একশটা জীবন লাগে রবীন্দ্রনাথকে চিনতে —শ্রেয়া গুহঠাকুরতা

2261
শ্রেয়া গুহঠাকুরতা

গুনগুন করে সুর ভাঁজতেন দুই থেকে তিন বছর বয়স থেকেই। জন্মগতভাবেই যেন রক্তে মিশে গিয়েছিল গানের নেশা। তবে পরবর্তী সময়ে গানের তালিম নিয়েছেন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। গানের যাত্রা শুরু পাঁচ বছর থেকে। তিনি শ্রেয়া গুহঠাকুরতা

১৯৯৪ সালে নিজেদের সংগীতপ্রতিষ্ঠান ‘দক্ষিণী’ থেকে রবীন্দ্রসংগীতে ডিপ্লোমা করেছেন শ্রেয়া। পাঁচ বছর বয়সে অভিনয় করেন ‘দীপার প্রেম’ চলচ্চিত্রে। ১৩-১৪ বছর বয়সে তপন সিংহ পরিচালিত ‘স্বীকৃতি’ ছবিতে প্লেব্যাক করেন। শ্রেয়া গুহঠাকুরতার মূল পদচারণ ছিল মঞ্চ ও টিভিতে। তিনি ২০০৫ সাল থেকে ‘তারা মিউজিক’ টিভি অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করে আসছেন। তাঁর গানের পরিবেশনায় মুগ্ধ বাংলাদেশের কোটি কোটি শ্রোতা-দর্শক। তিনি চ্যানেল আই, মাছরাঙা, এনটিভি, আর টিভি, দেশ টিভি, এস টিভিসহ আরও চ্যানেলে সংগীত পরিবেশন করেছেন।

ছোটবেলা থেকে তিনি বেড়ে উঠেছেন সাংস্কৃতিক ও রাবীন্দ্রিক পরিবেশে। তাঁর ঠাকুরদাদা, জ্যাঠা মহাশয়সহ মা-বাবা সবাই শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি শ্রেয়া গুহঠাকুরতা, রবীন্দ্রসংগীতের জনপ্রিয় শিল্পী। ভারত-বাংলাদেশ পেরিয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় প্রবাসী বাঙালিদের কোটি কোটি হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছেন।

শ্রেয়া গুহঠাকুরতা

বাংলাদেশেও তার পরিচিতি ও জনপ্রিয়তার মাত্রাটা বিশাল। মাঝেমধ্যেই তিনি ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সুরে সুরে তুলে ধরেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিমুগ্ধ গরিমা। সম্প্রতি, জানুয়ারীর তৃতীয় সপ্তাহে ঢাকা ও শ্রীমঙ্গলে দুটি অনুষ্ঠান মাতিয়ে গেলেন শ্রেয়া গুহঠাকুরতা।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে এ শিল্পীর মুখোমুখি হয়েছিলেন এখন-এর নিজস্ব প্রতিবেদক হাসান ওয়ালী। সঙ্গে ছিলেন ফটোগ্রাফার আল নাহিয়ান

এখন : উপমহাদেশে আমরা বেশ কয়েক ধারার সঙ্গীত দেখি। রবীন্দ্রসঙ্গীতকেই কেনো বেছে নিলেন?

শ্রেয়া গুহঠাকুরতা : শান্তি নিকেতনের বাইরে রবীন্দ্রসঙ্গীতের বেড়ে উঠা আমার দাদুর হাত ধরে। রবীন্দ্রনাথের ছোট ছেলে রথীন্দ্রনাথের খুব ভালোবাসার ছিলেন আমার দাদু। শান্তি নিকেতনের বাইরে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে আমার দাদুই পপুলারাইজড করেন। তোমাদের এখানে যেমন ছায়ানট, আমার দাদুও কলকতায় প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন গীতবিতান, পরে দক্ষিণী। দক্ষিণীতে এখন আড়াই হাজার শিক্ষার্থী গান শেখে, নৃত্য শেখে। আমার পরিবারের সবাই সঙ্গীতের সাথে জড়িত। আমার মায়ের মাসি কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় , যার কাছ থেকে বন্যাদি থেকে শুরু করে অনেকেই শিখেছেন। সুতরাং এমন একটা পরিবারে জন্ম আমার যে, অন্য কোন দিকে যাওয়ার সুযোগ ছিলো না।

এখন : রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ, অনুপ্রেরণা পরিবারের থেকেই পেয়েছেন…

শ্রেয়া : একদম…একদমই তাই।

এখন : আপনি তো অনেকদিন থেকেই সঙ্গীত চর্চা করেন, রবীন্দ্রসঙ্গীতের বাইরে অন্য কোন সঙ্গীত তো গাওয়া হয়নি…

শ্রেয়া : না, রবীন্দ্রসঙ্গীতের বাইরে আসলে অন্য কোন গান গাই না। হ্যাঁ, অতুল প্রসাদ, পঞ্চকবির গান গাই। কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবেই লোকে আমাকে চেনে।

এখন : অন্য কোন পরিচয়ে পরিচিত হতে চান না?

