকা। কারণ এর চেয়ে কম ভাড়া দেয়া যায় না। কিন্তু আপনার কাছে ২৬ টাকা চাইলে কেমন লাগবে? প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হবে নিশ্চয়।

মিরপুর ১০ থেকে যারা আগারগাঁও-খামারবাড়ি-মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ হয়ে কলাবাগান-নিউ মার্কেটের দিকে যান, তারা নিশ্চয় এই রকম গোয়ার্তুমির কথা নিয়মিত শোনেন। ঢাকার অন্যান্য রুটেও এ রকম আছে হয়তো। মিরপুর ১০ থেকে আমার প্রায়ই যেতে হয় ধানমন্ডি ২৭। গুগল ম্যাপে ঘাঁটাঘাটি করে দেখেছি, এই পথের দূরত্ব সাত কিলোমিটারের কিছু কম। সরকার নির্ধারিত ভাড়া পরিশোধ করে এই পথটা পারি দিতে প্রয়োজন সাড়ে ১২ টাকা। কিন্তু অদ্ভুত গোয়ার্তুমির দেশে আমাকে গুনতে হয় ২৬ টাকা।

Saif Hasnat Logo

প্রথম প্রথম খুব মেজাজ খারাপ হতো এই অতিরিক্ত টাকা গুনতে। কিন্তু এখন সয়ে গেছে। ছোটবেলায় পড়েছি, অন্যায় যে করে এবং যে তা সয়ে যায়, তারা দুজন সমান অপরাধী। অন্য অনেক ব্যাপারের মতো, এই ব্যাপারটাও বড় বেলায় এসে বদলে গেছে। এখন দেখি, অন্যায় যে করে সে অপরাধী নাও হতে পারে। কিন্তু যে অন্যায় সহ্য করে না, সে নিশ্চিত অপরাধী!

আমিও তাই অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অপরাধে সামিল হই। আদায় করে অবশ্য নয়, দিয়ে। না দিলে কন্ট্রাক্টরের সঙ্গে ঝগড়া করতে হবে। এতে অন্য যাত্রীদের জন্য আমি স্রেফ শব্দ দূষণের কারণ হবো। যা ঠিক নয়, অপরাধ। কিংবা গাড়ি সাইডে চাপিয়ে আমাকে দেয়া হবে। অন্য যাত্রীরা জানালা দিয়ে তখন আকাশ দেখবেন। এই ঢাকা শহরে রাস্তা ছাড়া আকাশ দেখা যায় না। আমাকে নামিয়ে দেয়ার সময় তৈরি হবে যানজট। সব মিলিয়ে চিন্তা করে দেখলাম, ভাড়া বেশি দেয়ার অপরাধ মেনে নিলে অন্য অনেক দিক থেকে আমি জগতের জন্য ভালো একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়াই। সুতরাং আমার বেশি ভাড়া দেয়া সহ্য হয়ে যায়।

গত ১২ মার্চেও আমি অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে ধানমন্ডি ২৭ গেলাম। সেখান থেকে হেঁটে অফিস। রাস্তার সব সময়ের জ্যাম ঠেলে যেতে যেতে ফেসবুকে বা খবরের ওয়েবসাইটে ঢুঁ মারার অভ্যাস থাকলেও, এ দিন কেনো যেনো মোবাইলে নেট অন করিনি। গাড়িতে বসে বসে আকাশ দেখছিলাম সম্ভবত।

দুই.
চার ঘণ্টা ধরে যদি আগুন জ্বলে, কী কী পুড়তে পারে? অদ্ভুত প্রশ্ন! উত্তরও নিশ্চয় অদ্ভুত হবে এবং উত্তর কখনোই সন্তোষজনক হবে না। সুতরাং উত্তর খোঁজার জন্য বেশি সময় নষ্ট না করে ১২ মার্চের সূর্যটা উঠার আগের রাতের দিকে চোখ ফেরাই।

মিরপুরের ইলিয়াস মোল্লা বস্তিতে বাস করতেন প্রায় ২৫ হাজার মানুষ। চার ঘণ্টায় তাদের আবাস পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে ওই রাতে। চার ঘণ্টার আগুনে কী কী হতে পারে— তার একটা আন্দাজ এখান থেকে করা হয়।

২৫ হাজার মানুষের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন পোশাককর্মী। তাদের আয় অল্প। তাদের জীবনের দামও তাই অল্প। যাদের জীবনের দাম অল্প, তাদের জন্য বেশি নিরাপত্তাও তাই অদরকারি। তাই যদি না হবে, রাষ্ট্রীয় কোষাগার ফুলে ফেঁপে উঠার দিনগুলোতে এক রাতে কেনো এতোগুলো মানুষ স্রেফ গৃহহীন হয়ে যায়! ওহ, আমরা বোধহয় অন্য দিকে চলে যাচ্ছি। কথা হচ্ছিলো চার ঘণ্টায় কী কী পুড়তে পারে, তা নিয়ে।

