বাজেট: পরিকল্পনা নেই কর্মসংস্থানের

1094

এম এ তসলিম

বাজেটের প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রথমেই বলব, ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকার বাজেট সত্যিই অনেক বড়। রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রাও অনেক বড়। এত বড় অর্জন আগে কখনোই সম্ভব হয়নি। গত অর্থবছরের আমদানি ও রপ্তানির পরিমাণ এবং বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয় না এই বাজেট বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। দেশে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমে গেছে। কিন্তু সরকারি ব্যয়ের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধির হার ধরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে, যা তেমন একটা উৎপাদনশীল ব্যাপার নয়। কারণ, সরকারি ব্যয়ে অপচয় হয় অনেক বেশি, সেখান থেকে প্রাপ্ত সুবিধার হার ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। আবার এটাও ঠিক, বিনিয়োগের জন্য বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে।

একটি ব্যাপারে সরকার একেবারেই নীরব, সেটি হলো কর্মসংস্থান। বিবিএসের প্রতিবেদনে জানা গেছে, দেশে উৎপাদনশীল খাতে কর্মসংস্থান কমে গেছে। এমনকি অনানুষ্ঠানিক খাতেও কর্মসংস্থান কমে গেছে। কিন্তু তারপরও প্রবৃদ্ধির এই হার ঠিক বাস্তবসম্মত নয়। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নতুন বেতনকাঠামো বাস্তবায়নের কারণে কিছু মানুষের ভোগ-ব্যয় বেড়েছে। এতে প্রবৃদ্ধির চাকাও কিছুটা সচল হয়েছে। কিন্তু সেই অতিরিক্ত ব্যয়ভার নির্বাহ করার জন্য প্রয়োজনীয় রাজস্ব আদায় করতে হবে। সেটা করা না গেলে বাজেটের ঘাটতি বড়ই হতে থাকবে, তা মেটাতে সরকারকে আবার ঋণ নিতে হবে।

একটি ব্যাপার লক্ষণীয়। এই সরকারের প্রথম দুই-এক বছর বাদে বাকি বছরগুলোর বাজেট বাস্তবায়নের হার সন্তোষজনক নয়। আর দেখা যায়, অর্থবছরের শেষ দিকে উন্নয়ন বাজেটে ব্যয়ের গতি বেড়ে যায়, তখন সরকারের ব্যাংকঋণ নেওয়ার পরিমাণও বেড়ে যায়। তড়িঘড়ি করে উন্নয়ন বাজেট ব্যয় করতে গেলে অর্থের অপচয় বেশি হয়।

এবারের বাজেটের ভালো দিক হচ্ছে, শিক্ষা খাতের বরাদ্দ ২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। পরিমাণ হিসেবে এটা কম নয়। এটা খুব জরুরিও ছিল। কারণ, বিশ্বদরবারে প্রতিযোগিতা করতে হলে আমাদের শিক্ষার হার ও মান দুটিই বাড়াতে হবে। এই টাকাটা যেন সঠিকভাবে ব্যয় করা হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

বেসরকারি খাতের বিনিয়োগই হচ্ছে আমাদের অর্থনীতির প্রাণ। কিন্তু সরকার এই বিনিয়োগের বাধাগুলো তেমন একটা আমলে নিচ্ছে না। এসব নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। মনে হচ্ছে, সরকার এ বিষয়ে চিন্তা করতে নারাজ। সরকার গতানুগতিক পথেই চলতে চায়। কিন্তু এভাবে যে প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে তা তেমন টেকসই হবে না। কিছুদিন পর প্রবৃদ্ধির হার নিচের দিকে নামা শুরু করতে পারে।

এখন কথা হচ্ছে, স্থানীয়ভাবেই যদি বেসরকারি বিনিয়োগ না হয়, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগ কীভাবে আসবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তো ব্যবসায়ী। তাঁরা যখন দেখবেন স্থানীয়ভাবে বেসরকারি বিনিয়োগ হচ্ছে না, তখন তাঁরা মনে করবেন, নিশ্চয়ই এখানে কোনো গোলমাল আছে। ফলে তাঁরা এখানে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবেন না। এখন সরকারি পর্যায়ে কিছু বিদেশি বিনিয়োগ আছে, কিন্তু বেসরকারি পর্যায়ে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না।

এদিকে সরকার রপ্তানিমুখী শিল্পের উৎসে কর বাড়িয়েছে। কিছু কিছু রপ্তানিমুখী শিল্পের অবস্থা ভালো, তাদের জন্য এটা হয়তো সমস্যা নয়। কিন্তু সবার অবস্থা তো ভালো নয়, ফলে তাদের জন্য এটা সমস্যাই। এ দেশের ধনীরা কর দিতে চান না। ফলে সরকার এমন জায়গায় কর বসিয়েছে, যাতে তাঁদের আর কিছু করার না থাকে। কিন্তু এতে অনেকেরই ভোগান্তি বাড়তে পারে।

প্রস্তাবিত ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হতো। ফলে প্যাকেজ মূসক বজায় রাখার সিদ্ধান্ত সঠিক হয়েছে বলেই মনে হয়। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়, তাই এ খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে অনেক মানুষ বেকার হবে, জিডিপির ওপর তেমন প্রভাব না পড়লেও। আবার রেমিট্যান্স কমছে, যার প্রকৃত কারণ এখনো আমরা জানি না। এই ভ্যাট আইন কার্যকর হলে নিম্ন আয়ের মানুষ বিপদেই পড়বে।কর্মসংস্থান খুব জরুরি বিষয়। এর ওপর আয় বণ্টন নির্ভর করে।

মানুষ বেকার হলে দারিদ্র্য ও বৈষম্য বাড়বে অর্থাৎ তার সামাজিক নিরাপত্তা কমবে। তাই মানুষের কর্মসংস্থানের ওপর জোর দিতে হবে।

অধ্যাপক এম এ তসলিম: শিক্ষক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।