কিং আবদুল্লাহ’র ৩য় মৃত্যুবার্ষিকী আজ

648

কিং আবদুল্লাহ’র ৩য় মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০১৫ সালের এই দিনে মৃত্যুবরণ করেন সৌদি আরবের কিং আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজ। মৃত্যুর মাসখানেক আগে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। তিনি নিউমোনিয়ায় ভুগছিলেন। মৃত্যুর পরদিনই তার নামাজে জানাজা ইমাম তুর্কি বিন আবদুল্লাহ গ্র্যান্ড মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। তার মৃত্যুতে মুসলিম বিশ্বে শোকের ছায়া নেমে আসে। আবদুল্লাহ’র মৃত্যুতে বাংলাদেশেও রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছিল এবং শোক জানাতে প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী সৌদি গিয়েছিলেন। আনুষ্ঠানিকভাবে শোক প্রকাশ করেছিলেন প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাসহ বিশ্ব নেতারাও শোক প্রকাশ করেছেন। বাদশাহ আবদুল্লাহ বিন আব্দুল আজিজকে চির বিদায় জানাতে সেদিন রিয়াদে সমবেত হন লাখো মানুষ। জুমা নামাজের পর রিয়াদের ইমাম তুর্কি বিন আব্দুল্লাহ গ্র্যান্ড মসজিদে জানাজা শেষে বাদশাহ’র মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় সমাধিক্ষেত্রের উদ্দেশে। সৌদি আরবের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিহিত পুরুষরা অংশ নেন শোকযাত্রায়। অনাড়ম্বরভাবে দাফনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলেও কিং আবদুল্লাহকে শেষ বিদায় জানাতে রিয়াদে সমবেত হন বিশ্ব নেতারাও।

এক নজরে আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজ (১৯২৪-২০১৫)

আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজ ছিলেন সৌদি আরবের ষষ্ঠ কিং। ১৯২৪ সালে রিয়াদে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। নিজের বাবার মতো তিনিও ধর্ম, ইতিহাস ও আরব ঐতিহ্যের প্রতি বিশেষ গভীর শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। বেদুঈন উপজাতিদের একজন হিসেবে বহু বছর জীবনযাপন করায় সম্মান, সরলতা, উদারতা ও সাহসে পরিপূর্ণ ছিলেন তিনি। ১৯৬২ সালে কিং ফয়সাল তৎকালীন প্রিন্স আবদুল্লাহকে ন্যাশনাল গার্ডের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। ১৯৭৫ সালে তিনি দ্বিতীয় সহকারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৮২ সালে কিং ফাহাদ সিংহাসনে এলে তিনি পরবর্তী কিং এবং একই সঙ্গে প্রথম সহকারী প্রধানমন্ত্রী হন। এরপর তিনি মন্ত্রিসভার বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন।

তিনি ২০০৫ সালের ১লা আগস্ট সৌদি আরবের শাসনভার গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন কিং ফাহাদ বিন আবদুল আজিজের উত্তরসূরি। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আগে তিনি মন্ত্রিপরিষদের প্রধানমন্ত্রী ও ন্যাশনাল গার্ডের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কিং হিসেবে শাসনভার গ্রহণের পর তিনি দেশজুড়ে ব্যাপক অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামোগত প্রকল্প হাতে নেন। তার উল্লেখযোগ্য অবদানের মধ্যে রয়েছে চারটি বড় শহর প্রতিষ্ঠা, কিং আবদুল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সাইন্সেস অ্যান্ড টেকনোলজি ও প্রিন্সেস নোরা বিনতে আবদুর রহমান ইউনিভার্সিটি ফর গার্লস প্রতিষ্ঠা, পবিত্র দুই মসজিদের বর্ধনমূলক কাজ এবং ব্যাপক কল্যাণমূলক কাজ অন্যতম। তিনি সৌদি আরবের বিচার বিভাগের ঐতিহাসিক স্বীকৃতি, রাজকীয় উত্তরাধিকারী নির্বাচনে আইন প্রণয়ন করেছিলেন তিনি। ২০০৫ সালে ক্রাউন প্রিন্স বা সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে তিনি দেশের পৌরসভা নির্বাচন প্রক্রিয়া ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। বৈশ্বিক পর্যায়ে আরব ও ইসলামের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় রক্ষায় তিনি নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা রেখেছেন। একই সঙ্গে বৈশ্বিক শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য তার অবদান অনস্বীকার্য।

