চাকার ভারসাম্য —প্রণয় শর্মা

988

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশকে শাসন করেছেন দুই নারী। প্রথম জন হলেন খালেদা জিয়া। তিনি একটি দুর্নীতিগ্রস্ত ভারতবিরোধী শাসনামলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তার সহায়তায় ছিল মৌলবাদী ইসলামী গোষ্ঠী জামায়াতে ইসলামী। শেখ হাসিনা যিনি তার পরেই ক্ষমতায় এসেছেন, তিনি তার থেকে খুব ভিন্ন কেউ নন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং ক্রমশ স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে ওঠার অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখতে অঙ্গীকারবদ্ধ। আর সেটাই ভারতের তরফে একজন মিত্র হিসেবে তাকে বেছে নিতে সাহায্য করেছে।

নয়াদিল্লির কাছে শেখ হাসিনাকে সমর্থন দেয়ার অর্থ হলো হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষা করা এবং একই সঙ্গে পূর্বাঞ্চলীয় নিরাপত্তার বিষয়ে ভারতীয় অগ্রাধিকারকে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় রাখা।

কিন্তু একটা অস্বস্তি দানা বেঁধে উঠেছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রতিককালে যখন হেফাজতে ইসলামীর মতো রেডিক্যাল ইসলামী গ্রুপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে দিয়েছেন।

হেফাজত বাংলাদেশে কঠোর ইসলামী আইন, ব্লাসফেমি আইন চালু করার দাবি জানাচ্ছে। এবং তারা একইসঙ্গে ভারতীয় পররাষ্ট্র বিষয়ক স্টাবলিশমেন্ট এবং বাংলাদেশের উদার নৈতিক অংশকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। অনেকেই বিস্ময়ের সঙ্গে
প্রশ্ন তুলছেন যে, ইসলামপন্থিদের সঙ্গে তার এই দহরম-মহরম কেবলই এই বছরের শেষে অনুষ্ঠেয় সংসদীয় নির্বাচন মোকাবিলা করার একটি আওয়ামী পরিকল্পনার অংশ কি-না? সব থেকে খারাপ ভয়টা হচ্ছে, হেফাজত সদস্যরা শেষ পর্যন্ত সরকারি নীতিসমূহের ওপর তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলতে শুরু করে কি-না। আর তখন তা বাংলাদেশি সমাজের বহুত্ববাদী চরিত্র মৌলিকভাবে বদলে দেবে কি-না?

তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে তীব্র বিতর্ক দেখা দিয়েছে। আওয়ামী লীগের অন্যান্য ভেতরের মহলও স্বীকার করছেন যে, প্রধানমন্ত্রীর কৌশল এবং হেফাজত ইস্যু দলের সকল স্তরের মধ্যে একটা টানাপড়েন সৃষ্টি করেছে। সবার ভয় হলো, এই ইসলামী গ্রুপটির সঙ্গে তাদের সম্পর্কের কোনো চিহ্ন থেকে যায় কি-না?

বাংলাদেশের রক্তাক্ত ও গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলা ভাষা একটি বিরাট পরিচিতি তৈরি করেছে; বহির্বিশ্বে নতুন জাতিকে একটি ভাবমূর্তি দিয়েছে। অন্যদিকে তার ইসলামী পরিচিতি, যদিও সেটা নেপথ্যে পর্যবসিত ছিল, সেটা গুরুত্বপূর্ণ রয়ে গেছে। বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যা প্রধান জাতির নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা সচেতন রয়েছেন যে, তার দেশে ইসলাম কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বছরের পর বছর ধরে তিনি এই বিষয়ে একটি ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। উদাহরণ হিসেবে স্মরণ করা চলে, তার শাসনামলে ১৯৭১ সালে ফৌজদারি অপরাধ সংঘটনের দায়ে শীর্ষ জামায়াত নেতাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর (যদিও এ বিষয়ে দেশ-বিদেশের অনেকেই প্রতিবাদ করেছেন) করা হয়েছে। রেডিক্যাল ইসলামী দলগুলোর কাছে তিনি কৃপাহীন শত্রুতে পরিণত হয়েছেন।

