ভূতের সঙ্গে দোস্তি আর আপনাদের নিরাপদ থাকা

1133

শারমিন শামস্।।

পাশের বাড়িতে ত্রুটিপূর্ণ গ্যাসলাইন থেকে আগুন লাগে, পুড়ে ছারখার হয়ে যায় কয়েক যুগের সংসার, পুড়ে মরে যায় আপনজন। সহকর্মীর সন্তানকে অপহরণ করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্ত, নদীতে ভেসে ওঠে লাশ। প্রিয় বন্ধুর ছোট ভাইকে পেছন থেকে চাপাতির কোপে রক্তাক্ত মৃত্যু উপহার দিয়ে যায় আততায়ী। পরমাত্মীয়র বোনকে অফিস থেকে ফেরার পথে তুলে নিয়ে যায়, সারা রাত ধর্ষণ করে ফেলে রেখে যায় রেললাইনের পাশে, মৃত। আর আমি? আমি প্রতিদিন পত্রিকার পাতায়, টেলিভিশনের পর্দায় পরখ করি, কে কতটা ভালো কাভারেজ দিল, কোন সাংবাদিক কী প্রশ্ন করল!

আপনি কী করেন? আপনি ধোয়া পাঞ্জাবি পরে মন্ত্রণালয়ে আসেন, মিষ্টি কেক, শিঙাড়া আর চায়ের সঙ্গে মিটিং করেন ঘণ্টা তিনেক, তার পর বের হয়ে গণ্ডাখানেক ক্যামেরার সামনে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করেন মিনিট তিনেক।

আপনারা কী করেন? আপনারা সাংবাদিক ডাকেন, প্রেস কনফারেন্স করেন, তার পর আপনাদের নিধিরাম সর্দারদের নিয়ে বেরিয়ে যান অভিযানে। অভিযান শেষ করেন গোটা দশেক গোলাবারুদ, চারটি জংধরা চাপাতি আর তিনটা জিহাদি বইসহ ফটোসেশন করে। আর দশখান পাতি আর পোনা জঙ্গিরে ক্রসফায়ারে দিয়ে দলীয় বাহবা নিয়ে বড় বড় ঢেঁকুর তুলতে থাকেন।

এবার আপনাদের ঘরে আগুন লেগেছে। মিতু নামের একটা নিষ্পাপ মেয়ে, দুইটা ফুটফুটে ছোট্ট বাচ্চার মা খুন হয়েছে। আপনাদের ঢেঁকুর এবার গলায় আটকে গেছে। আপনারা এবার নড়েচড়ে বসেছেন। ঢাল-তলোয়ার নিয়ে গর্জন ছাড়তে ছাড়তে বেরিয়ে পড়েছেন। কিন্তু হায়! একটু দেরি হয়ে গেছে না ভাইয়েরা আমার? আপনি না হয় বসে ছিলেন এত দিন, পানের রসে আয়েশ করে নাক ডেকেছেন, দীপনের মা-বাপ, ওয়াশিকুরের বোন, অভিজিতের স্ত্রীর কান্না আপনাদের নিতান্তই ঘ্যানঘ্যানানি বলেই মনে হয়েছে এতকাল। এখন হঠাৎ মিতুর বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে নিজের নার্সারি পড়ুয়াটার কথা ভেবে হাত-পা ঝাড়া দিলেই তো আর ফুস মন্তরে সব পাল্টে যাবে না! এরা তো আর আপনাদের মতো পান খায়নি, ঘুম দেয়নি, যোগসাজশের রাজনীতি করেনি। এরা এদের কাজ করেছে নিবিষ্ট মনে। শান দিয়েছে চাপাতিতে। ট্রেনিং করেছে, নেটওয়ার্ক গড়েছে, অস্ত্র এনেছে। আপনি কী করেছেন? আপনি তথ্য সংগ্রহ করেছেন। সেই তথ্য দিয়ে শিঙাড়ার পুর বানিয়ে প্রাণ টেমেটো কেচাপে ডুবিয়ে, দলবল নিয়ে নিয়ে খেয়েছেন সব। আর বলেছেন, দেখি না কী হয়!