আরব ও ইসলামিক বিশ্বে সংঘাতের সমাধানে তিনি আহ্বান জানিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি বিশেষ করে ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা ছিল তার উদ্বেগের কারণ। ২০০২ সালের বৈরুত আরব সম্মেলনে তিনি এ সম্পর্কে তার পদক্ষেপ তুলে ধরেছিলেন। আন্তর্জাতিক ইস্যুগুলোতে ঐক্যবদ্ধ আরব স্বার্থ রক্ষায় তার দূরদর্শী ভূমিকা ছিল। ফিলিস্তিনে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। একইসঙ্গে সুদান, চাদ ও দারফুরে সমঝোতা চুক্তিতে তার অবদান ছিল। ২০০৮ সালে তিনি জেদ্দা জ্বালানি সম্মেলনের আয়োজন করেন। বৈশ্বিক তেল বাজার স্থিতিশীল রাখতে ওই সম্মেলন আয়োজন করা হয়েছিল। এছাড়া তৃতীয় অপেক সম্মেলন, ১৯তম আরব লীগ সম্মেলন ও ২৭তম জিসিসি সুপ্রিম কাউন্সিলের সম্মেলন আয়োজন করেছিলেন তিনি।

সন্ত্রাসবাদের ইস্যুতে তিনি ছিলেন অটল। নিষ্পাপ মানুষের প্রাণ হরণের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ জানিয়েছেন। ২০০৫ সালে রিয়াদে অনুষ্ঠেয় সন্ত্রাসবিরোধী আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি বৈশ্বিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কামনা করেন। বাদশাহ ও ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে তিনি বহু দেশ সফর করেছেন। বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক বৃদ্ধিতে তিনি কাজ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে কিং আবদুল্লাহর প্রথম আনুষ্ঠানিক সফর ছিল ১৯৭৬ সালে যুবরাজ হিসেবে। সে সফরে তিনি তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দ্বিতীয় সফর ছিল ১৯৮৭ সালের অক্টোবর মাসে। সে সময় তিনি ছিলেন ক্রাউন প্রিন্স অর্থাৎ পরবর্তী কিং। এ সফরে প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ১৯৯৮ সালে তৃতীয় বারের মতো যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন তিনি। এ দফায় প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের সঙ্গে তার বৈঠক হয়। এছাড়া পরবর্তীতে ২০০০ সালে জাতিসংঘে শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে নিউ ইয়র্কে আবারও দেখা হয় ক্লিনটনের সঙ্গে। এছাড়া ২০০২ ও ২০০৫ সালের সালের ২৫শে এপ্রিলে আবদুল্লাহকে টেক্সাসের প্রেসিডেন্সিয়াল র‌্যাঞ্চে আমন্ত্রণ জানান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ।

২০০৮ সালে কিং আবদুল্লাহর আতিথেয়তায় জেনাদ্রিয়াতে রাজকীয় র‌্যাঞ্চে অতিথি হিসেবে দু’বার আসেন প্রেসিডেন্ট বুশ। মরুভূমি আর অশ্ব চালনা নৈপুণ্যের প্রতি কিং আবদুল্লাহর ভালবাসা ছিল। সব থেকে পছন্দ করতেন অ্যারাবিয়ান হর্স। রিয়াদে একুয়েস্ট্রিয়ান ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। জীবনভর তার আরেকটি ভালবাসা ও তীব্র অনুরাগের কাজ ছিল বই পড়া। এতে কিনি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন সবসময়। দুটি বৃহৎ লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। একটি হলো রিয়াদে কিং আবদুল আজিজ লাইব্রেরি। অপরটি মরোক্কের ক্যাসাব্লাঙ্কায়।

তার উল্লেখ্যযোগ্য উদ্ধৃতির মধ্যে একটি ছিল ২০০৭ সালে ১৯তম আরব লিগ সম্মেলনে দেয়া বক্তব্যের কিছু অংশ। তিনি সেখানে বলেছিলেন, পরিত্রাণের পথে প্রথম পদক্ষেপ হলো নিজেদের মধ্যে এবং একে অপরের মধ্যে অন্তর্নিহিত আত্মবিশ্বাস পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। আত্মবিশ্বাস একবার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে এর সঙ্গে আসবে বিশ্বাসযোগ্যতা। আর বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত হলে, বইবে প্রত্যাশার বাতাস। আর সেটা যখন ঘটে, আমরা কখনই তখন অঞ্চলের বাইরের কোন শক্তিতে এর ভবিষ্যৎ নিরূপণ করার সুযোগ দেবো না। তাহলে আরব ভূখণ্ডের ওপর আরবিজম ছাড়া অন্য কোন ঝান্ডা উড়বে না।