মর্গের ‍অপেক্ষায় সিনথিয়ার মরদেহ!

1178

‘ভাই, একটা লাশ নিয়ে এসেছিলাম। অনেকক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে আছি। মর্গে তালা দেওয়া, কি করবো?’ অপরপাশ থেকে উত্তর এলো- ‘আমরা তো এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবো না। আপনি অফিসে যোগাযোগ করেন।’

এভাবে একজন থেকে আরেক জনকে জিজ্ঞেস করছেন মোহাম্মাদপুর থানার কনস্টেবল রাজ্জাক। কিন্তু তার প্রশ্নের সদুত্তর মিলছে না ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের কারো কাছেই। উপায় না দেখে ঢামেক জরুরি বিভাগের মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনিসহ তার দুই সহকর্মী পুলিশ কনস্টেবল। বুধবার (০৭ ডিসেম্বর) দিনগত মধ্যরাতে সরেজিমনে ঢামেক হাসপাতালে গিয়ে এমন দৃশ্যই চোখে পড়ে।

এদিকে, জরুরি বিভাগের গেটের সামনে পুলিশের গাড়িতে নিথর দেহ পড়ে আছে ১১ বছর বয়সী শিশু সিনথিয়ার। বুধবার (০৭ ডিসেম্বর) রাতে মোহাম্মাদপুরের রাজারবাগের একটি বাড়ি থেকে তার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

পুলিশ জানায়, সিনথিয়ার বাবা চায়ের দোকানদার। বাবা-মা দুজনেই বাইরে থেকে দরজা আটকিয়ে কাজে গিয়েছিলেন। পরে বাড়িতে ফিরে মেয়ের ঝুলন্ত মরদেহ দেখতে পান।

পুলিশ কনস্টেবল নাসের জানান, খবর পেয়ে আমরা গিয়ে মরদেহটি উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসি। মরদেহের সুরতহালও করি। কিন্তু এখানে এসে তো দেখছি বিপদেই পড়লাম। মর্গে কেউ নেই। যার কাছেই জিজ্ঞেস করছি, কেউ ঠিক মতো বলতে পারছে না মর্গের ইনচার্জ কোথায় গেছেন?

ঘড়িতে তখন রাত ১টা। তখনও এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করছেন সিনথিয়ার মরদেহ বহনকারী গাড়িসহ তিন পুলিশ সদস্য। উদ্দেশ্য মরদেহটি রাতের জন্য ঢামেক জরুরি মর্গে রাখা। কিন্তু লোক কোথায়? কার কাছে রাখবে এই মরদেহ?

প্রায় ঘণ্টাখানেক পায়চারীর পর জরুরি বিভাগে দায়িত্বরত এক নার্সের কাছে তথ্য মিললো মর্গের প্রধান অফিসের সঙ্গে যোগোযোগ করার। খু‍ঁজে পাওয়াও গেলো মর্গ অফিস। কিন্তু সেখানেও যে ঝুলছে তালা। এখন উপায়?

তিন পুলিশ সদস্য আবারও ঘুরে ফেরত গেলেন ওই নার্সের কাছে। মর্গ তালা দেওয়‍া শ‍ুনে নার্সের খুব স্বাভাবিক ভঙ্গি। ভাব-ভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন এর চেয়ে বেশি তিনি কিছুই করতে পারবেন না।

মর্গের কারো মোবাইল নম্বর আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি দেখিয়ে দেন আরেক ডাক্তারকে। ডাক্তারের কাছ থেকে নম্বর নিয়ে কল দেওয়া হলো মর্গের দায়িত্বে থাকা বাবু মিয়াকে। প্রথম কলেই রিসিভ করলেন ‍বাবু।

এপাশ থেকে পুলিশ কনস্টেবল রাজ্জাকের আকুতি, ‘ভাই একটা লাশ নিয়ে আসছিলাম। যদি একটু রাখা যেত।’

ওপাশ থেকে বাবু মিয়ার জবাব এলো, ‘আমি কাছেই আছি। আপনি অফিসে দাঁড়ান, আসছি।’

তার কয়েক মিনিট পর দেখা মিললো বাবু মিয়ার। তবে সুরতহাল দেখে তিনি জানালেন, ‘এ লাশ আমি রিসিভ করতে পারবো না। আপনারা কষ্ট করে জরুরি মর্গের ইনচার্জ সেকেন্দারকে ফোন করুন।’

পরে কথা হলো সেকেন্দারের সঙ্গে। তিনিও অপেক্ষায় রাখলেন এই তিন পুলিশকে। পুলিশের গাড়িতে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে সিনথিয়ার নিথর মরদেহ। কিন্তু মর্গে আর ঠাঁই মিলছে না। এ তো গেলো এক সিনথিয়ার মরদেহ নিয়ে বিড়ম্বনা আর ভোগান্তির গল্প। কে জানে, এমন অবহেলায় আর কত সিনথিয়াদের মরদেহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকতে হয়, বিড়ম্বানা আর ভোগান্তিতে প্রহর গুণতে হয়।

অবশ্য শেষ পর্যন্ত আরও কয়েক ধাপ হয়রানির পর ওই তিন পুলিশ সদস্য সিনথিয়ার মরদেহ ঢামেক মর্গে রাখতে পেরেছিলেন।