প্রস্তুত ৬ লাখ গাড়ি

1073

রাজধানীতে নিবন্ধিত ছয় লাখ ৭২ হাজার গাড়ি অ্যাপসভিত্তিক সেবার আওতায় আনার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। অলস সময়ে এসব গাড়ি ব্যবহার করে পরিবহন সংকটের অনেকটাই নিরসন সম্ভব হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দুই প্রতিষ্ঠান উবার ও ডাটা ভক্সেল লিমিটেড এই সেবা নিয়ে আসছে। অবশ্য রাজধানীতে অনানুষ্ঠানিকভাবে এরই মধ্যে তা চালুও রয়েছে। প্রয়োজনের সময়টাতে প্রাপ্তির নিশ্চয়তা আর কম খরচ বিবেচনায় এরই মধ্যে এই সেবা নিয়ে নগরবাসীর মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে।গণপরিবহন সংকট সমাধানে এই সম্ভাবনার মাঝে একটা ‘কিন্তু’ তৈরি হয়েছে আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে। আশার কথা, সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই সেবা চালুর জন্য আইনে কী কী বিষয় রাখতে হবে তার প্রস্তাবনা তৈরি করছে উবার। আগামী ৫ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে তা বাংলাদেশ সড়ক  পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাছে তুলে ধরা হবে। আর ডাটা ভক্সেল লিমিটেড বিআরটিএতে তাদের সেবার বিস্তারিত লিখিতভাবে তুলে ধরবে আগামী সোমবার।

অ্যাপসভিত্তিক সেবার আওতায় থাকা নিবন্ধিত গাড়িগুলোর মধ্যে মোটরসাইকেল রয়েছে চার লাখ ৩২ হাজার। বাকি দুই লাখ ৪০ হাজার প্রাইভেট কার। মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহনে আইনি বাধা নেই। তবে প্রাইভেট কার বাণিজ্যিকভাবে ভাড়ায় খাটাতে হলে নতুন আইন অথবা প্রস্তাবিত আইনে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আইন হওয়ার আগে প্রাইভেট কার ভাড়ায় খাটালে অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়েছিল বিআরটিএ; যদিও সেই ঘোষণার তোয়াক্কা না করে উবার তাদের সেবা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রথমবারের মতো কোনো যাত্রী উবারের গাড়িতে চড়লে ২৫০ টাকা ভাড়া রাখা হচ্ছে। অবশ্য এই হার আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এরপর নতুন করে ভাড়া নির্ধারণ হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আরেক প্রতিষ্ঠান ডাটা ভক্সেল ইনকরপোরেটের সহযোগিতায় ডাটা ভক্সেল লিমিটেড ঢাকায় স্যাম অ্যাপসভিত্তিক মোটরসাইকেল সেবা দিচ্ছে ২১ নভেম্বর থেকে। এই সেবাগ্রহীতার তালিকায় প্রতিদিনই গড়ে ৫০ জন নতুন যাত্রী যোগ হচ্ছে।

রাজধানীতে গণপরিবহনের সংকট প্রকট। এই মহানগরের জনসংখ্যার তুলনায় বাস-মিনিবাস, অটো, ট্যাক্সিক্যাবের মতো গণপরিবহন খুবই কম। এই সংকটকে পুঁজি করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর সেবাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখানে পরিবহন ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে চাইছে।

ঢাকায় এক কোটি ৭০ লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে মহানগরীতে বাস ও মিনিবাস চলে মাত্র সাত হাজার। অনুমোদিত সিএনজিচালিত অটোরিকশা আছে প্রায় ১৩ হাজার। মিটারে চলার কথা থাকলেও এগুলোর বেশির ভাগই যাত্রীদের জিম্মি করে ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করে। গত ৩ ডিসেম্বর প্রকাশিত বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, অটোরিকশার ৮৬ শতাংশই চলে চুক্তিতে, আর যাত্রীর কাছে বকশিশ দাবি করেন ৯৭ শতাংশ চালক।

এ ছাড়া সারা শহরে দিনে গড়ে চলে মাত্র ৩০০ ট্যাক্সিক্যাব। এগুলোর বেশির ভাগই নির্দিষ্ট এলাকায় পার্ক করা থাকে। ডাকলেও সহজে মেলে না। একমাত্র সরকারি পরিবহন সংস্থা বিআরটিসির বাসও নগণ্য। এর ওপর প্রতিষ্ঠানটির ৫৫৫টি বাস অচল পড়ে আছে।

মেগাসিটিতে গণপরিবহনের এই স্বল্পতায় ব্যক্তিগত গাড়ি অলস সময়ে ভাড়া খাটিয়ে সংকট থেকে কিছুটা হলেও রেহাই মিলতে পারে বলে মনে করছে নগরবাসী। এই অবস্থায় অলস গাড়ির অ্যাপসভিত্তিক বাণিজ্যিক ব্যবহারে গাড়ির মালিক, চালক ও যাত্রীদের আগ্রহ বাড়ছে।