বাংলাদেশের এখন অনেকেই আশংকা করেন যে, হেফাজতকে কাছে টানতে গিয়ে সেই ভারসাম্য রক্ষা করার মতো নীতিগুলোতে সংকট তৈরি হচ্ছে। গত জুনে ঢাকা হাইকোর্টের প্রবেশ মুখে স্থাপিত লেডি জাস্টিসের ভাস্কর্য তিনি অপসারণ করিয়েছিলেন। “মূর্তিপূজা”র বিরুদ্ধে হেফাজতের সোচ্চার হওয়ার পরে ওই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। প্রতিবাদের মুখে ওই ভাস্কর্য যদিও অন্যত্র পুনঃস্থাপন করা হয়েছে।

এরপর পাঠ্যপুস্তকে নীরবে পরিবর্তন আনা হয়েছে। সাহিত্য ও ইতিহাসে ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়বস্তু বাদ দিয়ে ইসলামী বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। ভরতচন্দ্র রায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো অমুসলিম জায়ান্টদের লেখা অপসারণ ও প্রতিস্থাপনের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া আরো দেখা গেছে, বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ থেকে তিনি তার নিজ দলের অংশগ্রহণকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। উপরন্তু মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে একীভূত করার দোহাই দিয়ে হেফাজত পরিচালিত মাদরাসার দাওরা-ই-হাদিসকে এখন স্নাতকোত্তর মর্যাদা দেয়া হয়েছে।

২০১০ সালে সৌদি তহবিল দ্বারা চট্টগ্রামে গঠিত মাদরাসা ছাত্র-শিক্ষকদের একটি প্রেসার গ্রুপের নাম হলো হেফাজত। এই সংগঠনটি বিস্তৃত হওয়ার পরে তার সঙ্গে জামায়াতের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে। ২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনকালে সেটার আলামত মিলেছে। শীর্ষ জামায়াত নেতাদের যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসি দেয়ার দাবিতে একটি জাতীয় জনমত গঠনের জন্য ওই আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। হেফাজতের সদস্যরা তখন হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষকদের ঢাকায় জড়ো করেছিল। তারা তখন ঢাকায় স্লোগান তুলেছিল, ‘ইসলাম হুমকির মুখে’। তাদের সেই অবরোধ নিরাপত্তা সদস্যদের কর্তৃক একটি রক্তাক্ত ক্রাকডাউন চালিয়ে ভেঙে দেয়া হয়েছিল। সেই ঘটনায় অনেক রক্ত ঝরে এবং প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।

এটা কৌতূহলের বিষয় যে, কেন শেখ হাসিনা হেফাজতের মতো রেডিক্যাল ইসলামপন্থিদের দাবির কাছে নতি স্বীকার করেছেন? আওয়ামী লীগের অন্দর-মহলের লোকেরা বলেছেন, হেফাজত যাতে জামায়াত এবং বিএনপির সঙ্গে তাদের অবশ্যম্ভাবী আঁতাত গড়ে তুলতে না পারে, তার বিরুদ্ধে এটা একটা প্রচেষ্টা।

শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও তার মন্ত্রীদের অনেকেই দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে জনগণের কাছে পরিচিত হয়েছেন। এই মন্ত্রীরা বাংলাদেশিদের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক নন। আওয়ামী লীগের ভেতরকারসহ অধিকাংশ পর্যবেক্ষক বিশ্বাস করেন, যদি বছর শেষে “অবাধ ও সুষ্ঠু” নির্বাচন হয়, তাহলে আওয়ামী লীগ দলটি হেরে যেতে পারে।
বিএনপির মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘গত দু’বছর ধরে শেখ হাসিনা অস্বাভাবিকহারে অজনপ্রিয় হয়েছেন। এবং তার সহযোগিতা করে ভারতও অজনপ্রিয় হয়েছে। কারণ ভারতকে শেখ হাসিনার সরকারের সমর্থনকারী হিসেবে দায়ী করা হয়।’

