ফিটনেস নেই ২০ লাখ গাড়িতে

893

বর্তমানে সারা দেশে ৫০ লাখের মতো পরিবহন চলাচল করছে। তবে এর মধ্যে ২০ লাখ পরিবহনেরই ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই বলে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। ফিটনেসবিহীন এসব পরিবহনের বিরুদ্ধে কার্যত কোনও ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে না। ফলে ফিটনেসবিহীন পরিবহনের কারণে সড়কে বাড়ছে দুর্ঘটনা। প্রতিদিন বাড়ছে মৃত্যের সংখ্যা। এ অবস্থায়ও টনক নড়ছে না সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ)। প্রতিষ্ঠানটির কাছে দেশে কী পরিমাণ ফিটনেস সনদবিহীন পরিবহন রয়েছে তারও সঠিক কোনও তথ্য নেই। সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

বেসরকারি পরিসংখ্যানে দেশে ৫০ লাখেরও বেশি পরিবহন থাকলেও চলতি বছরের ৩১ জুন পর্যন্ত বিআরটিএ’র তথ্য বলছে, বর্তমানে সারা দেশে বাস, মিনিবাস ও হিউম্যান হলারসহ মোট নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩৭০। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকাতেই রয়েছে ১১ লাখ ৪৩ হাজার ২৪৩টি পরিবহন। এই পরিবহনের মধ্যে শুধু সাড়ে ২২ লাখই হচ্ছে মোটরসাইকেল। তবে এসব পরিবহনের মধ্যে কী পরিমাণ যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই এর সঠিক কোনও তথ্য বিআরটিএর কাছে সংরক্ষিত না থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি বলছে এর সংখ্যা কোনও অংশেই ২৫ শতাংশের কম নয়।

অপরদিকে বেসরকারি হিসাবে, সারাদেশে যানবাহনের চালকের সংখ্যা ৫০ লাখের বেশি হলেও এসব চালকদের মধ্যে চলতি বছরের ৩১ জুন পর্যন্ত বিআরটিএ অনুমোধিত লাইসেন্স রয়েছে ১৮ লাখ ৬৯ হাজার ৮১৬ জনের। এর মধ্যে পেশাদার চালক ৮ লাখ ৩০ হাজার ৯০ জন। আর অপেশাদার ১০ লাখ ৩৯ হাজার ৭২৬ জন। অবশিষ্ট সাড়ে ৫১ লাখ অবৈধ ও অদক্ষ চালকই সড়কে নৈরাজ্যের মূল কারণ। ফলে কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না সড়ক-মহাসড়কে নৈরাজ্য-দুর্ঘটনা।

তবে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির চলমান এক জরিপের তথ্য মতে বিআরটিএর নিবন্ধিত মোট পরিবহনের ৪০ শতাংশই ফিটনেসবিহীন। প্রতিষ্ঠানটির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘৫০ লাখ যানবাহনের মধ্যে মাত্র ৩৫ লাখের মতো যানবাহনের নিবন্ধন রয়েছে। বাকি ১৫ লাখের কোনও সনদ নেই। আইন অনুযায়ী যেসব যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন নেই সেগুলোর ফিটনেস সার্টিফিকেটও নেই। এছাড়া রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত যানবাহনের মধ্যেও অনেক পরিবহনের ফিটনেস নেই। সব মিলিয়ে এর সংখ্যা কোনও অংশেই ২০ লাখের কম নয়। আমরা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এ সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিবদনটি প্রকাশ করবো।’

এদিকে, ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ফিটনেস নবায়ন না করা ৫৫ হাজার যানবাহনের তালিকা করেছে বিআরটিএ। এর মধ্যে তিন হাজার ৭৪০টি গাড়ি বিভিন্ন সরকারি ও আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানের। ফিটনেস সনদবিহীন সরকারি যানবাহন সবচেয়ে বেশি পুলিশের। এ বাহিনীর প্রায় ১১০০ যানবাহনের ফিটনেস সনদ ১০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে নবায়ন হয়নি। এসব পরিবহনকে গত ৩০ এপ্রিলের মধ্যে সনদ নবায়নের নির্দেশও দেয় প্রতিষ্ঠানটি। নির্দেশনা পেয়ে কিছু মালিক সনদ নবায়ন করলেও এখনও প্রায় ৫০ হাজার যানবাহন ফিটনেস সনদ নবায়ন করেনি। এই সনদ প্রদানে করসহ বিভিন্ন ফি বাবদ ২২ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত ফি দিতে হয় সরকারকে।
গণপরিবহন

বিআরটিএ’র এক কর্মকর্তা জানান, ‘বিআরটিএর কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর ওই তালিকায় থাকা যানবাহনগুলো নিবন্ধন নেওয়ার পর কোনও দিনই ফিটনেস নিতে আসেনি। এর মধ্যে আবার অনেক পরিবহন তখন রাস্তায়ও ছিল না। তখন রাজধানীতে পাঁচ লাখের মতো যানবাহন চলতো। বর্তমানে এর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দ্বিগুণের বেশি। রাজধানীসহ সারাদেশে ফিটনেসবিহীন পরিবহনের সংখ্যা কোনও অংশেই মোট পরিবহনের ৪০ শতাংশের কম হবে না। মূলত ফিটনেসবিহীন লক্কড়-ঝক্কড় পরিবহনের কারণেই যানজটের পাশাপাশি দুর্ঘটনা ঘটছে।’

