নিবন্ধিত দলে ভিড়ছে জামায়াত!

1144
জামায়াতে ইসলামীর নতুন লোগো। মঙ্গলবার বিবৃতিতে প্যাডে এই লোগো ব্যবহার করা হয়েছে।

এখন ডেস্ক।।

লাল-সবুজের নতুন লোগো সংবলিত প্যাডে বিবৃতি পাঠানোর একদিন পর তা ‘ভুল বোঝাবুঝি’ বলে দাবি করেছে জামায়াতে ইসলামী। একইসঙ্গে দলটির কোনও লোগো নেই বলেও জানানো হয়েছে। যদিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে জামায়াতের একটি পরিচিত লোগো ব্যবহার করা হয়। দলটির নেতাকর্মীরাও তা ব্যবহার করেন। লোগোকাণ্ডের বিষয়টি নিয়ে রাজনীতিবিদরা বলছেন, এটি দলটির পছন্দের যেকোনও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের ভিড়ে যাওয়ার কৌশল হিসেবে। তাদের মতে, দলটি বর্তমান সরকারের সময়ে নিষিদ্ধ হলে জামায়াত হয়তো আর নতুন নামে আসবে না। এর পরিবর্তে নিবন্ধিত পছন্দের নিষ্ক্রিয় কোনও দলের ব্যানারেই রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করবে জামায়াত। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

অনেকটা হঠাৎ করেই দলীয় প্যাডে লাল-সবুজের লোগো লাগিয়ে বিবৃতি দেওয়ার একদিন পর তা ‘লোগো নয়’ বলে জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির দাবি, এতে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে এবং জামায়াতের কোনও লোগো নেই। যদিও বিগত বছরে ব্যবহৃত লোগোয় আরবিতে ‘আক্বিমুদ্দিন’ লেখা ছিল। গম্বুজের ভেতরে আল্লাহু শব্দের মধ্যে ‘দাঁড়িপাল্লা’ প্রতীক ছিল। এই দাঁড়িপাল্লাই দলটির নির্বাচনি প্রতীক। আগের প্যাডে কালো রঙে দলের নাম থাকলেও নতুন প্যাডে লাল অক্ষরে নাম ব্যাকগ্রাউন্ড করা হয়েছে। পাশাপাশি প্যাডের ওপরে সবুজ রঙে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী লেখা হয়েছে।

এর আগে মঙ্গলবার দুপুর ২.২৯ মিনিটে লাল সবুজের লোগো সম্বলিত বিবৃতি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। ওই বিবৃতি নিয়ে বাংলা ট্রিবিউন জামায়াতের একাধিক দায়িত্বশীলের বক্তব্য নিয়ে ‘‘জামায়াতের লোগো পরিবর্তন: ‘আক্বিমুদ্দিন’-এর বদলে লাল সবুজ’’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

লোগোবিহীন প্যাডে জামায়াতের বিবৃতি

বুধবার দুপুর ১১.৫৬ মিনিটে পাঠানো মেইলে জানানো হয়, মঙ্গলবার পাঠানো বিবৃতিতে নতুন লোগোর বিষয়টি ভুল বোঝাবুঝি এবং জামায়াতের কোনও লোগো নেই।

দলের প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি অধ্যাপক তাসনীম আলম বিবৃতিতে বলেন, ‘কোনও সংগঠনের গঠনতন্ত্রই লোগো বহন করে। সর্বশেষ সংশোধিত গঠনতন্ত্র যা নির্বাচন কমিশনে জমা আছে, তাতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কোনও লোগো নেই এবং বর্তমানেও আমরা নতুন কোনও লোগো চালু করিনি। তাই আমাদের এ বক্তব্যের পরে আশা করি এ সংক্রান্ত সব ভুল বোঝাবুঝি দূর হবে।’

লোগোকাণ্ডের নেপথ্য কাহিনি

বুধবার বিবৃতিতে নতুন লোগোর বিষয়ে অস্বীকার করে বিবৃতি পাঠানোর পর দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলা হয়। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিগত দিনের স্ট্যাটাস দেখা হয়। স্ট্যাটাসে স্বয়ং ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানের বিবৃতি প্রচারেই তার ছবির সঙ্গে বিগত দিনের লোগোর ব্যবহার দেখা গেছে।

