রাখাইনে জনশূন্য আগুনে পোড়া গ্রাম

988

ফেলে যাওয়া ফসলের ক্ষেত, জনশূন্য আগুনে পোড়া গ্রাম। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকার মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় এই দৃশ্যই এখন চোখে পড়বে।

গত দুই মাস থেকে সাংবাদিক অথবা সাহায্য সংস্থার কর্মীদের ওই অঞ্চলে যাওয়া নিষিদ্ধ। তবে বিবিসি মিয়ানমারের এক নাগরিককে ক্যামেরা দিয়ে সেখানে পাঠিয়েছিল। তিনিই গোপনে ছবিগুলো তুলেছেন। অল্প কয়েকজন রোহিঙ্গা নারীর দেখা পান তিনি। তাদের সঙ্গে কথাও বলেছেন।

বিবিসির হয়ে রাখাইন রাজ্যের একটি গ্রামের ছবি তুলেছেন ওই ব্যক্তি। দুই মাস আগেও গ্রামটি ছিল রোহিঙ্গা মুসলিম ভর্তি একটি জনপদ। রোহিঙ্গারা চলে গেছে। গ্রামের ভেতর এখন শুধু মিয়ানমারের সেনা।

রোহিঙ্গা গ্রামের ভেতর দিয়ে কয়েক ঘণ্টা চলার পর কজন রোহিঙ্গা নারীর দেখা পেয়েছিলেন বিবিসির ওই প্রতিনিধি। সঙ্গে কয়েক শিশু। তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ‘তাদের স্বামীরা কোথায়’—এ প্রশ্নের জবাবে তাঁদের একজন বলেন, ‘আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। ’

আরেক নারী জানান, তাঁর স্বামীকে সেনারা ধরে নিয়ে গেছে। এক হিসাবে গত কয়েক সপ্তাহে ৩০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বাস্তচ্যুত হয়েছে। তাদের অনেকেই বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে। অনেক রোহিঙ্গা তাদের নিজেদের দুর্দশার ভিডিও তুলে বিবিসির কাছে পাঠিয়েছে। ফুটেজে এক নারীকে বলতে শোনা গেছে তাঁর মেয়ে, পুত্রবধূ ও বোনকে যৌন হেনস্তা করা হয়েছে। কে করেছে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মিলিটারি’।

ক্যামেরার ফুটেজে আরেক নারীকে বলতে শোনা যায়, ‘ঘর থেকে বের করে ধানক্ষেতে নিয়ে ধর্ষণ করেছে। একবার নয়। বারবার। আমরা চিৎকার করেছি। বাঁচাবার কেউ ছিল না। ’

অবশ্য এই নারীরা যা বলছেন নিরপেক্ষভাবে তা যাচাই করা সম্ভব নয়। তবে এই ফুটেজটি এসেছে লংডন নামক একটি গ্রাম থেকে। সেখান থেকে অন্যান্য সূত্র থেকেও হত্যা এবং ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

রাজধানীর ইয়াংগুন থেকে বিবিসি প্রতিনিধি জোনা ফিশার জানান, বিদেশি কূটনীতিকদের মনোভাব দ্রুত বদলাচ্ছে। সংশয় সত্ত্বেও এত দিন তারা অং সান সু চির বিপক্ষে কোনো কথা বলেননি। কিন্তু কূটনীতিকদের অনেকেই এখন বিস্মিত হচ্ছেন যে রাখাইন রাজ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়ে সেনাবাহিনী এবং সু চি একই সুরে কথা বলছেন। সু চির অফিস থেকে এখন নিয়মিত ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে যে সেনাবাহিনী আইন মেনেই কাজ করছে। কোনো নির্যাতন তারা করছে না। বরঞ্চ রোহিঙ্গারাই তাদের বাড়িতে আগুন দিচ্ছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ডেভিড ম্যাথিসন বিবিসিকে বলেন, মানবাধিকারের রক্ষক হিসেবে যে উঁচু অবস্থান তাঁর ছিল, তা থেকে অং সান সু চি অনেকটাই সরে গেছেন। ‘তিনি কঠোর একজন রাজনীতিবিদ যাঁকে নির্মম একটি রাজনৈতিক পরিবেশে কাজ করতে হচ্ছে এবং সেনাবাহিনীর মতো নির্মম একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা করে চলতে হচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি—যে মূল্যবোধ তিনি ধারণ করতেন, তা থেকে তিনি সরে এসেছেন। ’

তবে সু চি চাপের ভেতর পড়েছেন। সেনাবাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্তে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। তবে তার প্রধান করা হয়েছে জ্যেষ্ঠ একজন জেনারেলকে। ফলে ওই তদন্ত যে নিরপেক্ষ হবে তেমন সম্ভাবনা কম। আর  সে কারণে রাখাইন রাজ্যে আসলে কী ঘটছে তার পুরো সত্য হয়তো জানা যাবে না।

সংঘর্ষে ১১ জন নিহত : দেশটির উত্তরাঞ্চলে শান প্রদেশে নিরাপত্তা বাহিনী ও সশস্ত্র বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘর্ষে এ মাসে অন্তত ১১ জন নিহত হয়েছে। গত নভেম্বর থেকে থেমে থেমে চলা সংঘর্ষে হাজারো মানুষ প্রদেশ ছেড়ে পালিয়েছে। অনেকে আবার সীমান্ত পাড়ি দিয়ে চীনেও পাড়ি জমিয়েছে। প্রতিবেশী দেশটিতে উত্তেজনা ও সংঘর্ষের কারণে পেইজিং তার সেনাবাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রেখেছে।

রাষ্ট্র পরিচালিত পত্রিকা গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমারের বরাত দিয়ে এএফপির খবরে বলা হয়, ২ ডিসেম্বর বিদ্রোহীদের হাতে ৯ পুলিশ সদস্য নিহত হন। এ ঘটনায় নিহত হন দুজন বিদ্রোহীও। রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের হিসাবে সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৩০ সেনা, পুলিশ, সরকারপন্থী মিলিশিয়া ও বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে।