হাসপাতালে রোগীর সম্মান কি কেউ রাখে | সোমা মুখোপাধ্যায়

1048
সোমা মুখোপাধ্যায়

ডাক্তার জানিয়েছিলেন, কোনও ওষুধেই সাড়া দিচ্ছেন না রোগী। ‘মিরাকল’ ছাড়া সেরে ওঠার আশা নেই। অথচ রোগী সজ্ঞানে রয়েছেন। তাঁর মস্তিষ্ক কাজ করছে। এই পরিস্থিতিতে সন্তানের হাত ধরে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো। প্রতি দিন এই অসম্মান সহ্য করতে পারছি না।’’

কীসের অসম্মান? খোঁজ নিয়ে সন্তান জেনেছিলেন, মৃত্যু পথযাত্রী রোগীদের কার্যত ‘খরচের খাতা’য় ফেলে দিয়ে যে ভাবে অধিকাংশ হাসপাতালে তাঁদের দৈনন্দিন পরিচর্যা চলে, তা চমকে ওঠার মতো। শরীর স্পঞ্জ করানো, শৌচকর্ম করানোর ক্ষেত্রে ন্যূনতম আব্রু রাখা হয় না বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। ফলে প্রতি মুহূর্তে সঙ্কোচে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে চান রোগীরা। বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি এক রোগিণীর মেয়ে জানিয়েছিলেন, তাঁর মা মৃত্যুর দু’দিন আগে বলেছিলেন, স্পঞ্জ করানোর নামে তাঁকে নগ্ন করে ফেলে রাখা হয়। কে স্পঞ্জ করাবে, তা নিয়ে চলে টালবাহানা। ওয়ার্ডে অবাধে হাসপাতালের কর্মীরা যাতায়াত করেন। সকলের চোখের সামনে নগ্ন অবস্থায় পড়ে থাকতে হয় তাঁকে। প্রতিবাদ করলে কেউ উত্তরই দেয় না। মলমূত্র ত্যাগ করার পরেও একই অবস্থা। এমনকী, ভেজা চাদরও সময়ে বদলানো হয় না। যে রোগীর সুস্থ হয়ে ওঠার প্রায় আশা নেই, তাঁর সঙ্গে এমন আচরণের অলিখিত সিলমোহরই যেন দেওয়া রয়েছে সর্বত্র।

তবে এই প্রসঙ্গ প্রায় কোনও সময়ে সামনে আসে না। নার্সদের এ বিষয়ে সংবেদনশীল করানোর জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ বা কর্মশালা করানোর কথা ভেবেই দেখেন না হাসপাতাল কর্তারা। রোগী স্বার্থে কাজ করা সংগঠনগুলিকেও এ ব্যাপারে সরব হতে দেখা যায় না।

 পরোক্ষ নিষ্কৃতি মৃত্যু এবং তার জন্য আগাম উইল করার অধিকারকে আইনি স্বীকৃতি দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। তার পরেই প্রশ্ন উঠেছে, সম্মানজনকভাবে মৃত্যুর অধিকারকে না হয় স্বীকৃতি দেওয়া হল, কিন্তু চিকিৎসা চলাকালীন সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত হবে কী ভাবে।

সোমা মুখোপাধ্যায়

ক্যানসার চিকিৎসক স্থবির দাশগুপ্ত মনে করেন, একজন মানুষ জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছেছেন জানার পরেও তাঁর দেহ এবং মনের শুশ্রুষার যে প্রয়োজনীয়তা রয়েছে সেই বোধই গড়ে ওঠেনি। তিনি বলেন, ‘‘একজন অসুস্থ মানুষ হাসপাতালে পৌঁছনোর পরে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁকে চিকিৎসক এবং অ-চিকিৎসক কর্মচারীদের কাছ থেকে যে ব্যবহার পেতে হয়, তার পরে চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগীর সম্ভ্রমের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে তা আশা করা যায় না।’’

চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরীর আক্ষেপ,  ‘‘যেখানে বাঁচাটাকে সুন্দর করে তোলার জন্যই উদ্যোগ নেই, সেখানে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ সম্ভ্রম পাবেন সে আশা করি কী করে?’’

একাধিক বেসরকারি হাসপাতালের কর্তাদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গিয়েছে, এই বিষয়টি এখনও তাঁদের ভাবনায় নেই। বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালের কর্তা যেমন বললেন, ‘‘চাহিদার তুলনায় নার্সের সংখ্যা কম। ভিন রাজ্য থেকে নার্স আনতে হয়। তাঁরা অনেকেই স্থানীয় ভাষা বোঝেন না। সেই সমস্যায় জেরবার হয়ে যাই। এর ওপর রোগীর সম্ভ্রমের ব্যাপারটা নিয়ে আলাদা করে ভাবার অবকাশ কই?’’ আর নার্সদের সংগঠন নার্সেস ইউনিটি-র সহ সম্পাদক ভাস্বতী মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমরা ‘সফট টার্গেট’। দোষ চাপানো সহজ। রোগীদের যত্ন আমরা ছাড়া আর কে নেয়? শুধু মুমূর্ষু নন, মৃত্যুর পরের পরিচর্যাও নার্সরাই করেন। সসম্মানেই করেন।’’

সৌজন্যে : আনন্দবাজার পত্রিকা