স্বপ্ন বাস্তবায়নের আতুর ঘর কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

2421

মার্জিয়া সুলতানা

লাল মাটির ছোট ছোট পাহাড়। পাহাড়ের চারদিকে সবুজ গাছ-গাছালি। এটা তার চিরস্থায়ী সাজ হলেও একেক ঋতুতে একেক সাজেই যেন তার স্বকীয়তা। শরতের সাদা শাড়ি পরে আর মেঘের ভেলায় উড়তে দেখা যায় তাকে! আবার গ্রীষ্মে কৃষ্ণচূড়ার লাল শাড়িতে নববধূ বেশে ধরা দেয়। বর্ষায় ভেজা শাড়িতে তার যৌবন যেনো বহুগুণ বেড়ে যায়! প্রকৃতি যেনো স্ব-মহিমায় সাজিয়েছে তাকে। এ রূপ শুধু শিক্ষক , শিক্ষার্থীদেরকে মুগ্ধ করে না। এ রূপ দেখতে ছুটে আসে দেশি-বিদেশি নানা পর্যটকও।
বলছিলাম লালমাই পাহাড়ের পাদদেশে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে দেশের অন্যতম বিদ্যাপীঠ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা।
কুমিল্লার ঐতিহাসিক কোটবাড়ি এলাকায় অবস্থিত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। লাল মাটির পাহাড়ে সবুজের আচ্ছাদনে গড়ে উঠা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও রয়েছে। প্রায় ১৩০০ বছর পূর্বে চন্দ্র বংশীয় রাজা ভবদেব শালবন বিহার প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময় বিহারকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা দান করা হতো। আর শালবন বিহার ছিলো তখনকার সময়ে এশিয়ার অন্যতম বিদ্যাপীঠ।
একপাশে শালবন এবং বৌদ্ধ বিহার। একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠার জন্য এরচেয়ে ভালো জায়গা বোধহয় আর হয় না। তাইতো অনেক স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।
এই ঐতিহাসিক শিক্ষার স্থানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য এ অঞ্চলের মানুষ রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে। ২০০৬ সালের ২৭ মে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হলেও ২৬ তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এর কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৭ সালের ২৮ মে। এ বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে সাতটি বিভাগ , ৩০০ জন শিক্ষার্থী এবং ১৫ জন শিক্ষক নিয়ে। সাফল্যের ১৪ বছরে পদার্পণের পর আজ এর বিভাগ সংখ্যা ১৯ টি এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় সাত হাজার।
১৪ বছরের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেব কষতে গেলে দেখা যায় প্রাপ্তির থলেই পরিপূর্ণ। অপ্রাপ্তি কিছুটা থাকলেও উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে এই লাল মাটির সবুজ ক্যাম্পাস। এখানে অধ্যায়নরত এবং প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা দেশ-বিদেশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করছে বিভিন্ন গবেষণামূলক কাজে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন খাতে অবস্থান করছে এখানকার শিক্ষার্থীরা এবং এ বিশ্ববিদ্যালয়র পরিচিতি ফুটিয়ে তুলছে।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এমরান কবির চৌধুরীর হাত ধরে গতবছর অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় কুবির উন্নয়নে ১ হাজার ৬৫৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকার মেগা প্রকল্প পাশ হয়। যা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যাবতীয় স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ বলেই বিবেচিত হয়।
আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চ নিয়ে যেই দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিলো সেগুলা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য সম্প্রতি নির্মিত হয়েছে দৃষ্টিনন্দন মুক্তমঞ্চ। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টির সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান শহীদ মিনারের সৌন্দর্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরণের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে এবং সে সবের বেশিরভাগই দৃশ্যমান প্রায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও সুষ্ঠ করার লক্ষ্যে হাতে নেয়া হয়েছে দুই লেন বিশিষ্ট রাস্তার কাজ। এছাড়াও পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য প্রতিনিয়ত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে এবং সে অনুযায়ী কাজ করা হচ্ছে। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী অচিরেই বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরী হতে যাচ্ছে আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন প্রধান ফটক।

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রভাষক কাজী এম. আনিছুল ইসলাম জানান , “আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটো বিষয়ে বেশ অনুপ্রাণিত। প্রথমত ,  মাননীয় উপাচার্য স্যারের কর্মনিষ্ঠা , বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে যেতে তাঁর অদম্য ইচ্ছা , স্বপ্ন এবং সেই অনুযায়ী তাঁর দিক নির্দেশনা ও কাজ , সত্যি বলতে শুরু থেকেই আমাকে বেশ অনুপ্রাণিত করে চলেছে।

