নন্দিত সঙ্গীতশিল্পী জুনায়েদ জামশেদ আর নেই

832

আজ পাকিস্তানের স্থানীয় সময় বিকেল চারটে ৪০ মিনিটে একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হয়েছে ৪৭ আরোহী৷ চিত্রলা থেকে ইসলামাবাদে যাবার কালে মর্মান্তিক এই ঘটনাটি ঘটে। ওই বিমানে বিশ্বখ্যাত জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী জুনায়েদ জামশেদ স্বপরিবারে অবস্থান করছিলেন৷ বিমানের অন্যান্য আরোহীর সঙ্গে স্বপরিবারে ইন্তেকাল করেন তিনি (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজিউন)৷

পাকিস্তানের সামা টিভির নিউজসূত্রে জানা যায়, স্ত্রী নেহা জুনায়েদসহ তার পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য তার সঙ্গে বিমানটিতে আরোহী ছিলেন৷ এদিকে পাকিস্তানের জাতীয় ইংরেজি দৈনিক ‘ডেইলি পাকিস্তান’ ঘটনাটির সত্যতা নিশ্চিত করেছে৷

১৯৬৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের করাচিতে তার জন্ম৷ বাবা জামশেদ আকবর খান ও মা নাফিসা আকবরের ৩ ছেলে ১ মেয়ের মাঝে তিনি ছিলেন সর্বপ্রথম৷ তার ভাইদের নাম হুমায়ুন জামশেদ, ওমর জামশেদ৷ আর বোনের নাম মুনিজা জামশেদ৷ তিনি ১ ছেলে ১ মেয়ের জনক ছিলেন৷ মেয়ের নাম আয়েশা জুনায়েদ৷

বিমানবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জামশেদের ছেলে জুনায়েদ লাহোরের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ গ্রাজুয়েশন করেন৷ এরপর শখের বশেই রাহেল হায়াত ও শাহজাদ হাসানের সঙ্গে ১৯৮৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের ৪০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে দেশাত্মবোধক গান ‘দিল দিল পাকিস্তান’ গাওয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন দেশের প্রথম পপ ব্যান্ড ‘ভাইটাল সাইন’৷

তাদের প্রথম হিট এ্যালবাম ‘দিল দিল পাকিস্তান’ এনে দেয় আকাশচুম্বী খ্যাতি।

এই গানটিই ঘুরিয়ে দেয় তার জীবনের মোড়৷ পরিণত করে একজন শৌখিন সংগীতশিল্পী থেকে পেশাদার শিল্পীতে।বিমানবাহিনীতে যোগ দিতে ব্যর্থ হয়ে জুনায়েদ একজন পেশাদার প্রকৌশলী হতে চেয়েছিলেন৷ সংগীতটা আরম্ভ করেছিলেন অনেকটা শখের বশেই। কিন্তু এই প্রাথমিক সফলতার ফলে রাহেল ও সাজ্জাদ তাকে প্রেরণা যোগান। বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় এ্যালবাম বেরোবার পর ১৯৯৫ সালে যখন ব্যান্ড ভেঙে যায়, জুনায়েদ জামশেদ তখন একক ক্যারিয়ার গড়তে আরম্ভ করেন। এতেও তিনি অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করেন৷ পাকিস্তানের প্রথম পপস্টার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন নিজেকে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের সংগীত ‘কসম উস ওয়াক্ত কি’, পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সংগীত ‘পালাটনা ঝাপাটনা’তে শিল্পী হিসেবে নির্বাচিত করে তাকেই। এছাড়াও নন্দিত রেকর্ড নির্বাহী ও প্রযোজক শোয়েব মনসুর তার পিটিভি সঙ্গীতস্টুডিও’র সঙ্গে একটি রেকর্ডচুক্তি করেন৷

জনপ্রিয়তায় যখন তুঙ্গে এবং একের পর এক হিট এ্যালবাম বেরোচ্ছে, তখনই হঠাৎ সঙ্গীত ছেড়ে দেবার ঘোষণা দেন তিনি। ২০০২ সালে সংবাদ সম্মেলন করে জানান এই খবর৷ তখন সংগীতাঙ্গনে নেমে আসে শিল্পীবিয়োগে তুমুল ঝড়৷ অসংখ্য ভক্ত তাদের প্রিয়শিল্পীকে হারানোর খবরে হয়ে পড়ে বেদনাহত। শেষমেষ ২০০৩ সালের ১৪ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে সংগীতজগতকে বিদেয় জানান তিনি৷

