বরষার প্রথম দিনে…

1559

এখন ডেস্ক।।

 

পুষ্পে-বৃক্ষে, তৃষিত হৃদয়ে, পত্র-পল্লবে নতুন প্রাণের নতুন গানের সুর নিয়ে এসেছে বর্ষা। গ্রীষ্মের আগুনঝরা দিন পেরিয়ে, বর্ষা এসেছে রিমঝিম শব্দে। বৃষ্টির নিক্কনে এবার প্রকৃতি হবে সজীব-সতেজ। প্রখর জৈষ্ঠ্যমাসের পর বর্ষার মুষলধারার বৃষ্টিতে ভেজার জন্য তাই তৃষিত অপেক্ষাতুর প্রকৃতি আছে উন্মুখ। আজ ১ আষাঢ়, ১৪২৩ বঙ্গাব্দ, বরষার প্রথম দিন।

কবিগুরুর বর্ণনায়, তোমার মন্ত্রবলে পাষাণ গলে, ফসল ফলে-মরু বহে আনে তোমার পায়ে ফুলের ডালা…। মানুষের মনেও এখন আশ্চর্য দোলা! নজরুলের ভাষায়- রিমঝিম রিমঝিম ঘন দেয়া বরষে।

কাজরি নাচিয়া চলে, পুর-নারী হরষে…। ভাটি বাংলার লোককবি উকিল মুন্সি থেকে বললে- যেদিন হইতে নয়া পানি আইলো বাড়ির ঘাটে সখি রে, অভাগিনীর মনে কত শত কথা ওঠে রে…। এমন আরও অনেক কথা কবিতা গানে আজ বর্ষাকে বরণ করে নেবে প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ। চলবে বর্ণাঢ্য বর্ষা বন্দনা।

বাংলাদেশের আবহাওয়াবিদরা বর্ষাকে অভিহিত করেন ‘সেকেন্ড সামার’ হিসেবে। অর্থাৎ গরম থেকে জনজীবনের রেহাই নেই। বৃষ্টি হলেও ভাপসা গরমের অস্বস্তি মানুষকে ঠিকই ভোগায়। আবার মৌসুমি বায়ু প্রবাহের কারণে টানা দুই মাস থেকে থেকে বৃষ্টিপাত, প্রকৃতি অন্য রকম এক আদলে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। তবুও ষড়ঋতুর এই দেশে বর্ষাই ঋতুর রানী।
ষড়ঋতুর বাংলাদেশে অনেক কিছুই আর আগের মতো নেই। বর্ষাও দিন ক্ষণ মানে না। অনেকদিন আগে থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। হালকা মাঝারি ও ভারি বর্ষণ মূলত আভাস দিচ্ছিল, বর্ষা আসছে। আর আনুষ্ঠানিক শুরুটা হলো আজ।

ঋতু বৈচিত্র্যের বাংলাদেশে আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল। এ সময় জলীয় বাষ্পবাহী দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি রেকর্ড করা হয় বর্ষায়। নিয়মিত বর্ষণে বদলে যায় চারপাশের পরিবেশ।

এ বদলে যাওয়া রূপের বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রকৃতিবিদ দ্বিজেন শর্মা বলেন,  ‘বর্ষার ভারি বর্ষণে শরীর ধুয়ে নেয় প্রকৃতি। পরিচ্ছন্ন হয়। নতুন করে জেগে ওঠে। বেলী, বকুল, জুঁই, দোলনচাঁপা, গন্ধরাজ, হাসনাহেনার ঘ্রাণে ভরে ওঠে চারপাশ। আর মিষ্টি হাসি হয়ে ফোটে ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল।’ ময়ূর পেখম মেলে নাচে।’