শ্রেয়া : না, এই মুহূর্তে তো মোটেও না। কারণ সময় একদমই নেই। কারণ একটা জীবন কেনো, একশটা জীবন লাগে রবীন্দ্রনাথকে চিনতে-জানতে। সুতরাং জানার শেষ নেই। আপনাকে জানাবে না, ফুরাবে না— উনার গানের লাইন। সেরকমই আরকি।

শ্রেয়া গুহঠাকুরতা

এখন : আপনি যেরকম পরিবার থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন, আপনার ছেলে আকসানও তো রবীন্দ্রসঙ্গীতের আবহে বড় হয়েছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাতে চান?

শ্রেয়া : হ্যাঁ, তবে অনেকটা সময় যেহেতু আমার হাজব্যান্ড আমেরিকায় থাকেন। আবার আমি গান করছি গানের রেওয়াজ করছি, প্রচুর স্টুডেন্ট আছে। কিন্তু ও ভীষণ খেলা পছন্দ করে। ক্রিকেট এবং ফুটবল। তার ঐদিকে খুব নেশা দেখছি। আমার বাবার বাড়ীতেও খেলাধুলার একটা প্রচলন ছিল। আমার বাবাও ক্রিকেট খেলতেন। বেঙ্গলেও খেলতেন, ইন্ডিয়ায় খেলার মতোও তার পারদর্শিতা ছিল।

এখন : রবীন্দ্রসঙ্গীত এখন বিভিন্নভাবে গাইতে দেখা যাচ্ছে। একজন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে বিষয়টা কীভাবে দেখেন?

শ্রেয়া : আমার ফিউশনে আপত্তি নেই। ফিউশন করতে যেয়ে যেন কনফিউশন না হয়ে যাই। কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীতে অন্য কোন লাইন বসিয়ে দিল, তাতে আপত্তি আছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত পুরোনো যেরকম গাওয়া হয়েছে সেভাবেই যে চলতে হবে এরকম কোন কথা নেই। এখন মডার্ন যুগে মানুষের কাছে পৌঁছাতে গেলে আমাদেরকে তো একটু ওপেন হতেই হবে। কিন্তু বিক্রি হবে দেখে সস্তা কিছু করার আপত্তি আমি করি।

এখন : আমাদের এখানেও বিভিন্ন ব্যান্ড নতুনভাবে করার চেষ্টা করেছিল…

শ্রেয়া : হ্যাঁ, আমার কাছে মনে হয় পপুলার মিউজিক একরকম এবং ক্ল্যাসিকাল মিউজিক আরেকরকম। দু’টো একদম সম্পূর্ণ ভিন্ন। ক্ল্যাসিকাল মিউজিক যারা ভালোবাসে তারা একটা দল, একটু মডার্ন এক্সপেরিমেন্টাল কাজ ভালোবাসে অন্য দল। আমি দু’রকমই শুনি। মিউজিকটা ভালোবাসি। কেউ যদি রবীন্দ্রনাথের গানকে মিউজিক্যাল এবিউজ করে তাহলেই আমার আপত্তি।

এখন : আমাদের এখনকার জেনারেশনের ভেতরে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার অভ্যাসটা কমে যাচ্ছে। আমরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শুনি, কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীতের সেইভাবে শ্রোতা তৈরী হচ্ছে কম। এটাকে কীভাবে দেখেন?