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন অথরিটি (বিআরটিএ) ২০টি ক্যাটাগরিতে পরিবহনের লাইসেন্স দিচ্ছে। এই ক্যাটাগরিগুলোর মধ্যে প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৮২ সাল থেকে চলতি বছরের ৩১ জুন পর্যন্ত পাঁচ হাজার ৪১৮টি অ্যাম্ব্যুলেন্স, ২ লাখ ৫৫ হাজার ৮৫০টি অটোরিকশা, ২০ হাজার ৪৭৩টি অটো-টেম্পু, ৪৫ হাজার ৩৭৭টি বাস, ৯ হাজার ৩২৯টি কার্গো ভ্যান, ২৮ হাজার ৪৭০টি কভার্ড ভ্যান, ২৮ হাজার ৪২৯টি ডেলিভারি ভ্যান, ১৮ হাজার ২৫টি হিউম্যান হলার, ৫৫ হাজার ৮৬৩টি জিপ (হার্ড/সপ্ট), ৯৯ হাজার ১৮৭টি মাইক্রোবাস, ২৮ হাজার ৬৩টি মিনিবাস, ২২ লাখ ৩৪ হাজার ৮৯২টি মোটরসাইকেল, এক লাখ আট হাজার ৬৯০টি ফিক-আপ (ডাবল/সিঙ্গেল কেবিন), তিন লাখ ৪০ হাজার ২৮৯টি প্রাইভেট প্যাসেঞ্জার কার, ৯ হাজার ৮৭১টি স্পেশাল পারপাস ভিইক্যাল, পাঁচ হাজার ৬০টি ট্যাঙ্কার, ৪৫ হাজার ২৯৫টি ট্যাক্সিক্যাব, ৪১ হাজার ৬০৬টি ট্রাকটর, এক লাখ ৩৪ হাজার ৪১০টি ট্রাক ও অন্যান্য পরিবহন রয়েছে ১৭ হাজার ৮০৩টি।

এর আগে ২০১০ সালের শুরুতে রাজধানীতে ফিটনেসবিহীন পরিবহনের ওপর একটি জরিপ পরিচালনা করে বিআরটিএ। এতে দেখা যায় শুধু রাজধানী ঢাকায় ৮০ হাজারের বেশি যানবাহন চলছে ফিটনেস (চলাচলের উপযোগী সনদ) ছাড়া। সে সময় ওই সব পরিবহনের তালিকা করে পুলিশের কাছে পাঠানো হয়। ওই তালিকায় ব্যক্তিগত কার, বাস, মিনিবাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, মাইক্রোবাস, ট্যাক্সিক্যাব, হিউম্যান হলারসহ বিভিন্ন ধরনের পরিবহন রয়েছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘দেশে যে পরিমাণ গাড়ি চলাচল করে সত্যিকারে সে পরিমাণ যানবাহনের ফিটনেস সনদ নেই। আমরা পরিবহন মালিকদের বারবার তাগিদ দিচ্ছি কাগজপত্র নবায়ন করে নেওয়ার জন্য। চিঠি দিয়েও জানিয়েছি। অনেকেই নবায়ন করছেন। আবার অনেকেই এখনও করেনি।’

মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ অনুযায়ী, একবার ফিটনেস সনদ সংগ্রহ করলে তা নবায়নের তারিখ থেকে পরের এক বছর পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। ফিটনেস সনদ পেতে হলে গাড়িসহ বিআরটিএ কার্যালয়ে হাজির হতে হবে। সেখানে অন্তত ৩০ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ফিটনেস সনদ দেওয়া হয়।

গত ৩ এপ্রিল রাজধানীর কাওরান বাজারে দুই বাসের রেষারেষিতে হাত হারিয়ে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী রাজীবের মর্মান্তিক মৃত্যু দেশের মানুষের হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে। সর্বশেষ গত ২৯ জুলাই দুপুরে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনের বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় শহীদ রমিজউদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আবদুল করিম ওরফে রাজু এবং একই কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম ওরফে মিমের মৃত্যু পরিবহন জগতের চিত্র ফুটে উঠেছে। বাসচালকদের প্রাণঘাতী প্রতিযোগিতায় দিন দিন যোগ হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এ অবস্থায় সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাকে কঠোর আইনের আওতায় আনার পরামর্শ তাদের।

এদিকে গত ২৯ জুলাইয়ের ঘটনার পর সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী তানভীর আহমেদ জনস্বার্থে রিটটি দায়ের পর শুনানি শেষে আদালত গণপরিবহনের ফিটনেস বিষয়ে জরিপ করতে স্বরাষ্ট্র সচিব, সড়ক পরিবহন সচিব ও বিআরটিএর চেয়ারম্যানসহ বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ১৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন। সেই সঙ্গে ফিটনেসবিহীন যান চলাচল বন্ধের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়েছে। মঙ্গলবার (৩১ জুলাই) বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো.আশরাফুল কামালের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

জানতে চাইলে বিআরটিএ’র পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) মো. নূরুল ইসলাম বলেন, ‘অনেক পরিবহনের ফিটনেস সনদ নেই এটা সত্য। তবে কী পরিমাণ পরিবহনের সনদ নেই সেই সঠিক তথ্য আমাদের কাছে নেই। কারণ রেজিস্ট্রেশন নেওয়ার পর অনেক পরিবহন সড়কে থাকে না। অনেক পরিবহন নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে নষ্ট গাড়ির তো আর ফিটনেস সনদ মালিক নেবে না। এজন্য বিষয়টি নিরূপন করা কঠিন। আদালতের নির্দেশ পাওয়ার পর আমরা কমিটি গঠনের কাজ শুরু করে দিয়েছি।’