বর্ষার চিত্ত চাঞ্চল্য প্রকাশ করে কবিগুরু লিখেছেন- হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে…। ময়ূরের মতোই বর্ষার বৃষ্টিতে ভিজে কাটে বাঙালীর শৈশব। স্কুলে যাওয়ার সময় কিংবা ফেরার পথে দুরন্ত কিশোরী আনন্দে গায়ে মাখে বৃষ্টির ফোঁটা। আর যত্ন করে ব্যাগে পুড়ে রাখে রঙ্গিন ছাতাটি। তুমুল বৃষ্টিতে গাঁয়ের ছেলেরা নেমে পড়ে ফুটবল নিয়ে। বর্ষার এইত রূপ!
মানুষের মনে অদ্ভুত শিহরণ জাগায় বর্ষা। প্রেমের বোধ উস্কে দেয়। কবিগুরুকে তাই লিখতে হয়- তুমি যদি না দেখা দাও, কর আমায় হেলা, কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল-বেলা…। একই অনুভূতি থেকে নজরুল লেখেন- রিম্ ঝিম্ রিম্ ঝিম্ ঝরে শাওন ধারা। গৃহকোণে একা আমি ঘুমহারা। ঘুমন্ত ধরা মাঝে, জল-নূপুর বাজে, বিবাগী মন মোর হলো পথহারা…। ঠিক পরের স্তবকে প্রিয়ার সান্নিধ্য লাভের আকুলতার কথা জানিয়ে কবি লেখেন- চেনা দিনের কথা ভেজা সুবাসে, অতীত স্মৃতি হয়ে ফিরে ফিরে আসে। এমনি ছলছল ভরা সে-বাদরে, তোমারে পাওয়া মোর হয়েছিল সারা…।

বর্ষাবিহীন বাংলাদেশ ভাবাই যায় না। বর্ষা ঋতু তার বৈশিষ্ট্যের কারণে স্বতন্ত্র। বর্ষা ঋতু কাব্যময়, প্রেমময়। বর্ষার প্রবল বর্ষণে নির্জনে ভালোবাসার সাধ জাগে, চিত্তচাঞ্চল্য বেড়ে যায়। শত অনাকাঙ্খিত ঘটনার ভিড়েও কোথায় যেন মেলে এক চিলতে বিশুদ্ধ সুখ। কদম ফুলের মতো তুলতুলে নরম, রঙিন স্বপ্ন দুই চোখের কোণে ভেসে ওঠে, ঠিক যেমন করে আকাশে সাদা মেঘ ভেসে বেড়ায়।

কবির কবিতায়, শিল্পীর সুরে-গানে, চারুশিল্পীর তুলির আঁচড়ে, চলচ্চিত্রের সেলুলয়েডে, নকশীকাঁথার ফোঁড়ে ফোঁড়ে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ ভাণ্ডারে বর্ষার অপরূপ রূপ বর্ণনা, স্থিতি ও ব্যাপ্তি মূর্ত ও চিরকালীন হয়ে আছে।
বর্ষা ফুল ফোটায়। বর্ষার এই শীতল আবহাওয়ায় গাছে গাছে কদম ফুলের সমারোহ দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। বর্ষার প্রথম মাস আষাঢ়ের অগ্রদূত কদম ফুল। যেন কদম ফুল আষাঢ়কে স্বাগত জানায়। বর্ষার আগেই গাছে গাছে কদম ফুল ফুটেছে।

বর্ষা কবিদের ঋতু। বর্ষা নিয়ে কবিরা লিখেছেন অসংখ্য কবিতা-গল্প-গান। বর্ষা মানেই সময়-অসময়ে ঝমাঝম বৃষ্টি, কর্দমাক্ত পথঘাট, খাল-বিলে থৈ থৈ পানি, নদীতে বয়ে চলা ছবির মতো পাল তোলা নৌকার সারি। বর্ষার নতুন জলে স্নান সেরে প্রকৃতির মনও যেন নেচে ওঠে। ফুলে ফুলে শোভিত হয় প্রকৃতি। তাল তমাল শাল পিয়াল আর মরাল কপোতের বন বীথিকায় চোখে পড়ে বকুল, কদম, জারুল, পারুল, কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়াসহ অসংখ্য ফুল।

অন্যবারের মতো এবারো রাজধানীতে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে বর্ষাকে বরণ করে নেয়া হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় অনুষ্ঠান শুরু হবে সকাল ৭টায়। সকালের আয়োজন চলবে ৯টা পর্যন্ত। এর পর আবার অনুষ্ঠান শুরু হবে বিকেল ৫টায়। সকাল ৭টায় বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ঢাকা মহানগর সংসদ আয়োজন করেছে বর্ষা উৎসব। সকাল ৭টা থেকে শুরু হবে বর্ষা উৎসবের অনুষ্ঠানমালা। এ ছাড়া চ্যানেল আই আয়োজন করেছে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার নেতৃত্বে সুরের ধারার শিল্পীদের গানে গানে সকাল শুরু হবে।

 

এখন/এসএস