জীবনে তো ঝড় আসেই —রাজিয়া রহমান জলি

1750
রাজিয়া রহমান জলি

যে জীবন আধেক যেয়েই সঙ্গী হারায়, স্মৃতিই ছায়া হয়ে সঙ্গীর মতো চলে সেই জীবনের, এমন স্নিগ্ধ অথচ অমিষ্ট জীবন বয়ে চলছেন দীপনপুরের পরিচালক রাজিয়া রহমান জলি। বইমেলার শুরু,একদিকে দীপনপুর অন্যদিকে জাগৃতি, এই একলা মানুষটি কেমন করে সব সামলাচ্ছেন, তার এই সংগ্রামী জীবনের গল্প শুনতে একুশে বইমেলা শুরুর ঠিক আগের দিন এখন-এর পক্ষ থেকে দীপনপুরে গিয়েছিলেন জান্নাতুল ফেরদৌসী সনিহাসান ওয়ালী। ছবি তুলেছেন আল নাহিয়ান

এখন : কেমন আছেন?
রাজিয়া রহমান জলি : হুম, আছি ভালো।

আপনার বাচ্চারা কেমন আছে?
আছে, ভালোই আছে। কাল ছেলের এসএসসি পরীক্ষা। সবাই খুব চিন্তিত, আমিও।

একইভাবে ভালোও কি লাগছে না?
জলি- হ্যা, সে তো অবশ্যই। রিদাত বড় হচ্ছে, ভালো লাগা তো আছেই।

আপনার মেয়ের নাম তো রিদমা আদনিন, ও কোন ক্লাসে পড়ে?
নাইনে উঠলো এবার।

দীপনপুর, এই যে বইয়ের হাঁট, অনেকটা প্রাণের কোলাহল বলা যায়, এর গড়ে ওঠার গল্পটা শুনি, কার পরিকল্পনা এটা?
পরিকল্পনা একা কারো না। আমি এবং আমার ত্রিশজন বন্ধু মিলেই এটা করেছি। একা করা তো আসলে সম্ভব না।

রাজিয়া রহমান জলি

কী উদ্দেশ্যে এরকম পরিকল্পনা করা হলো? পরিকল্পনার সময়ের সকলেই কি এখনো আছেন দীপনপুরের সঙ্গে?
আমরা ত্রিশজনই যারা পরিকল্পনার শুরুতেও ছিলাম এখনো আছি, আমরা দীপনের (ফয়সাল আরেফিন দীপন) স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে অনেকটা এরকমই একটা স্মরণগৃহ ‘বইয়ের জগত’ নামে একটা বুকশপের পরিকল্পনা করি প্রথমে। এর প্রকৃত উদ্দেশ্য মূলত এই প্রজন্মকে একটা সুস্থ জগত দেয়ার চেষ্টা এবং সেটা সাহিত্য চর্চার ভেতর দিয়ে হতে পারে মনে করেই বইয়ের এমন একটা জগত আমরা দিতে চেয়েছি যেন তরুণরা সুস্থভাবে সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে, আর বিপথে না যায়! দীপনকে যে কারণে প্রাণ দিতে হলো সেই মানসিকতা থেকে তরুণদের বেরিয়ে আসতে বই অনেক বড় ভূমিকা পালন করবে বলেই আমাদের মনে হয়েছে।

কেমন সাড়া পাচ্ছেন?
ভালো, খুবই ভালো! সবাই আসছে, দেখছে, ইচ্ছে করলে বসে পড়ছে, বই কিনছে, প্রশংসা করছে, বসছে, গল্প করছে, চা-কফি খাচ্ছে, বিভিন্ন সাহিত্যিক সভা-অনুষ্ঠান হচ্ছে। সবাই খুব সমর্থন করছে আসলে। আরো কী কী হলে সকলের আরো ভালো লাগবে সেসব নিয়েও সকলে নির্দ্বিধায় কথা বলছে, আমরা ওদের কমেন্ট নিচ্ছি। মোটকথা সকলেই ইতিবাচকভাবে নিয়েছে বিষয়টাকে।

