পোশাকে পছন্দের ডিজাইন আর রঙ মেখে চলার গল্পটা বাংলাদেশে যারা জনপ্রিয় করে তুলেছেন, তাদের একজন ইয়াসমিন জামান কবিতা। ৯০ দশক থেকে যুক্ত ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের সঙ্গে। শখ থেকে শুরু হলেও ফ্যাশন ডিজাইন একসময় তার পেশায় রূপ নিয়েছে। ডিজাইনারের পাশাপাশি ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছেন পুরোদস্তুর ফ্যাশন উদ্যোক্তা। প্রতিষ্ঠা করেছেন ফ্যাশন হাউজ ‘ভূমিসুতা’। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কবিতা আধুনিক ও মননশীল পোশাকের পসরা যেমন তুলে ধরছেন তেমনি কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছেন ৩ শতাধিক মানুষকে। রাজধানীর প্রতিবেশি জেলা নারায়ণগঞ্জের নারী উদ্যোক্তার কাতারে তাই তার নামটিই এখন সবার শীর্ষে। উদ্যোক্তা, ফ্যাশন ডিজাইন ও প্রাসঙ্গিক নানা বিষয় ইয়াসমিন জামান কবিতা আলাপ করেছেন ‘এখন’-এর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্টাফ রিপোর্টার- শুভ্র সুহৃদ।

এখন: ফ্যাশন ডিজাইনার থেকে উদ্যোক্তা। শুরুর গল্পটা বলুন।

ইয়াসমিন জামান কবিতা: আমি যখন ক্লাস এইটে পড়তাম, তখন থেকেই নিজের ড্রেস ডিজাইন নিজে নিজে করতে শুরু করি। নিজের করা ডিজাইনের জামা পড়ে সবখানে যেতাম। সবার প্রশংসা পেতাম। সে অনুপ্রেরণায় আমার বোনদের ড্রেস ডিজাইনও আমি করতে শুরু করি। খুব আনন্দ লাগতো এ কাজটি করতে। একসময় শখের এ কাজটি আমাকে ফ্যাশন ডিজাইনার বানিয়ে দিয়েছে। তারপর এ বিষয়ক বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণ নিয়েছি। ব্যাস, এভাবেই একসময় পেশাদার ফ্যাশন ডিজাইনার হয়ে উঠেছি। এ পেশায় যুক্ত হয়ে আমি সে সময় দেশের প্রথম সারির ফ্যাশন রঙ-এর সঙ্গে কাজ করতে শুরু করি। রঙ-এর পোশাক ডিজাইনের পাশাপাশি তাদের ড্রেস সরবরাহও করতাম। পরবর্তীতে বেশ কিছু সময় রঙ-এর হেড অব প্রোডাকশন ও ডিজাইনার হিসেবেও কাজ করেছি।

এখন: এ পেশায় কাজ করতে কেমন লাগছে?
কবিতা: একটা সময় আমি শুধুই ফ্যাশন ডিজাইনার ছিলাম। সময়ের আবর্তনে এখন আমি একজন উদ্যোক্তাও। ভূমিসূতা নামে আমার প্রতিষ্ঠানটির ব্র্যন্ডিং করা শুরু করি ২০১১ সাল থেকে। মানুষের সাড়া পাচ্ছি। সবাই উৎসাহ দিচ্ছেন। আমার কাছ থেকে এখনও বড় বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পোশাক ডিজাইন ও প্রোডাক্ট নেয়। দারুণ ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়। তবে আমি যেহেতু নতুন নতুন সৃষ্টি নিয়ে কাজ করতে আনন্দ পাই, সেজন্য কাজের কষ্ট আমার কাছে কষ্ট মনে হয় না, আনন্দই লাগে।

26540185_10208472062798553_1909522702_oএখন: নারী উদ্যোক্তাদের জন্য তো এখনও অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়নি বলে কেউ কেউ দাবি করেন। আপনি কী মনে করেন? 
কবিতা: প্রতিকূলতা তো আছেই। সব কাজেই নানান ধরণের প্রতিকূলতা থাকে। আর নারীদের প্রতিকূলতা একটু বেশিই। তাদের জন্য পুরোপুরি উপযোগী পরিবেশ এখনও তৈরি হয়নি। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নারীবান্ধব কাজের পরিবেশ কিছুটা তৈরি হচ্ছে। এক্ষেত্রে নারীদের আরও বেশি এক্টিভ হতেহবে। আর আমার প্রসঙ্গে এলে বলতে হবে, আমি সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে একটি লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কাজ করি। এতেই আমার আনন্দ। আমি বিশ্বাস করি, আমি সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো।