যা কিছু পুড়তে পারে, তার তালিকায় ঢুকে গেছেন জমিলা বেগম। ৬০ বছর বয়সী এই নারী বস্তিতে থাকতেন তার সন্তানের সঙ্গে। মাকে শহরে এনে শান্তি দিতে চেয়েছিলো তার সন্তান। কিন্তু ১২ মার্চ রাতে তার শরীরের ৬৮ শতাংশ পুড়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার শ্বাসনালী এবং তিন দিন পর মৃত্যু হয় তার।

২৫ হাজার মানুষ একসঙ্গে গিজ গিজ করে যেখানে থাকেন, সেখানে যে নিরাপত্তা দরকার, তা সম্ভবত নয়। নিরাপত্তা লাগলে কেউ না কেউ ভেবে দেখতেন।

তিন.
আমি যখন গাড়িতে বেশি ভাড়া দিয়ে জানালা দিয়ে আকাশ দেখছিলাম, তখন ঢাকার আকাশ ছেয়ে আছে কালো মেঘে। বসন্তের আকাশের মেঘ অতোটা কালো হয় না। বসন্তের আকাশ থাকে নীল আর মেঘেরা হয় সাদা। কিন্তু ১২ মার্চের আকাশে ছিলো কালৌ মেঘের আনাগোনা। জমিলা বেগমের শরীর পোড়া ধোঁয়াও বোধহয় তাতে মিশে ছিলো।

ওই কালো মেঘের একটু প্রতিবিম্ব চোখে নিয়ে অফিসে ঢুকলাম যখন, তখন আমার কম্পিউটারের স্ক্রিনে ভেসে এলো কালো ধোঁয়া। নেপালের কাঠমাণ্ডু থেকে উড়ে আসা এই ধোঁয়ার সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় ছিলো না। তারপরও স্ক্রিন ভেদ করে সেই ধোঁয়া ঢুকে পড়ছিলো আমার নাক-মুখ দিয়ে। জমিলা বেগমের মতো পুড়ে যাচ্ছিলো আমার শ্বাসনালীও।

কালো মেঘ আর কালো ধোঁয়ার সঙ্গে তাল মেলাতেই কিনা কে জানে, নেমে এলো একটা কালো সন্ধ্যা। সঙ্গে আসতে থাকলো একটা একটা দগ্ধ মানুষের নাম। যাদেরকে আমি কোনোদিন দেখিনি। কিভাবে কিভাবে যেনো তদের ফেসবুক প্রোফাইলও একটা একটা বিষাদি মেঘের মতো ভেসে আসতে থাকলো সামনে। সেই বিষাদের দলার ভিতর দাঁড়িয়ে কেউ হাসছে, কারো হাতের মুঠোয় ধরা একটা ছোট বাচ্চার নরম হাত। খবর আসতে থাকলো তাদের বেশির ভাগই আগুনে দগ্ধ হয়ে গেছেন। তাদেরকে পুড়ে ধোঁয়ার কুণ্ডুলি চলে গেছে আসমানে।

আমি কেমন একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলাম। যে ঘোরে বাসের কন্ট্রাক্টরকে বেশি ভাড়া দিয়ে আমি নির্বিকার হয়ে আকাশ দেখি, যে ঘোরে জমিলা বেগমের পুড়ে যাওয়া কঙ্কালসার দেহের দিকে তাকিয়ে থাকি এবং যে ঘোরে আমি নেপালের কাঠমাণ্ডুতে ত্রিভুবন বিমানবন্দরের পাশের খেলার মাঠে দুই হাত জোড় করে পেটে ঝুলিয়ে দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি।

তারপর সন্ধ্যার লেজে ঝুলতে ঝুলতে নেমে আসে রাত। আমি উল্টো ফেরার পথ ধরি। ধানমন্ডি ২৭ থেকে মিরপুর ১০। আবার হাসি হাসি মুখ করে গাড়িতে বেশি ভাড়া দেই। আমার পিছনের সিটে বসা এক শিক্ষার্থী ভাড়া নিয়ে একটু তর্ক করতে চায়, কিন্তু অন্য দুজন লোক চেঁচিয়ে ওঠে— ভাই, এই রাস্তায় কি আপনি আজকে প্রথম নাকি! ভাড়া জানেন না?

সাইফ হাসনাত : ক্রীড়া সাংবাদিক ও গীতিকার।

তোমারে চাই না ভুলিতে | সাইফ হাসনাত