ভারতের জন্য শেখ হাসিনাকে অব্যাহতভাবে ‘বেস্ট বেট’ হিসেবেই দেখা হয়। যদিও আওয়ামী লীগ শাসনামলে ব্যাপকভিত্তিক দুর্নীতি, শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী স্টাইল এবং অজনপ্রিয়তার বিস্তার ঘটেছে। তদুপরি তিনি ভারতের নিরাপত্তার স্বার্থ রক্ষা করে চলছেন। তিনি বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতবিরোধী তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত গোষ্ঠীগুলোর নির্মূলে জাগ্রত রয়েছেন। উপরন্তু নয়াদিল্লির সঙ্গে ভারতের অতীত অভিজ্ঞতা বিএনপির সঙ্গে উৎসাহব্যঞ্জক নয়। ভারতকে একটি ন্যাচারাল মিত্র হিসেবে তার সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তুলতে বিএনপির নেতৃবৃন্দের তরফে প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে।

কিন্তু তা সত্ত্বেও অধিকাংশ ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা বিএনপি শাসনে শঙ্কিত। বিএনপি যদি ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারে তাহলে ক্ষমতার উত্তরসূরি হিসেবে পরিচিত খালেদার পুত্র তারেক ক্ষমতায় আসবেন। ভারতীয়রা মনে করেন, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর পাকিস্তানপন্থি অংশগুলোর ওপর তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। আর সবচেয়ে খারাপ হচ্ছে, এটা প্রতীয়মান হওয়া যে, তিনি (তারেক) আইএসের হাতের পুতুল।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘তারেক সব থেকে ভুল বোঝাবুঝির শিকার একজন মানুষ। ভারতীয় স্টাবলিশমেন্টের মধ্যে তাকেই সবচেয়ে বেশি অপবাদ দেয়া হয়ে থাকে। তার কথায়, তিনি সত্যিই অতীতকে পেছনে ফেলতে চান। ভারতের সঙ্গে তিনি একটি নবতর যাত্রা শুরু করতে আগ্রহী। যার লক্ষ্য হবে একটি শক্তিশালী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে তোলা।

খুব অল্প সংখ্যক ভারতীয় পাওয়া যাবে যারা তার এই বক্তব্যকে গ্রহণ করবেন। সাউথ ব্লক বিশ্বাস করে যে, যেদিন বিএনপি নির্বাচনে জয়লাভ করবে পরবর্তী ফ্লাইটে বর্তমানে লন্ডনে নির্বাসিত তারেক ঢাকায় ফিরে আসবেন। আর তাতে শিগগিরই বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মহলগুলো পুনরুজ্জীবিত হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে।

সামনের মাসগুলো বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বেগম জিয়া ঢাকার একটি আদালত দ্বারা পাঁচ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন, তিনি নির্বাচনকালে নির্জন কারাপ্রকোষ্ঠে অতিবাহিত করতে পারেন। ইতিমধ্যে শেখ হাসিনা তার কতিপয় দুর্নীতিগ্রস্ত মন্ত্রীদের ছাঁটাই করার চেষ্টা করতে পারেন। এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য বিএনপি নেতাদের সঙ্গে একটি সংলাপ শুরু করতে পারেন। তবে খালেদা জিয়ার মুক্তি ব্যতিরেকে বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সম্ভাবনা কম। আর বিএনপির অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে ২০১৪ সালের মতোই আওয়ামী লীগ অধিকাংশ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করতে পারে।

কিন্তু তাতে একটি সংসদীয় গণতন্ত্র হিসেবে বাংলাদেশের বিশ্বাসযোগ্যতা বিশ্বের কাছে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এদিকে বিএনপি নেতৃবৃন্দ খালেদার মুক্তির দাবি ও তার সমর্থনে রাজপথে নামতে বাধ্য হতে পারেন। নির্বাচন যেহেতু সন্নিকটে বাংলাদেশ সহিংসতা এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হতে পারে। সেটা যদি ঘটে, তাহলে কি হেফাজত তাদেরকে “মূলধারায়” আনতে শেখ হাসিনার নীতির কথা ভুলে তাদের সাবেক মিত্রদের সঙ্গে যুক্ত হবেন? হেফাজত যাদের শেখ হাসিনা এখন লাই দিচ্ছেন, তারা বিপদে তার পাশে থাকবেই- সেটা এখনই হলফ করে বলা যায় না।