এখন: উদ্যোক্তা হিসেবে কী ধরণের সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে?
কবিতা: সমস্যার তো শেষ নেই। সমস্যাকে সমস্যা হিসেবে দেখতে সেটা জেঁকে বসবেই। আমি মনে করি, প্রতিদিনের সঙ্গে নিজেকে আপডেট রাখা খুব জরুরি। নিজের বেলাই সেটা করি। তাই কোনো সমস্যা স্থায়ী হয়ে আমার সঙ্গে থাকতে পারে না। আমাকেও বড় কোনো সমস্যা আটকে রাখতে পারে না।

26513542_10208472063038559_1036624910_oএখন: পরিবারের সহযোগিতা পেয়েছেন?
কবিতা: পরিবারের সাপোর্ট ব্যবসার জন্য খুবই প্রয়োজন। অনেক উদ্যোক্তা এ সাপোর্ট পরিবার থেকে পায় না। কিন্তু আমি পুরোপুরি সাপোর্ট পেয়েছি। আমার বাবা হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, আমার সৃষ্টির নেশা আছে। সেজন্যই আমি যখন ইন্টারমেডিয়েট প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তখনই আমাকে বিসিকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। আম্মাও এক্ষেত্রে অনেক সাপোর্ট দিয়েছে। পরবর্তীতে আমার হাজবেন্ডের আন্তরিক সাপোর্ট আমাকে নিরলসভাবে কাজ করার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। আমার নিজেকে অনেক বেশি লাকি বলতে হবে যে, আমার পরিবারের সমর্থন, সহযোগিতা সবসময়ই্ আমার সঙ্গে আছে। সেজন্যই এখনও মাথা উঁচু করে কাজ করে যেতে পারছি। আল্লাহর কাছে এজন্য অনেক শুকরিয়া।

এছাড়াও এমন দু’একজন কাছের মানুষ আমি পেয়েছি, যাদের নিঃস্বার্থ ও অকৃত্রিম ভালোবাসায় আমি আমার সামগ্রিক কর্মকাণ্ড নিয়ে এতোদূর আসতে পেরিছি। তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন না থাকলে এ পথ পাড়ি দেয়া আরও অনেক বেশি কঠিণ হতো।  তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা।

এখন: ফ্যাশন ডিজাইনার ও উদ্যোক্তার বাইরে আপনি একজন মা। আপনার সন্তানদের দেখভাল করেন কীভাবে?
কবিতা: আমার দুই মেয়ে। দুটোর সঙ্গেই আমার সম্পর্ক বন্ধুর মতো। কাজের ফাঁকে যতটুকু পারি, তাদেরকে সময় দেই। তারাও আমাকে অসম্ভব বোঝে। আমি তাদের দেখভাল আর যত্ন না নিতে পারলেও তারাই মূলত আমাকে টেক কেয়ার করে।

26610855_10208472061158512_309569492_oএখন: ইদানিং অনেকেই উদ্যোক্তা হতে এসে ঝরে পড়ছে। কী কারণ?
কবিতা: আজকাল অনেকেই ব্যবসা করতে এসে বেশিদিন টিকতে পারছেন না, এটা সত্যি কথা। এর পেছনে প্রধান যে কারণটি আমি মনে করি, সেটি হচ্ছে- অল্প সময়ে সবাই অনেক টাকার মালিক হতে চায়। তাদের ধৈর্য কম, সহনশীল না। তারা মনে করে, ব্যবসা করলেই দ্রুত টাকা আসতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা অন্যরকম। ব্যবসা হচ্ছে, বৈধ উপায়ে ইনকামের একটি মাধ্যম। কিন্তু তারা এত দ্রুত রেজাল্ট পেতে আগ্রহী হয়ে উঠে যে, একসময় ব্যবসার খেই হারিয়ে ফেলে। আর বেসিক নলেজ না নিয়েই অনেকে ব্যবসা করতে নামে। এজন্যই মূলত, দ্রুত এসে দ্রুত গুটিয়ে ফেলে।

এখন: নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
কবিতা: উদ্যোক্তা হতে হলে ধৈর্য রাখতে হবে সবার আগে। পাশাপাশি কোন সেক্টরে কাজ করবো, সে বিষয়ে সাম্যক ধারণা থাকা জরুরি। হুট করে কোনো কিছুতে না নেমে বুঝে শুনে, মার্কেট যাচাই করে ব্যবসায় নামা উচিত। সময় অবশ্যই কাজের মূল্য দেয়। সুতরাং কাজটাকে ভালোবেসে মন থেকে করলে এর রিটার্ন একসময় পাওয়া যাবেই।

এখন: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার কথা নতুনদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
কবিতা: ধন্যবাদ আপনাদেরকেও। ভালো কাজের সঙ্গে থাকবেন। শুভকামনা।