জুনায়েদ জামশেদ ছিলেন পাকিস্তানের জনপ্রিয় রেকর্ডিংশিল্পী, টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব, ফ্যাশন ডিজাইনার, অনিয়মিত অভিনেতা এবং গীতিকার। UET Lahore থেকে প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রী নেবার পর বাদ্যযন্ত্র কর্মজীবনের ওপর মনোযোগ দেবার আগে জুনায়েদ সংক্ষিপ্তভাবে একটি বেসামরিক PAF ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেন।

১৯৮৩ সালে রাহেল হায়াতের কাছ থেকে নির্দেশনা পাবার আগে তিনি বিভিন্ন স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে সঙ্গীতানুষ্ঠান করতেন। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের হায়াত ও নুসরাত হোসেন তাকে বেশ সাহায্য করেন৷

প্রথম Vital Signs গায়ক ভোকালিস্ট হিসেবে দেশব্যাপী প্রাধান্য ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেন তিনি৷ এ্যালবামটি ১৯৮৭ সালে বেরিয়ে বেশ সাড়া ফেলে শ্রোতামহলে৷

তার সেই এ্যালবামটি দেশের সঙ্গীত চ্যানেল তালিকার শীর্ষস্থান দখল করে নেয়৷ ‘দিল দিল পাকিস্তান’ এবং ‘তুম মিল গায়ে’ তার বেশ জনপ্রিয় সঙ্গীত হিসেবে খ্যাতি পায় সেকালে। তার সেই প্রথম এ্যালবামটি বাণিজ্যিক সাফল্যে পাকিস্তানের রক-সঙ্গীতশিল্প বিকাশে যথেষ্ট সাহায্য করে।

‘দিল দিল পাকিস্তান’ গাওয়ার মাধ্যমে যেমন সঙ্গীতজীবন আরম্ভ করেছিলেন, ঠিক তেমনই একই গানের মাধ্যমে সঙ্গীতজীবনের পরিসমাপ্তিও ঘটান। মেধাবী এই শিল্পী তার ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ শেখরে অবস্থান করে খ্যাতি ও ভবিষ্যতের বদলে ইমানকে বেছে নেন।

এই নাটকীয় পরিবর্তনের পর এই বদলের সিদ্ধান্তগ্রহণে তার কোনো আফসোস হয়নি আজ অবধি৷ তিনি বলতেন, ‘আমার আগের জীবনযাপনের কোনো দৃষ্টিভঙ্গি এখন আর অবশিষ্ট নেই। আমার নতুন জীবন খুব সরল, পবিত্র এবং সুন্দর। আমি অনুভব করি, আপনি আপনার জীবনেও আল্লাহর হুকুম ও রাসুলের তরিকার ওপর আমল করেন৷ তাহলে দুনিয়াতেই আপনার জীবন জান্নাতে পরিণত হবে। ‘

১৯৮৩ সাল থেকে ২০০৪ সাল অবধি তিনি পাকিস্তানের পপ রকসম্রাট ছিলেন৷ ১৯৮৭ সাল থেকে ২০০৪ সাল অবধি পাকিস্তানের পপ গীতিকার, সুরকার হিসেবেও কাজ করেন৷ পরিশেষে ২০০২ সাল থেকে মৃত্যু অবধি উর্দু গজল, হামদ-নাতের বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী হিসেবেও শ্রোতাদের মনের কাবায় ভালোবাসার স্থান লাভ করেন৷

তার বিখ্যাত এ্যালবামের মাঝে ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত ‘উস রাহ পর’, ১৯৯৩ সালে ‘মেরা দিল’, ২০০৫ সালে ‘মুহাম্মদ কা রওজা’ ও ‘জালওয়া-ই জানান’, ২০০৬ সালে ‘মেহবুবে ইয়াজদান’, ২০০৮ সালে ‘ইয়াদে হারাম’, ২০১২ সালে ‘দিল দিল পাকিস্তান’ এবং ২০১৬ সালে ‘উম্মাতি’ উল্লেখযোগ্য৷ তার গাওয়া সঙ্গীতের সংখ্যা কয়েক শতাধিক৷