আপনার যে দুটো উদ্দেশ্য মূলত, সেসব বাস্তবায়নে এসেও কি ঠিকভাবে চলছে?
হ্যা, আমাদের আসলেই দুটো উদ্দেশ্য, এক দীপনকে সবসময় সবজায়গায় সকলের চোখের সামনে রাখা, দীপনকে স্মৃতিতে ধরে রাখা, যেমন ঢুকতেই দীপনের ছবি বা ওর সব জিনিসগুলো রাখা আছে, পুরো জায়গাটাই একটু দীপনকেন্দ্রিক রেখেছি এই উদ্দেশ্যেই।
আর দ্বিতীয়টা হলো, তরুণ প্রজন্মকে কিছুটা হলেও সুস্থতার পথে নিয়ে আসার লক্ষ্যে সুস্থ একটা পরিবেশ দেয়া, এইতো। এখনো এই দুটো উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই কাজ করছি, করতে পারছি।

রাজিয়া রহমান জলি
দীপনপুরের উদ্বোধনে। -ফাইল ফটো

দীপনপুর প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কি কোন বাঁধার সম্মুখীন হয়েছেন?
নাহ, দীপনপুর আমরা সবাই মিলে এবং সবাই সবার জায়গা থেকে অনেক বেশি চেষ্টা করার ফলে খুবই তাড়াতাড়ি শুরু এবং শেষ করতে পেরেছি। হয়না এরকম, যেমন অন্য বুকশপগুলো অনেকদিন ধরে প্লানিং করে করে দুই তিনবছর পরে এসে ফাইনালি কাজ শুরু করে, আমাদের এরকম হয়নি। আমরা খুব তাড়াতাড়িই চিন্তাটা মাথায় আসার সাথে সাথেই কাজ শুরু করি এবং স্বপ্নটা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করি, এইতো…

জাগৃতি কেমন চলছে? বা জাগৃতি নিয়ে নতুন কোনো প্ল্যান আছে কি?
জাগৃতি চলছে আগের মতোই। না এখন পর্যন্ত নতুন কোনো প্ল্যান নেই। আগেও যেরকমভাবে চলছিলো সেরকমভাবেই আছে।

জাগৃতির বইমেলার প্রস্তুতি কেমন?
হ্যা, ভালোই। এবার জাগৃতির নতুন প্রকাশনা ৬০টি বই। ২০১৮ বইমেলা একেবারেই অন্যরকমভাবে পরিকল্পিত ছিলো, সেইভাবেই কাজ করেছি। সেভাবেই বইমেলায় জাগৃতিকে দেখা যাবে।

নতুন বই প্রকাশের ক্ষেত্রে আপনি কি এখন সেসব পাণ্ডুলিপি এড়িয়ে যান, যেসব পাণ্ডুলিপির জন্য দীপন ভাইকে চলে যেতে হয়েছে?
অবশ্যই এড়িয়ে চলি, বা বেছে চলি। কারণ, আমি মনে করি না দেশে সেরকম প্রেক্ষাপট পরিস্থিতি কিছুমাত্রও আছে! তাছাড়া এই কয়েকটা বইই তো দীপনের বই না। দীপনের প্রকাশিত আরো ষোলশত বই আছে সেগুলোও দীপনের বই। ওই অল্প কয়েকটাই তো দীপনের পরিচয় না। দীপন নতুন রাইটারদের প্রোমোট করতো, সবধরণের মানসম্মত লেখাই দীপন গুরুত্ব দিতো। তার মধ্যে সেগুলোও ছিলো। সেটাই চর্চা চলছে জাগৃতিতে এখন, ভালো পাণ্ডুলিপিকে গুরুত্ব দিচ্ছি, নতুন ভালো লেখকদের গুরুত্ব দিচ্ছি, বাদ যাচ্ছে শুধু সেসবকিছু যা এই দেশের মানুষ এখনো নিতে শেখেনি।

দীপনপুর

আপনার উপর কি এখন সেরকম কোন চাপ আছে, নিজের কাছে বা বাইরে থেকে?
আমি আসলে কোনধরণের চাপই নিচ্ছি না। নিজের ভেতরকার বলেন আর বাইরের বলেন, আমি এসবকে পাত্তা দিচ্ছি না। যদি পাত্তা দিতে হতো তাহলে তো দেশ ছেড়েই চলে যেতাম ভয়ে।

