রাজনীতিকে ইবাদত মনে করি —মাওলানা আফেন্দী

1630

রাজনীতিকে ইবাদত মনে করে রাজপথের মিছিলে নাম লিখিয়েছেন তিনি। কেবলই ক্ষমতায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে তার রাজনীতি নয়। বরং রাজনীতির মাধ্যমে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন চান তিনি। তিনি চান, ইসলামের আদর্শে প্রতিটি মানুষ যেমন আলোকিত হবে, তেমনি সমাজ থেকে দূর হবে অন্যায়, অবিচার আর বৈষম্য। স্রোতের বিপরীতের রাজনীতি করা এ মানুষটি পুরান ঢাকার বিখ্যাত কওমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগের প্রিন্সিপাল ও শায়খুল হাদিস আলহাজ্ব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী। উপ-মহাদেশের প্রাচীন ইসলামিক রাজনৈতিক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর সভাপতি তিনি। এখন– এর কাছে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে মাওলানা আফেন্দী নিজের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের কথা বলার পাশাপাশি সমকালীন রাজনৈতিক প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্টাফ রিপোর্টার হাসান ওয়ালী

এখন: আপনার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার অনেকদিনের। কিন্তু প্রচলিত রাজনীতির বাইরে ইসলামি রাজনীতির সঙ্গে কেন জড়ালেন?
মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী: ইসলামী রাজনীতিতে আসার প্রধান কারণ হচ্ছে, এটাকেও আমরা ইবাদত মনে করি। জনসেবা, মানবসেবা, আর্ত-মানবতার সেবা, অসহায় মানবতার পাশে দাঁড়ানো ইসলামের এক মহান শিক্ষা। এটা প্রিয় নবীজি (সা.) এর অনুপম চরিত্রের একটি অনুপম বৈশিষ্ট্য। এই অঙ্গণে আমরা সম্মিলিতভাবে, ব্যক্তি উদ্যোগে আমাদের সাধ্যমত কাজ করে যাচ্ছি। আমরা মনে করি, রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হলে, আমাদের এই সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌছে দেওয়া আরো সহজ হবে। মূলত এই উদ্দেশ্যেই ইসলামি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়া। আমরা বিশ্বাস করি, এটাই রাজনীতি করার প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।

IMG_8350 copyএখন: আপনি একজন শায়খুল হাদিস, প্রিন্সিপাল ও খতিব। এতোসব কাজের ফাঁকেও রাজনীতিতে সময় দেয়ার মতো অনুপ্রেরণা কোথায় পান?
আফেন্দী: মূল অনুপ্রেরণা কুরআনে কারীম থেকেই পেয়েছি। যখন কুরআন পড়ি তখন দেখতে পাই, কুরআনে এমন কিছু বিধান আছে যেগুলো আলোর মুখ দেখতে হলে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রয়োজন। এছাড়াও দেশের একটা বৃহৎ অংশ, বিশেষ করে আমার জন্মস্থান উত্তরবঙ্গেও অনেক মানুষ এখনও দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে। এইসব মানুষের পাশে দাঁড়ানো, তাদের জন্য কিছু করার ইচ্ছাই রাজনীতিতে আমার অনুপ্রেরণা।

এখন: দেশে এখন অনেকগুলো ইসলামি দল। কওমি মাদরাসা কেন্দ্রীক আরও কয়েকটি দলের কার্যক্রম আছে। আপনি কেন জমিয়তে উলামাকে বেছে নিলেন?
আফেন্দী: জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম করি, কারণ এটি একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী, ইতিহাস গাঁথা সংগঠন। উপমহাদেশে ইংরেজ খেদাও আন্দোলন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সবআন্দোলনে এই সংগঠনের ভূমিকা আছে। আলেম-উলামাদের অনেকেই এ সংগঠন করেছেন এবং এখনও করছেন। অভিজ্ঞ ইসলামি চিন্তাবিদ ও রাজনীতিবিদের দল এটি। জমিয়ত বেছে নেয়ার এটাই কারণ।

এখন: বর্তমান সময়ে ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতিই সবাই করছে। আপনি বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
আফেন্দী: এখানে দুইটা দৃষ্টিভঙ্গি আছে। একটি হলো ইসলামে রাজনীতির কোন স্থান নেই এবং অপরটি হচ্ছে- রাজনীতি মানেই ক্ষমতায় যাওয়া। আমরা এই দুই দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধী। সুতরাং যারা বলে ইসলামে রাজনীতির কোন স্থান নেই এবং যারা বলে রাজনীতি করা মানেই ক্ষমতায় যেতে হবে, উভয়ই ভুলের মধ্যে আছে বলে আমরা মনে করি। আমরা ইবাদতের জন্যই রাজনীতি করি।

এখন: বিগত সময়ে আপনার দলও তো ক্ষমতার অংশীদার ছিলো…।
আফেন্দী: হ্যাঁ, ছিলো। তবে শুধু এই উদ্দেশ্যেই আমরা রাজনীতি করিনা। আমাদের রাজনীতির উদ্দেশ্য সম্পর্কে আগেই বলেছি। আবারও বলছি, ইসলামের আদর্শে ধারণ করে একটি সুন্দর, বৈষম্যহীন সমাজ গঠন করতে চাই আমরা।