আর এখন লেজ উঁচিয়ে পুটুস-পাটুস চাইছেন। এখন দেখছেন, মিতু গেল। কে জানে, কাল কে যাবে। ওদের নজর এখন সংখ্যালঘু বলে যাদের ডাকেন, তাদের দিকে। যে লোকগুলো দিন আনে দিন খায়, একা পথ চলে, হেঁটে পথ পাড়ি দেয়, যাদের গাড়ি নেই, প্রটোকল নেই, পুলিশ দারোয়ান নেই, আপাতত এরা মরছে। এটা দ্বিতীয় স্তর বলতে পারেন। তৃতীয় স্তরে কে আছেন? তা জানি না। তবে এইটুকু বুঝি, কোনো একটা স্তরে আপনি এবং আপনারা আছেন। যাঁরা ভাবছেন, প্রটোকল আছে, দারোয়ান আছে, ক্ষমতা আছে। যাঁরা ভাবছেন, আপনারে কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না। কিন্তু এটা তো বুঝেছেন নিশ্চয়ই, সরিষার ভেতরে ভূতটাই এবার নড়েচড়ে বসেছে। সরষের ভেতরের ভূতই সব সময় কাম সারে। সরিষার ভূতকে আপন ভেবেই আমরা বুকে জড়িয়ে রাখি। তার পর সেই ভূত যখন রাতের বেলা ঘাড় মটকে দেয়, তখন ক্যাবলা হয়ে যাই। ইতিহাস যুগে যুগে এই কথাই বলে।

সরষের ভেতরের ভূত তাড়ানোর কথা যখন বলে বাবুল আক্তারকে সরিয়ে দেওয়া হয়, তাঁর মতো যারা আসল খবর জানে, তাদের চুপ করিয়ে দেওয়া হয়। তারপর কামাল সাহেব বাসায় গিয়ে দুপুরে ঘুমিয়ে উঠে দেখেন আবহাওয়া আজ চমৎকার। বিকেলে চা খেয়ে তিনি অনুভব করেন, ঘুমটা খুব শান্তির ছিল। ওনার বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে থাকা সাংবাদিকদের ডেকে নেন কাছে। বলেন, হুদাই টেনশন করো, দেশের মানুষ শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। দেখো, আজ দুপুরে কত ভালো ঘুমালাম! বুঝি না বাপু, তোমরা কেন বারবার এত প্রশ্ন করো, যাও নিজের কাজে যাও, আজ থেকে এ দেশে জঙ্গি বলে কিছু নেই।

সাংবাদিকরা বলে, তবে মিতু? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, না না, ওরা ছাড়া পাবে না। ওরা বেডরুমের বাইরে মেরেছে মিতুকে। অতএব, এবার রাষ্ট্র নড়েচড়ে বসবে।

সাংবাদিকরা যার যার হাউসে এসে রিপোর্ট তৈরি করে ফেলেন। এসব রিপোর্টে জানিয়ে দেওয়া হয়, আগামীকাল সকাল ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর, মিরপুর ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় জঙ্গি দমনে সাঁড়াশি নিয়ে অভিযান চলবে। রিপোর্ট কার চেয়ে কোনটা বেশি ভালো হয়েছে, এ নিয়ে গবেষণা চলতে থাকে।

এদিকে, হিন্দু পুরোহিত, যে কি না ডায়াবেটিস ছিল বলে রোজ সকালে হাঁটতে যেত, সেই নিতান্ত গোবেচারা সাদাসিধে লোকটার ঘাড় ঘ্যাচাং করে ফেলে গেছে ওরা, সকাল সকাল। এলাকা পাবনা। কাল ছিল দিনাজপুর, পরশু ঝিনাইদহ, তার আগের দিন চট্টগ্রাম। এবার কবে সচিবালয়, মিন্টো রোড, সংসদ ভবনের দিকে যাত্রা করবে, কে জানে!

সরষের ভেতরের ভূতই জানিয়ে দেবে আপনি কখন ঘুমান, কখন জাগেন, কখন একটু পান-টান করেন, কখন কাঁদেন, কখন হাসেন। কেননা, ওই ভূতকে জড়িয়ে ধরেই তো হাসা-কাঁদা করছেন। ভূত আপনারে মাথায় হাত বুলায়ে চুমু খাচ্ছে দুই বেলা। তাই আপনার মনে হচ্ছে, আপনি ভালো আছেন, আপনি মিতু না, আপনি অভিজিৎ না, আপনি দীপন না, আপনি নিত্যরঞ্জন না। আপনি দুর্গে বসে আছেন। এই দুর্গ ভাঙার সাধ্য কারো নাই। আপনেরে নিয়া আমরাও ভাবতাম না। কেননা, আমরাও আপনার মতই নিজেরে নিয়ে থাকা মানুষ। তবে সমস্যাটা হলো, শেষ আঘাতটা আপনার ওপরে যেদিন আসবে, সেদিন আর বাংলাদেশ বলে পৃথিবীতে কিছু থাকবে না। যা থাকবে, তা এক রক্তাক্ত ক্লেদাক্ত ভূমি। সেখানে হামাগুড়ি দেবে আমাদের আত্মা। সেই দিনটা একটু একটু করে কাছে আসছে। সেই দিনটা শান্তির ঘুমে ভর করে এসে ডানা ঝাপটাচ্ছে জাতীয় পতাকার ছায়ার নিচে! যদি সত্যই চোখ মেলেন, দেখবে পাবেন!