দীপনপুর প্রতিষ্ঠায় অনেকেই পাশে ছিলেন এখনো আছেন, কিন্তু জাগৃতি ও দীপনপুর দুটো প্রতিষ্ঠানই এখন আপনাকে দেখতে হচ্ছে, মূলত এই ব্যস্ততা কেমন লাগছে?
আমার আসলে এখন ব্যস্ততা শুধু এই দুটো প্রতিষ্ঠানই না, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের সিনিয়র মেডিকেল অফিসার, সেখানে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে, দীপনপুরের সমস্তকিছু, জাগৃতির সমস্তকিছু, আর পরিবারেও তো সব দায়িত্ব এখন এককভাবে কাঁধে চলে এসছে যেটা আগে দুজনের মধ্যে ভাগ করা ছিলো। তাছাড়া প্রকাশনাকে তো কখনোই আমাকে পেশা হিসেবে নিতে হয়নি আগে, এখন সেটা প্রফেশনালি ডিল করতে হচ্ছে, যদিও আমার অনেক বন্ধুরা আমার সাথে আছেন কিন্তু মূল দায়িত্বটা যেহেতু আমারই সেহেতু আমাকেই সবকিছুর ভারটাও নিতে হয়, সব মিলিয়ে আমার ব্যস্ততা বুঝতেই তো পারছেন…।

আপনি তো ডাক্তার, আপনার স্বপ্ন নিশ্চয়ই এরকম ছিলো না, অন্যকিছু ছিলো। কিন্তু এখন জীবনের এই পর্যায়ে এসে এই যে অন্য একটা স্বপ্ন বাস্তবায়ন করছেন, স্বপ্নের এই বদলে যাওয়াটা আপনার কেমন লাগছে?
হ্যা স্বপ্ন অন্যরকম ছিলো, কিন্তু ঘটনাচক্রে এসে পড়েছে এমন পরিস্থিতি, জীবনে তো ঝড় আসেই, সেগুলোর সম্মুখীন হয়েই সামনে যেতে হয়, তাই যাচ্ছি…। কেউ তো কখনো এমন স্বপ্ন দেখেনি যে দীপন এভাবে চলে যাবে, কিন্তু ঘটেছে এমন একটা ঘটনা, তাই আমাকেও করতে হচ্ছে সবকিছু দেখেশুনে রাখতে হচ্ছে এবং আমি অনেকবেশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এই কাজের প্রতি।

তার মানে এখন স্বপ্নের এই বদলেই আপনি এইসব কাজেই শান্তিটা পাচ্ছেন?
না, তা না। এটা আসলে আমার ব্যক্তিগত প্রতিবাদ প্রতিশোধ।

দীপনপুর আপনার প্রতিবাদ?
নিশ্চয়ই। দীপনের নামটাকে আমি মুছে যেতে দিইনি। অন্তত এই রাস্তা দিয়ে যে যাবে দীপনকে স্মরণ করবে, সামনেই দীপনের ছবি আছে, দেখা যাচ্ছে, প্রতিটা জায়গায়ই দীপনকে পাওয়া যাচ্ছে এটাই আমার প্রতিবাদ, দীপন মুছে যায়নি, তাকে কেউ ভুলে যায়নি, যেন না যায় সেই ব্যবস্থার নামই দীপনপুর!

