কাওরান বাজারে কোটি টাকার চাঁদাবাজি কাদের নিয়ন্ত্রণে?

719

রাজধানীর সবচেয়ে বৃহত্তম পাইকারি আড়ত কাওরান বাজার এখন চাঁদাবাজদের অভয়ারন্য। নানা উপায়ে দিনভর চলে হরদম চাঁদাবাজি। আর এ চাঁদাবাজি অর্থ মাস শেষে দাঁড়ায় কয়েক কোটি টাকার ঘরে। শুধু তাই নয়, টাকার বিনিময়ে সিটি করপোরেশনের পার্কিং স্পটগুলোও এখন নিয়ন্ত্রণ করছে ওই চক্র। সেখান থেকেও মাস শেষে আদায় হচ্ছে কোটি টাকা। সিটি করপোরেশন নামমাত্র টাকা পেলেও বাকিসব চলে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রকদের হাতে।

সরেজমিন কাওরান বাজার ঘুরে ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে বেরিয়ে এসেছে চাঁদাবাজির চাঞ্চল্যকর তথ্য।

কাওরান বাজারে প্রতিদিন অন্তত ৫ হাজার পাইকারের আনাগোনা রয়েছে। পণ্য কেনা, পরিবহনে লোড করা, ভ্যান গাড়িতে পণ্য নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই গুনতে নির্দিষ্ট পরিমাণের চাঁদা। শুধু তাই নয়, পণ্য কিনে ট্রাকে লোড করার জন্য একটি স্থানে সেগুলো রাখার জন্য চাঁদা দিতে হয়। চাঁদাবাজদের দাপটে ব্যবসায়ীরা অস্থির হলেও তাদের কাছে জিম্মি বলে নিরবে চাঁদা দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ফলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্থ হলেও চাঁদাবাজরা তাদের রাজত্ব দিনদিন বড় করেই চলছে।

kowranbazar-6চাঁদবাজরা বেশ কয়েকটি খাত বের করে সেগুলো থেকে নিয়ম করে চাঁদা আদায় করছে। চাঁদা আদায়ের সুবিধার্থে সরকারি দলের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের বিভিন্ন পদও বাগিয়ে নিয়েছে তারা। ফলে তাদের ওপর কথা বলার কেউ নেই কাওরান বাজারে। চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করতে যদিও কেউ আসে, তাহলে তাকে গুনতে হয় চরম মাশুল।

সাধারণত প্রতিদিন কাওরান বাজারে আসা ট্রাক প্রতি চাঁদা তোলা হয় ১শ থেকে ৩০০ টাকা করে। প্রতিরাতে কাওরান বাজারে অন্তত ৪শ ট্রাক পণ্য নিয়ে ঢোকে। গড়ে ২০০ টাকা করে চাঁদা ধরলে এক রাতে ট্রাক থেকেই চাঁদা ওঠে ৮০ হাজার টাকা। ট্রাক থেকে পণ্য নামিয়ে যেসব ভ্যানে তোলা হয় সেগুলোকে চাঁদা দিয়ে হয় ৫০ টাকা করে। কাওরান বাজারে বর্তমানে ৭শ ভ্যান গাড়ি রয়েছে। গড়ে প্রতিরাতে ৪শ ভ্যান গাড়ি চালু থাকলে এ খাত থেকে চাঁদা আসে ২০ হাজার টাকা।সড়ক ও ফুটপাতে ভাসমান দোকানদার কাছ থেকেও আদায় করা হয় মোটা অঙ্কের চাঁদা। সড়ক ও ফুটপাতে প্রতি রাতে এক হাজারের বেশি সবজির অস্থায়ী দোকান বসে। সকাল পর্যন্ত এগুলো চালু থাকা এসব দোকানের জায়গাগুলোও চাঁদাবাজদের নিয়ন্ত্রণে। ফলে দোকান বসাতে হলেও তাদেরকে চাঁদা দিতে হয়। ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, তিন ফুট আয়তনের ভাসমান দোকানের জন্য চার হাজার ও ছয় ফুটের দোকানের জন্য মাসে ১০ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। এ ছাড়া দোকানের জায়গা (ফুটপাত) বরাদ্দ পেতে অগ্রিম দিতে হয় অবস্থানভেদে ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত। মাসিক ভাড়া ছাড়াও প্রতি রাতে বসার জন্য এসব অস্থায়ী দোকানদারদেরকে আরও ৫শ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়।

দিনের বেলা প্রধান চাঁদাবাজি হয় পার্কিংয়ের নামে। পার্কিংয়ের জন্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ১০টি স্পট নির্ধারণ করে সেগুলো ইজারা দেয়। ইজারার নাম করে এসব স্পটে নির্ধারিত ৩০ টাকার পার্কিং ফি আদায়ের বদলে ইচ্ছেমতোন টাকা আদায় করা হচ্ছে। এছাড়াও জনতা টাওয়ার ও ক্রিসেন্ট মার্কেটের সামনে অবস্থান করা পিকআপ থেকে ১৫০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। যা সম্পূর্ণ অবৈধ। পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ভবন থেকে পার্কিংয়ের নামে চাঁদা আদায় করছে এ চক্র। কয়েকটি ভবনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হোটেল লা ভিঞ্চি প্রতি মাসে ২৫ হাজার টাকা, ওয়ান ব্যাংক প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা করে পার্কিংয়ের জন্য দেয়। এসব টাকা সিটি করপোরেশনের বদলে সোজা চলে যায় ইজাদারের পকেটে।