তিনি আরও বলেন,
অসম্ভব রকমের মেধাবী ও প্রতিভাবান শিক্ষার্থীদের কাজ আমাকে সবচেয়ে বেশি উৎসাহিত করে। আমি তাদের দেখে এক ধরনের মানসিক শক্তি পাই। তাঁদের স্বপ্নগুলো আমাকে এত বেশি স্পর্শ করে যে , আমার গতিকে দ্বিগুণ করে দেয়। আমি নিজেও এখন আরো অনেক দূর যাওয়া ও নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। আমার বিশ্বাস , এভাবে সঠিক দিক নির্দেশনার মাধ্যমে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী  এক সঙ্গে কাজ করলে এ অঞ্চলের অন্যতম এক সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হবে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।”
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী অর্ক গোস্বামী বলেন , “দেশের ২৬তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হাঁটি হাঁটি-পা পা করে ১৩টি বসন্ত কাটিয়ে এখন ১৪তে। ১৩বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয় স্বপ্ন দেখতে শিখাচ্ছে যেমন , আবার ভালোবাসাও পাচ্ছে এর বুকে বেড়েওঠা  স্বপ্নবাজদের। আমরা যারা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছি , আমাদের কাছে এটা স্বপ্নপূরণের আতুরঘর। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১৩ বছর অতিক্রম হয়ে গেলেও নানা প্রাপ্তির মধ্যে এখনও রয়ে গেছে কিছু সীমাবদ্ধতা। তবে আমরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুকেও ১৮ নেমে আসবে।বর্তমানে যে প্রত্যাশা গুলো ধরা দিচ্ছে দিচ্ছে করেও দিচ্ছেনা , তা অচিরেই ধরা দেবে।
তবে একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যে শুধু আপনাকে সবকিছু উজার করে দিয়েই যাবে তা কিন্তু নয়। আপনারও কিছু দায়িত্ব রয়েছে , রয়েছে কিছু দায়বদ্ধতা। সেই দায়িত্ব এবং দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে আমি মনে করি সবাইকেই কাজ করা উচিত এই বিশ্ববিদ্যালয়কে সমৃদ্ধ করার জন্যে। আর এক্ষেত্রে আপনাকে সহায়তা করবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা সংগঠন। একজন নাট্যকর্মী হিসেবে আমি মনে করি সমাজের যে অসংগতি আপনার চোখে পড়বে তার প্রতিবাদ আপনি যদি খালি গলায় নাও করতে পারেন , আপনি তা করতে পারবেন নাটকের মাধ্যমে।বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে জানান দিতে পারবেন যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ও এগিয়ে যাচ্ছে সমান তালে। জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতেও এর ভূমিকা অপরিসীম। আমি মনে করি , আমরা যদি সচেতন হই আর অন্যের অপকার না করি তাহলেই কিন্তু একটি সুন্দর দেশ উপহার দেয়া সম্ভব।”

কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী নাজমুল হাসান পলাশ বলেন , “প্রতিষ্ঠার এই ১৩ বছরে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজকের এই অবস্থানে এসে পৌঁছেছে আমাদের স্বপ্নের কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটা অংশ আমাদের স্মৃতির পাতায় সঞ্চিত থাকবে আজীবন। সকল সম্ভাবনার দুয়ার খুলে এগিয়ে যাবে প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয় এই প্রত্যাশা থাকবে সবসময়।”
এই বিশ্ববিদ্যালয় সত্যিই একখন্ড উর্বর জমি যেখানে তরুণ-তরুণীরা স্বপ্ন বপন করে। স্বপ্নের বৃদ্ধি এই উর্বর জমিতেই হয়। এই স্বপ্নেরা যেদিন আকাশ ছোঁয় সেদিন হয়তো তার স্বার্থকতা।
কাজী নজরুল ইসলাম হল , শহীদ নীরেন্দ্রনাথ দত্ত হল , বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল এবং নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী হল যেনো বসবাসরত প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীর দ্বিতীয় পরিবার। স্বপ্নের লাল বাস , নীল বাস , লালন চত্বর , বাবুই চত্বর , সানসেট ভ্যালী , শহীদ মিনার , সংযোগ সেতু , ভিসির টং , নবী মামার চায়ের দোকান সবই যেনো শিক্ষার্থীদের প্রাণের জায়গা! আড্ডায় মুখরিত এ স্বপ্নের জায়গাগুলো ছেড়ে কেউ হয়তো যেতে চাইবে না। কিন্তু বাস্তবতার তাগিদে তাকে যেতেই হয়। প্রাক্তন হয়ে গেলেও এ জায়গাগুলোতে তার অস্তিত্ব মিশে থাকে এবং তার অস্তিত্বে মিশে থাকে জায়গাগুলো।
প্রাপ্তি – অপ্রাপ্তির ১৪ বছরের এই ছোট্ট বিশ্ববিদ্যালয় একটু একটু করে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁ


ছাবে সেটাই সকলের চাওয়া। একদিন বিশ্বের অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একটি হবে এই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় এ শুভকামনা যেন প্রত্যেক কুবিয়ানদের মন থেকেই এসেছে। কুবিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার ক্ষেত্রে সকল শিক্ষক , কর্মকর্তা , কর্মচারী এবং শিক্ষার্থীরা যেনো একই সূত্রে বাধা!

মার্জিয়া সুলতানা, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়