ট্রমার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে দীপন ও টুটুলের পরিবার

592

তদন্ত বা বিচারের জন্য নয়, অপেক্ষা করছি এমন একটি ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের জন্য, যেখানে মুক্তবুদ্ধি চর্চা করা যাবে।’ এ কথাগুলো বললেন জঙ্গিদের হামলায় মৃত্যু থেকে বেঁচে যাওয়া প্রকাশক আহমেদুর রশিদ চৌধুরী টুটুল। তার স্ত্রী শামিম রুনার ভাষ্য, ‘আমাদের জীবন যে ছকে বাঁধা ছিল মুহূর্তে তা পাল্টে গেছে। এই বয়সে নতুন করে প্রথম থেকে শুরু করা মানসিক এবং শারিরীকভাবে নিতে পারছি না।’

জঙ্গিদের হাতে নিহত ফয়সাল আরেফীন দীপনের স্ত্রী ডা. রাজিয়া রহমান বলেন, ‘জাতীয় স্বার্থেই এ ধরনের সকল হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার হওয়া প্রয়োজন।’ তিনি দীপনের খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করেন।

গত বছরের ৩১ অক্টোবর রাজধানীর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলার নিজ কার্যালয়ে জঙ্গিদের হাতে নির্মমভাবে খুন হন প্রকাশক ফয়সাল আরেফীন দীপন।একইদিনে রাজধানীর লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর মালিক আহমেদুর রশিদ চৌধুরী টুটুল, তার বন্ধু তারেক রহিম ও রন দিপম বসুকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা চালায় দুর্বৃত্তরা। কিন্তু গত এক বছরেও এ দু’টি মামলার অভিযোগপত্র দিতে পারেনি পুলিশ। মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খুব শিগগির এ মামলার চার্জশিট দেওয়া হবে। এ নিয়ে তারা কাজ করে যাচ্ছেন। এদিকে ট্রমার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে দীপন ও টুটুলের পরিবার।

জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক প্রকাশক ফয়সাল আরেফীন দীপন হত্যাকারীরা সকলেই চিহ্নিত। গ্রেফতারের পর আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের দুই জঙ্গি এ হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছে। পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে এক জঙ্গি। প্রকাশক দীপন হত্যা ও টুটুল হত্যা চেষ্টা মামলার তদন্তে সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক ড.অভিজিৎ রায়ের একাধিক বই প্রকাশিত হয়েছিল দীপনের মালিকানাধীন জাগৃতি প্রকাশনী থেকে। সে কারণে অভিজিতের খুনিচক্র তাকেও হত্যা করে। টুটুল ও তার দুই বন্ধুকে হত্যাচেষ্টাকারীরাও একইচক্রের সদস্য। গত ২৩ আগস্ট টঙ্গী এলাকা থেকে মইনুল ইসলাম শামীম ওরফে সিফাত ওরফে ইমরান নামে আনসারুল্লাহর এক জঙ্গি সদস্যকে গ্রেফতার করেন গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা। এরপর তাকে ছয় দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। রিমান্ডে থাকা অবস্থায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার আগ্রহ দেখালে তাকে ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজির করা হয়। সেখানে সিফাত দীপন হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়।

আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তি ও পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জঙ্গি সিফাত জানায়, সে আনসার আল ইসলামের একজন ‘মাসুল’। কোনও হত্যাকাণ্ড বাস্তাবায়ন করতে আনসারুল্লাহর পক্ষ থেকে যে দলটিকে প্রস্তুত করা হয়, তার দায়িত্বে যে থাকে তাকে ‘মাসুল’ বলা হয়। দীপন হত্যা ও টুটুল হত্যাচেষ্টার ঘটনায় সে ‘মাসুল’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। অভিজিৎ হত্যাসহ আরও কয়েকটি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয় সিফাত। সে ছাড়াও এ মামলায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে মো. আবদুস সবুর ওরফে আবদুস সামাদ ওরফে সুজন ওরফে রাজু ওরফে সাদ। সেও জবানবন্দিতে টুটুলকে হত্যাচেষ্টা ও দীপন হত্যার পরিকল্পনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছে। পরিকল্পনার তথ্য জানালেও সে নিজে দু’টি ঘটনার সময় উপস্থিত ছিল না বলে দাবী করে।

সিফাত ও সাদ ছাড়াও এ দু’টি ঘটনায় আনসারুল্লাহর আরও দুই সদস্যকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। তারা হচ্ছে, মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত ওরফে সামির ওরফে ইমরান ও মো. রশিদ উন নবী ভূঁইয়া টিপু। তাদেরও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু তারা কোনও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এখনও দেয়নি। তবে গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন,গ্রেফতারকৃতরা সবাই দীপন হত্যা ও টুটুল হত্যাচেষ্টাসহ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।