নিয়ন্ত্রক কারা?
বর্তমানে কাওরান বাজারে কাঁচা বাজার, ক্রিসেন্ট মার্কেট, মুরগি বাজারসহ পুরো পার্কিং স্পটগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন শ্রমিক লীগের সভাপতি দাবি করা আবদুল মতিন মৃধা, ২৬ নং ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেন। সেই সঙ্গে রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের কয়েকটি অঙ্গ সংগঠন। তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, লোকমানের একক নিয়ন্ত্রণেই কাওরান বাজারের ৪০ ভাগ অংশ। বাকি ৪০ তেজগাঁও থানা শ্রমিক লীগ সভাপতি মতিন মৃধার কাছে। ২০ ভাগ রয়েছে অন্যান্য সংগঠনদের দখলে।

লোকমান হোসেন কিচেন প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার ব্যবসায়ীদের নিয়ে গঠিত ইসলামিয়া শান্তি সমিতির সেক্রেটারি। ক্রিসেন্ট মার্কেটের পাশে থাকা মাছ বাজারটিও তার নিয়ন্ত্রণে। এমনকি বাজারে নিষিদ্ধ পলিথিন সরবরাহে রয়েছে তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান। তার নিয়ন্ত্রিত প্রতিটি জায়গাতেই নিজস্ব লোক দিয়ে চাঁদা আদায় করে থাকেন এ যুবলীগ নেতা। পাশাপাশি কাঁচা বাজারের চাঁদাও নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি।

অপরদিকে মতিন মৃধা নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে শ্রমিক লীগের পাল্টা কমিটি দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। শ্রমিক লীগের তেজগাঁও আঞ্চলিক কমিটি দীর্ঘদিন ধরে বহাল থাকলেও মতিন মৃধা তেজগাঁও থানা কমিটি নামে নতুন কমিটি অনুমোদন নিয়ে এসেছেন কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে। নিয়ম অনুযায়ী কোনো থানা কমিটি অনুমোদন দেয়া কথা ঢাকা মহানগর কমিটির। কিন্তু টাকার বিনিময়ে সরাসরি কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে মতিন মৃধা তার এ কমিটি অনুমোদন করিয়ে এনেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।

gaza-550x396কাওরান বাজারের পার্কিং স্পটগুলো তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন। গত বছর সিটি করপোরেশন থেকে এক বছরের জন্য পার্কিংয়ের ইজারা পান মতিন মৃধা। এ ইজারা পাওয়ার পেছনে বিপুল অর্থের লেনদেন হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। ইজারা পাওয়ার পর থেকেই তিনি নির্ধারিত পার্কিং ফির কয়েকগুণ বেশি ফি আদায় করে যাচ্ছেন। বাধ্য হয়েই গাড়ির মালিককে সে টাকা গুনতে হচ্ছে। অপরদিকে বর্তমানে টেন্ডার জটিলতায় বর্তমানে পার্কিং স্পট সিটি করপোরেশনে সরাসরি তত্ত্ববধানে থাকলেও সেটা কেবল কাগজে কলমে রয়েছে বলেই জানা যায়। মূলত পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করছেন মতিন মৃধা ও তার লোকজনই।

এসবের সঙ্গে কাওরান বাজারের মাদক ও জুয়ার আসর নিয়ন্ত্রণেও লোকমান ও মতিন মৃধার হাত রয়েছে বলে জানা যায়। কিচেন মার্কেটের তৃতীয় তলায় মাদকের রমরমা ব্যবসা ও রেললাইনের মাদকের ব্যবসার পেছনে রয়েছে লোকমানের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। তাকে চাঁদা দিয়েই চলে এসব। এসবের সঙ্গে পুলিশ ও সরকার দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের যোগ সাজশ আছে বলে অভিযো পাওয়া যায়। এদিকে পুরো কাওরান বাজারে রয়েছে পাঁচটি জুয়ার আসর। এগুলোও নিয়ন্ত্রিত হয় লোকমান ও মতিন মৃধার তত্বাবধানে।

তবে চাঁদাবাজি বন্ধে পুলিশ শক্ত অবস্থানে রয়েছে বলে জানিয়েছেন তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম। তিনি বলেন, “আমরা নিজ উদ্যোগে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ৭টি মামলা দায়ের করেছি। প্রয়োজনে আরও করবো্ চাঁদাবাজি বন্ধে আমরা তৎপর আছি। যতোখানি সম্ভব এটাকে নিয়ন্ত্রণে আনবো।”