ভালোবাসা আব্বু

ভায়লা সালিনা লিজা

2115
১৯শে মার্চ নিউইয়র্কে প্রথম পা রেখেছি। আমার মেয়ে তখন দু’বছরের; আমিও ছোট। এয়ারপোর্টে এসে পা রাখলে আনন্দে আর ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠে আমার সবচে প্রিয় মানুষটিকে দেখব বলে। ইমিগ্রেশন শেষ করে মেয়ের হাত ধরে বড় ভাইয়ের সাথে এয়ারপোর্টের বাহিরে বেরিয়ে আসি। মেয়ে হঠাৎ আমার হাত ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে কার কোলে যেন চলে গেলো। অতকিছু খেয়াল করিনা; আমার পিপাসার্ত দু’চোখ তখন প্রিয়জনকে খুঁজছে পাগলের মতো। ভাইয়া বুঝতে পেরে আমার কাছে এসে বলে কাকে খুঁজিস? দেখতো তোর মেয়ে কার কোলে? আমি সাথে সাথে তাকাই। মেয়ে তখন বেইজ কালারের লম্বা ওভারকোট মাথায় ওয়েস্টার্ণ হ্যাট পড়া এক ফরেনারের কোলে! আমি তাকিয়ে আছি তিনিও তাকিয়ে আছেন। আমি মেলাতে পারিনা। অবাক দৃষ্টিতে হাঁ করে তাকিয়ে আছি। কাছে এসে আমার মুখে হাত বুলায়ে দেখেন। হাতের আঙুল ছুঁয়ে বলেন কত বড় হয়ে গেছে আমার মা। আমি শুনে মুখের দিকে তাকিয়ে আব্বু বলে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকি। বড় ভাইও কান্না লুকাতে পারেনা। এতগুলো বছর পর আব্বুকে দেখি। আরো সুন্দর হয়ে গেছেন। যেন কোন ফরেনার ভদ্রলোক।
আব্বু যিনি সারাজীবন নিজের সুখের চেয়ে ছেলেমেয়ের প্রতি কর্তব্য পালনকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। যাঁর হাত ধরে আমার প্রথম হাঁটতে শেখা, প্রথম বায়না, আদর্শলিপির প্রথম বর্ণমালা পরিচয়ের শিক্ষক, প্রথম রূপকথার গল্প-ছড়া শেখা, এমনকি প্রথম মনখারাপ করা; এসবকিছুই আব্বুর সাথে। আমার পুরো জগত জুড়েই ছিলেন আব্বু। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন আমার সবচে কাছের বন্ধু। এমন বন্ধু আর দ্বিতীয়টি হয়না। আমার সকাল থেকে রাতে ঘুমোতে যাবার আগে পর্যন্ত আব্বু ছিলেন রুটিনে বাঁধা। ভোরে আস সালাতুম মিনান নাউম শুনে জেগে নামাজ শেষ করে, সকালে আলিফ বা তা সা’র পর সুর সাধনা করে, সূর্য উঠার পর তেল মাখিয়ে রৌদ্রে বসিয়ে দেয়া, দুপুরে খাবার খাওয়ায়ে ভাতঘুমের পর বিকেলে কখনও সাইকেল চালাতে, দৌড়ঝাঁপ করে, কখনওবা এক্সিভিশনে, চারুকলায়, শিশু একাডেমি, শিশু পার্কে কাটিয়ে অথবা কোন মঞ্চনাটক দেখাতে নিয়ে অবশেষে ফিরে আসার পর মাগরিবের নামাজ পড়া শেষ করে আব্বু ছিলেন আমাদের তিন ভাইবোনের শিক্ষক।
এভাবেই পাশাপাশি দুটো জীবন কাটিয়ে দেই; আমরা ভাইবোনেরা শিশু জীবন থেকে যাই কৈশরের দিকে আর আব্বু আম্মা যান প্রৌঢ়ত্বের দিকে হাত ধরাধরি করে। সুখে রাখার সমস্ত কায়দা আব্বু শিখে আমাদের দিয়ে রেখেছিলেন। বড়ভাইকে আমেরিকায় পাঠিয়ে কিছুদিন পর আমি আর আমার ছোট ভাইয়া কিছু বুঝার আগেই যখন সবাইকে রেখে সুদুর আমেরিকায় নিজেই পাড়ি জমালেন তখন বুঝতে পারিনি এতগুলো বছর একা কাটিয়ে দিব। আব্বুকে ছাড়াই বিয়ের পিঁড়িতে বসি। বিয়ের পর তিন বছর শ্বশুর বাড়িতে জীবনের সাথে বহু লড়াইয়ের পর মেয়েকে নিয়ে যখন আমেরিকায় আসি তখন আমার আব্বুকে এক নতুনরূপে দেখি। আমি আর শৈশবের আব্বুকে মনে করতে পারিনা। যেন এটাই আমার নতুন আব্বু। সংসারে যিনি বিভিন্ন চক্রের মিছিল করে যাচ্ছেন। আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্নায়, মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে; কখনও হাহাকার করতে করতে। এক দুয়ারে প্রবেশ তো অন্য দুয়ারে নিষ্ক্রমন। বিপুল বিশাল সুখ শুধু বিলিয়ে গেলে, নিজে ছিটেফোঁটা কিছুই নিলে না। আজীবন কর্তব্যের ছাতা মেলেই বসে আছো। তুমি শুধু একজনই ভালোবাসা আমার আব্বু।
লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী কবি ও লেখক
LikeShow More Reactions

Comment