দীপনপুর নিয়ে আপনাদের আর কোন নতুন পরিকল্পনা আছে?
এখন যেটা হয় যে, এটা যথেষ্ট বড় যায়গা কিন্তু তারপরেও হয়কি আমি জায়গা দিতে পারি না, তাই অনেকেই বলেন যেন আরেকটা ফ্লোর নিই বা আরো কিছুটা বড় পরিসরে করি। সেক্ষেত্রে আমরাও ভেবে দেখছি ইনশাল্লাহ! মাত্র তো শুরু হলো, এখনো তো একবছর হয়নি। আরেকটু সময় যাক, তারপর আমরা মিরপুর উত্তরা এসব ব্রাঞ্চগুলোতে কাজ শুরুর কথা ভাবছি।

দীপনপুর বই সংরক্ষণও করছে, অনেকটা লাইব্রেরিও। সেক্ষেত্রে কোন বইগুলোকে আপনারা গুরুত্ব দিচ্ছেন?
আমরা আসলে সব বিখ্যাত প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বইগুলো সংগ্রহ করার চেষ্টা করি, আর বর্তমানের এবং পূর্বের সকল জনপ্রিয় লেখকদের বইগুলোই পাঠকদের জন্য রাখি এখানে।তবে আমি প্রাধান্য দিই বাচ্চাদের বইগুলোকে।

Razia Rahman Jolly at Boimela

এই যে চিলিড্রেনস কর্নার প্ল্যান এটা কোন বিষয়কে মাথায় রেখে করা হয়েছে?
ঢাকা শহরের বাচ্চাদের কিন্তু কোথাও যাওয়ার নেই, ওদের জন্য কোথাও যায়গা নেই বললেই চলে। নীলক্ষেত বাংলাবাজারের মতো জায়গায় গুপচি কোনো গলি বা ঘরে বাচ্চাদের নিয়ে ছেড়ে দেয়া যাবে না, কারণ ওরকম পরিবেশে বাচ্চারা বই পড়া, বই দেখা এসবে একেবেরেই উৎসাহী হবে না। বরং আনন্দময় একটা পরিবেশে যদি ওকে নিমন্ত্রণ করা হয় ও সেটা ভালোভাবে গ্রহণ করবে। তাই বই পাঠের মতো একটা ভালো অভ্যাসের মধ্যে এই বয়সেই ওদেরকে প্রবেশ করাতে হলে সেটা এরকম একটা ভালো পরিবেশ দিয়েই করতে হবে বলেই আমার মনে হয়। ওরা এখানে এসে বই পড়ে, দেখে, ছবি আঁকে। মূলত ওদের ভালো একটা সময় কাটানোর মতো পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে।

বইমেলা তো একেবারেই দোরগোড়ায়, ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবরের আগের বইমেলা আর বর্তমানের মেলা আপনার কাছে কতোটা আলাদা মনে হয় বা কী কী পরিবর্তন এসেছে?
আগের মেলায় যেটা ছিলো যে, কেবলই আনন্দের স্মৃতি। দীপন কাজ করতো আমি মেলা সামলাতাম।দীপন ফ্রি হয়ে আসতো স্টলে। লেখকদের সাথে আমাদের অনেক আড্ডা হতো ভালো সময় কাটতো। ৩১ অক্টবরের পরে ঠিক তিনমাস পরেই যখন একা বইমেলা সামলাতে হয়েছে সেটা এক দুঃসহ স্মৃতি। ভীষণরকমের দুঃসহ ছিলো সেই মেলায় সমস্তকিছু সামলানো। এরপরের যে মেলা সেটাতে আরেকটু গুছিয়ে নিতে পেরেছিলাম নিজেকে সবকিছুর জন্যই এবং কাজেও আরেকটুখানিক স্বস্তি ছিল, কিন্তু এবারই প্রথম আমি সবকিছু বুঝে শুনে জেনে খুঁটিনাটি সমস্ত বিষয়কে মাথায় রেখে অনেকটা স্বাধীনভাবে বইমেলায় থাকছি…।

এতোক্ষণ কথা বলে আসলে যেটা মনে হলো যে, আপনি আসলে দুঃখটাই বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন…।
হ্যাঁ, আমাদের স্টলে সবসময় দীপনের ছবি থাকে। সবসময় যেন পাশেই থাকে, আসলে ওটাই তো আমার জায়গা। সবাইকে আমিও জানাতে চাই হ্যা, জাগৃতি আছে, দীপনকে সাথে নিয়েই আছে। বইমেলায় কেউ আসলে, জাগৃতির স্টলে আসলেই দীপনের ছবিটা দেখবে, শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে এটাই তো আমার চাওয়া…।
Razia Rahman Jolly 2