ঢাকায় উবারের গাড়িসেবা উদ্বোধন হয় গত ২২ নভেম্বর। এরপর বিষয়টি সরকারের নজরে আসে। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, প্রাইভেট কার এভাবে ভাড়ায় খাটাতে তথ্য-প্রযুক্তিবান্ধব কোনো নীতিমালা ও আইন নেই। এই অবস্থায় উবারের সেবা চালুর তিন দিনের মাথায় সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এই সেবা বেআইনি ঘোষণা করে বিআরটিএ। বিষয়টি নিয়ে গত ২৯ নভেম্বর বিআরটিএর চেয়ারম্যানের সঙ্গে উবারের তিন সদস্যের প্রতিনিধিদলের বৈঠক হয়। বৈঠকের পর বিআরটিএর চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, প্রাইভেট কার ভাড়ায় চালালে বিআরটিএ অভিযানে যাবে। এই হুমকির পরও রাজধানীর সর্বত্র উবারের সেবা চলছে। গতকাল শুক্রবার সকালে শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, মিরপুর-১০, কুড়িল, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, বিমানবন্দর, কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে উবারের গাড়িতে অনেককে সেবা নিতে দেখা গেছে। বিকেলে উবারের গাড়িগুলো দেখা গেছে নর্দা, গুলশান, বনানীসহ বিভিন্ন স্থানে।

জানা গেছে, উবার-গাড়িতে ভিত্তিভাড়া ৫০ টাকা, তার সঙ্গে যোগ হয় প্রতি মিনিট দুই টাকা ও প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ১৮ টাকা। অন্যদিকে ট্যাক্সিক্যাবে সরকার অনুমোদিত প্রথম দুই কিলোমিটারের ভাড়া বা সর্বনিম্ন ভাড়াই ৮৫ টাকা। এর সঙ্গে যোগ হয় পরবর্তী প্রতি মিনিট ৩৪ টাকা, অপেক্ষার জন্য মিনিটে চার্জ চার টাকা ২৫ পয়সা।

উবারের পক্ষে ঢাকায় কাজ করছেন এমন একজন শীর্ষ কর্মকর্তা গতকাল বলেন, ‘উবার নেটওয়ার্কে দিনে গড়ে ৪০ জন চালক যোগ হচ্ছে। বিআরটিএতে উপস্থাপনের জন্য আমরা আমাদের প্রস্তাবটি তৈরি করা শুরু করেছি। তাতে তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই সেবার বিষয়ে আমাদের প্রস্তাব থাকবে। সরকারের নীতিনির্ধারকরাও ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করছেন। সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও এ বিষয়ে ইতিবাচক বক্তব্য দিয়েছেন। এই অবস্থায় আমাদের সেবা অব্যাহত রয়েছে। ’

উবারের মুখপাত্র সানজানা ভাইদ ই-মেইল বার্তায় তাঁর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, ‘ঢাকায় সেবা চালুর এক সপ্তাহের মধ্যেই আমরা ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। আইনি জটিলতা নিরসনে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে আমরা আলোচনা শুরু করেছি। ’

টিম উবার, ঢাকার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অ্যাপল স্টোর বা গুগল প্লে থেকে উবারের ফ্রি অ্যাপসটি ডাউনলোড করা যায়। ফোন নম্বর ও ই-মেইল ব্যবহার করে সাইনআপ করা যায়। গন্তব্য নির্বাচন করলে কিছুক্ষণের মধ্যেই উবারের চালক পৌঁছে যায় যাত্রীর কাছে। যাত্রা শেষে ‘পে ইন ক্যাশ’-এ সহজেই ভাড়া মিটিয়ে দেওয়া যায়। উবারের প্রমোশনাল কোড ব্যবহার করে আরো উপভোগ করা যাবে ২৫০ টাকা পর্যন্ত ফ্রি রাইড। তবে এটি শুধুই নতুন গ্রাহকদের জন্য এবং অফারটি ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ পর্যন্ত প্রযোজ্য। রাইডের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব তথ্য, যেমন—চালকের তথ্য, গাড়ির লাইসেন্স, প্লেট নম্বর ইত্যাদি অ্যাপস ব্যবহারকারীর কাছে আগেই পৌঁছে যাবে। এমনকি অ্যাপস ব্যবহারকারী চালক ও যাত্রী উভয়েই একে অন্যের তাৎক্ষণিক অবস্থান জানতে পারবে।

উবারের নিজস্ব কোনো ট্যাক্সি বা প্রাইভেট কার নেই। ব্যক্তিগত গাড়ির মালিকরা অ্যাপস ডাউনলোড করে নিবন্ধনের মাধ্যমে উবারের চালক হয়ে যেতে পারেন। একই অ্যাপস ব্যবহার করে সেবা পাবে যাত্রীরা। গাড়ির দূরত্ব ও সময় অনুযায়ী ভাড়ার হিসাব হয়ে যাবে অ্যাপসে। বাজে আচরণের জন্য যাত্রী বা চালক অ্যাপসে রেটিংও দিতে পারবেন।