শ্রেয়া : তাই! আমার তো মনে হয় না কমে যাচ্ছে। হতে পারে এখনকার জেনারেশন খুব ফার্স্ট তো, চমক জিনিশটা খুব ভালোবাসে। কিন্তু আমরা যারা গান করি জায়গা বুঝে একেকভাবে উপস্থাপন করি। তোমাদের এখানে ছায়ানটে যখন গান গাইতে এসেছি তখন যে গান বাছবো বা যেভাবে উপস্থাপনা করবো, টিভি অনুষ্ঠানে তো ওইভাবে করবো না। কলকাতাতে যখন টিভিতে গান করি সেটা একরকম , দক্ষিণী, গীতবিতান, শান্তি নিকেতনে আরেক রকম। আবার যখন আমেরিকা, লন্ডন, প্যারিসে গাইছি সেখানে মানুষ অন্যরকম— সেখানে পপুলার গান গাইব, প্রেজেন্টেশনটাও অন্যরকম হবে। তো এই দু’টোকে ব্যালেন্স করা খুব সহজ নয়, তাও চেষ্টা করছি।

শ্রেয়া গুহঠাকুরতা

এখন : রবীন্দ্রসঙ্গীতকে আরো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আপনার পরিকল্পনা…

শ্রেয়া : আমি বিদেশে মূলত শেখাই। আমাদের তো কলকাতায় বড় একটা স্কুল আছে। এর বাইরে আমি আমেরিকা, লন্ডন, কানাডায় গান শেখাই। স্কাইপের মাধ্যমে শেখাই। এইটার আমি কোন নাম দেইনি। সবাই জানে শ্রেয়া মানেই দক্ষিণী। যারা বিবাহ সূত্রে বা অন্য কারণে বাইরে থাকে, তাদের জন্য এটা সুযোগ। আমি প্রচুর বাংলাদেশী ও কলকাতার স্টুডেন্ট পাই।

এখন : কলকাতার সাথে আমাদের দেশের রবীন্দ্রসঙ্গীতের মৌলিক কোন পার্থক্য আছে বলে মনে হয়?

শ্রেয়া : আমার মনে হয় যারা সিরিয়াস গান এখানে করেন তাদের প্রতি আমার অনেক শ্রদ্ধা। কিছু কিছু শিল্পী আছেন যাদের ইনভলমেন্ট অনেক বেশী। এর জন্যই আমার ঢাকায় আসতে অনেক ভালো লাগে। বিশেষভাবে আমেরিকা বা কানাডায় যে অনুষ্ঠানগুলো করি, তার ৭৫% আয়োজক বাংলাদেশী। কারণ তাদের ভাষার প্রতি ও সুস্থ গান বাজনার প্রতি অন্যরকম টান আছে। এইটা আমার কাছে খুব ভালো লাগে। আমাদের দেশের ছেলে-মেয়েরা বলিউডের দিকে বেশী ঝুকছে।

এখন : বাংলাদেশের কোন শহর সবচেয়ে বেশী ভালো লাগে?

শ্রেয়া : আমি বেশী ঢাকাতেই এসেছি। ঢাকায় আমার প্রচুর বন্ধু-বান্ধব আছে। এর বাইরে সিলেট, চট্টগ্রাম গিয়েছি। পাবনাতে গিয়েছিলাম সুচিত্রা সেনের বাড়ীতে। আর আমার পূর্বপুরুষ হচ্ছে বরিশালে। বাংলাদেশ আসতেই আমার ভালো লাগে।

এখন : অভিনয়ের ব্যাপারটা…। অভিনয়ে আসতে চান?

শ্রেয়া : আমি অভিনয় করেছি আগে।  একেবারে ছোটকালে মুনমুন সেন ও তাপস পালের সঙ্গে অভিনয় করেছি। এর বাইরে শুধু তোমারই জন্য, অলৌকিকসহ বিভিন্ন সিরিয়াল করেছি। কিন্তু মা-বাবা যেহেতু ফিল্মে, এর জন্য আমি চেয়েছি অভিনয়ের বাইরে আসতে। আর আমি খুব ছোট বেলায় রবীন্দ্রনাথের প্রেমে পড়েছিলাম। তার গানকেই এগিয়ে নেওয়া আমার জন্য দায়িত্ব বলে আমি মনে করি।

এখন : মুভিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত হয়, সেটা বেশী বেশী হওয়া দরকার?

শ্রেয়া : হচ্ছে এখন। আমাদের ওইখানে তো প্রচুর হচ্ছে। সিরিয়ালে তো কমপক্ষে দু’টো থাকে। আমিও গান করেছি। আমরা যে এলিট শ্রেণীর কথা বলি, তার বাইরে সাধারণ মানুষের কাছে যাওয়ার জন্য সিনেমা অনেক বড় একটা মাধ্যম।

শ্রেয়া গুহঠাকুরতা