এখন: আলেমদেরকে আমরা জাতীয় পর্যায়ে নেতা হতে কম দেখি। এটা কি আলেমদের ব্যর্থতা?
আফিন্দি: হ্যাঁ। এটাকে ব্যর্থতা বলে স্বীকার করতে হবে। এর পেছনে কারণ হলো দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা। এখানে ঐক্যের একটা বিশাল অভাব রয়েছে। ঐক্য না থাকায় ইসলামি দলগুলোর অধিকাংশ নেতারা রাজনৈকিভাবে তেমন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যেতে পারেননি।

IMG_8345 - Copy (2) copyএখন: আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোকে আরো শক্তিশালী হওয়ার কথা ছিলো না?
আফেন্দী: অবশ্যই। ওই যে বলেছি- ঐক্যের অভাব। ঐক্যের অভাবে আমরা শক্তিশালী হতে পারিনি। এর দায় অবশ্য কোনো ইসলামি রাজনীতিবিদই এড়াতে পারেন না। তবে আমি মনে করি, সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রযোজন। কিন্তু ছাড় দেওয়ার মানসিকতার অভাবে এটা সম্ভব হচ্ছে না। সেইসঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন প্রয়োজন। ঐক্য থাকলে বাংলাদেশের আলেমদের মতো শক্তিশালী আর কেউ হতে পারতো না।

এখন: আপনি তো দীর্ঘদিন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। দলের কী কী দায়িত্ব পালন করেছেন?
আফেন্দী: ছাত্রাবস্থায় আমার রাজনীতি শুরু। আমি ছাত্র জমিয়তের প্রতিষ্ঠাকালীন ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি ছিলাম। অনেকদিন ছাত্র জমিয়তের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ছাত্রত্ব শেষ করে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হই। পরবর্তীতে আমি সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব হই। বর্তমানে ঢাকা মহানগরের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছি।

এখন: জনপ্রতিনিধি হলে জনসেবা করার বেশি সুযোগ আসে। আপনার ইচ্ছা কী?
আফেন্দী: ছাত্রজীবন থেকেই মানুষের জন্য ভাল কিছু করার ইচ্ছা পোষণ করে এসেছি। এখন আমি যদি এই সুযোগ পাই, আল্লাহ তায়ালা যদি আমাকে এই সুযোগ দেন তবে আমি মানুষের সেবা করতে প্রস্তুত। মনে-প্রাণে আন্তরিকভাবে মানুষের সেবা করার প্রবল ইচ্ছা আছে। এখনও সাধ্যমতো করার চেষ্টা করি। তবে হ্যাঁ, জনপ্রতিনিধি হলে সে সুযোগ আরও অনেক বাড়বে।

এখন: দেশে নির্বাচন মানেই তো টাকার ছড়াছড়ি। এটাকে কীভাবে মোকাবেলা করবেন?
আফেন্দী: সহজ করে বললে, টাকার মোকাবেলা করার মত কোনো শক্তিই আমার নেই। আমি শুধু আমার সদিচ্ছা থেকেই নির্বাচন করতে চাই। জনগণ যদি আমাকে ভালো মনে করে তবে তারা আমাকে সে সুযোগ করে দেবে। তবে আমি মনে করি, জনগণ কাউকে চাইলে টাকার প্রয়োজন হয় না। জনগণই সেবার সুযোগ করে দেয়।

এখন: নির্বাচনের জন্য দল থেকে কি গ্রিন সিগন্যাল পেয়েছেন?
আফেন্দী: গ্রীণ সিগন্যাল কিনা জানিনা। দল থেকে তো বলা হচ্ছে মাঠে-ময়দানে কাজ করেন, প্রস্তুতি নেন।

এখন: নির্বাচিত হলে কী কী কাজ করতে চান?
আফেন্দী: জনগনের মাঝে তাদের পাওনাটা ঠিকমতো পৌছে দিতে চাই। রাষ্ট্রের কাছে যার যেটুকু প্রাপ্য সেটা তাদের মাঝে পৌছে দিতে চাই।

এখন: রাজনীতির বাইরে তো বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডও করে যাচ্ছে। সেগুলো সম্পর্কে বলুন।
আফেন্দী: সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে- আমি একটি দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করি। আমাদের মাদরাসা থেকে অগনিত ছাত্র দেশে বিদেশে মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে সামাজিকভাবে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে আমরা মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করি। যেমন- রোহিঙ্গাদেরকে —ত্রান সহায়তা দিয়েছি। এবারের বন্যায় যখন বন্যা কবলিত মানুষ গভীর বিপদে নিমজ্জিত, তখন আমরা আমাদের সাধ্যমতো ত্রাণ ও আর্থিক সহায়তা দিয়েছি। শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণও করেছি। এছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় মানুষের খাবার পানি সঙ্কট সমাধানে নলকূপ স্থাপন করেছি। আমরা আমাদের এসব সামাজিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছি।

এখন: আপনার ভালো উদ্যোগ সফল হোক। সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।
আফেন্দী: আপনাকেও ধন্যবাদ। আশা করছি, ‘এখন’ বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যবহুল সংবাদ পরিবেশন অব্যাহত রাখবে।