দু’টি ঘটনার তদন্তের সর্বশেষ অগ্রগতির প্রতিবেদনে মামলার রহস্য উদঘাটিত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, যে জঙ্গি সংগঠন এ হত্যাকাণ্ড ও হত্যার চেষ্টা করেছে, সেই জঙ্গি সংগঠন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেছে। উক্ত জঙ্গি সংগঠনের সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এসব ঘটনার প্রধান আসামিদের মধ্যে শরিফুল ওরফে সাকিব ওরফে শরিফ ওরফে সালেহ ওরফে আরিফ ওরফে হাদী-১ ওরফে মুকুল রানা গত ১৯ জুন পুলিশের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ শাখার উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রকাশক দীপন ও টুটুলকে একই গ্রুপ দুই ভাগে ভাগ হয়ে হত্যার জন্য অপারেশন চালায় বলে তদন্তে উঠে এসেছে। লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশের জন্য দুই প্রকাশককে হত্যার মিশনে নেমেছিল আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যরা।’ তিনি বলেন, ‘এই দুটি ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে। যে কোনও সময় আদালতে মামলা দুটির অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।

মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মাশরুকুর রহমান খালেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তদন্তে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। দু’টি মামলায় দু’জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। জবানবন্দিতে তারা বিস্তারিত তথ্য দিয়েছে।তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া অন্যদের গ্রেফতারে অভিযান চালানো হচ্ছে। খুব শিগগির এ দু’টি মামলার তদন্ত শেষে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।’

দীপন হত্যা ঘটনায় তার স্ত্রী ডাক্তার রাজিয়া রহমান বাদী হয়ে রাজধানীর শাহবাগ থানায় গত বছরের ২ নভেম্বর একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটি প্রথমে শাহবাগ থানা পুলিশ তদন্ত করলেও পরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তদন্তের জন্য হস্তান্তর করা হয়। গোয়েন্দা পুলিশের ইন্সপেক্টর ফজলুর রহমান মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন।

অন্যদিকে, টুটুল ও তার দুই বন্ধুকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় তিনি নিজেই বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় একইদিনে মামলা দায়ের করেন। এ মামলাটিও প্রথমে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ তদন্ত করে। গোয়েন্দা পুলিশে মামলাটি তদন্তের জন্য হস্তান্তর করার পর তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় মো. বাহাউদ্দিন ফারুকীকে।

এর আগে গত মে মাসে ব্লগার, লেখক ও প্রকাশক হত্যাকারীদের ধরিয়ে দিতে প্রত্যেকের জন্য দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত পুরস্কার ঘোষণা করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। দীপন হত্যা ও টুটুল হত্যাচেষ্টায় গ্রেফতার ও বন্দুকযুদ্ধে নিহত দু’জনের বিরুদ্ধেও পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। বন্দুকযুদ্ধে নিহত শরিফকে ধরিয়ে দিতে পাঁচ লাখ টাকা এবং আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া সাদকে ধরিয়ে দিতে দুই লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল।

ফয়সাল আরেফীন দীপনের স্ত্রী ডা. রাজিয়া রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দু’দিন আগে গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে দীপন হত্যা মামলার অগ্রগতি জানানো হয় তাকে। তিনি বলেন, ‘জাতীয় স্বার্থেই এ ধরনের সকল হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার হওয়া প্রয়োজন।’ তিনি দীপনের খুনিদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি দাবী করেন।

সুস্থ হওয়ার পর দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে ঘটনার কিছুদিনের মধ্যে নরওয়ে চলে যান আহমেদুর রশিদ চৌধুরী টুটুল। এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নরওয়েতে অবস্থানরত টুটুলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কোনও প্রতিক্রিয়া নাই। অপেক্ষা আছে। তদন্ত বা বিচারের জন্য না। মুক্তবুদ্ধি চর্চা করা যাবে, নির্বিঘ্নে এমন একটি ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের জন্য।’

টুটুলের ওপর হামলার বিষয়ে তার স্ত্রী শামিম রুনা বলেন, ‘আরও খারাপ কিছু হতে পারত। আমাদের পুরো জীবন বদলে দিয়েছে। আমাদের জীবন যে ছকে বাঁধা ছিল মুহূর্তে তা পাল্টে গেছে। এই বয়সে নতুন করে প্রথম থেকে শুরু করা মানসিক এবং শারীরিকভাবে নিতে পারছি না। টুটুল এখনও পুরোপুরি সুস্থ্ হয়নি। ট্রমার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। ওর দিকে তাকালে অনেকগুলো হারিয়ে যাওয়া মুখ আমার চোখের সামনে দেখতে পাই। এই অনুভূতি কাউকে বোঝানো যায় না। তারপরও ও বেঁচে আছে, এটাই আমাদের বড় পাওয়া।’

টুটুলের স্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা কোনোও মামলা করিনি (যদিও পুলিশ রাত দুইটায় হাসপাতালের কেবিনে এসে ঘুম ভাঙিয়ে টুটুলের স্বাক্ষর নিয়েছিল)। তাই মামলা চালানোর প্রশ্নই আসে না। আমরা চাই, স্বাভাবিক পরিবেশ। অসাম্প্রদায়িক, মুক্তচিন্তার বাংলাদেশ।’