২০১৫ সালের ১১ অক্টোবর কর্মসূচি দেওয়া হয় এই লোগো ব্যবহার করেইবিগত আট বছর ধরে জামায়াতের সব ধরনের খবরে আগের লোগোটি ব্যবহার করা হলেও দলের তরফে কোনও অবস্থান ব্যক্ত করা হয়নি। যদিও বুধবার জানানো হয়, জামায়াতের কোনও লোগোই নেই। যদিও গত বছরের জুনে সংশোধিত সর্বশেষ গঠনতন্ত্রে কোনও লোগোর কথা বলা নেই।

নেতাকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীরা জানাচ্ছেন, ‘আক্বিমুদ্দিন’ লেখা লোগোটিই জামায়াতের বলে পরিচিত। এ ব্যাপারে তারা বিগত বছরগুলোয় এর সঙ্গে পরিচিত। মঙ্গলবার নতুন রঙের প্যাডে বিবৃতি আসার ঘটনায় দলের ভেতরে-বাইরে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে।

পল্টন থানা জামায়াতের এক কর্মী জানান, জামায়াত ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিচ্ছে নিষিদ্ধ হলে করণীয় নিয়ে। তো এটা হতে পারে নতুন কোনও লোগো করা ছিল প্যাড। হয়তো ভুলে সেটিই মেইলে এটাচড করা হয়েছে।

জানতে চাইলে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের সন্তান হাসান ইকবাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগেরটি তো লোগা বলে জানতাম। তবে নতুন প্যাডে যে লাল-সবুজ রঙ ব্যবহার করা হয়েছে, এ সম্পর্কে জানি না। এটা তো লোগো না।’

জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সদস্য মাওলানা হাবিবুর রহমান বলেন, ‘এটা তো প্রচার বিভাগ করেছে। লোগো কেন এলো, আগেরটা গতকাল কেন পাঠানো হলো, এ বিষয়ে নতুন করে কিছু জানি না। এটা প্রচার বিভাগ জানবে।’

এরপর প্রচার বিভাগের কয়েকজন দায়িত্বশীলকে কল করা হলে তাদের সেলফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।

নিবন্ধিত দলে ভিড়বে জামায়াত!
মঙ্গলবার নতুন প্যাডে বিবৃতি আসার পর বিষয়টি নিয়ে জামায়াতে আলোচনা তৈরি হয়েছে। প্রচার বিভাগের দায়িত্বশীলদের নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে ভেতরে-ভেতরে। তবে এসব আলোচনায় যুক্ত নতুন সম্ভাবনা।

জামায়াতের ঢাকা মহানগরী সেক্রেটারি ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য নুরুল ইসলাম বুলবুলের একজন ঘনিষ্ঠ সহচর বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, নতুন লোগো প্রকাশ হওয়ার পেছনে দুটি কারণ থাকতে পারে। একটি হচ্ছে, তাহলে কি জামায়াত নিষিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে? আর পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই সবকিছু নতুনভাবে গোছানো হচ্ছে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, নিষিদ্ধ হওয়ার সম্ভাব্য শঙ্কা মাথায় রেখে ইতোমধ্যে নিবন্ধিত কয়েকটি দলকে টার্গেট করেছেন নীতিনির্ধারকরা। এর মধ্যে নিজেদের সঙ্গে মানানসই কোনও নিবন্ধিত দলের পরিচয়েই রাজনীতিতে আসবে দলটির নেতাকর্মীরা। এ সরকারের সময়ে নিষিদ্ধ হলে নতুন নামে নিবন্ধন পাওয়াকে ‘স্বপ্ন’ হিসেবে দেখে নিষ্ক্রিয় কোনও নিবন্ধিত দলের ব্যানারেই রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ টিকিয়ে রাখতে চায় জামায়াত।

নতুন লোগো সংবলিত জামায়াতের প্যাড
এর পক্ষে নীতিনির্ধারকদের মন্তব্য না পাওয়া গেলেও কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতার কর্মীরা মনে করছেন, এ নিয়ে দ্বিধা নেই যে, নিষিদ্ধ হলে নতুন নাম নয়, নিবন্ধিত কোনও দলের ব্যানারেই জামায়াত নেতাদের দেখা যেতে পারে।

নিষিদ্ধ প্রসঙ্গে সম্প্রতি জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ বলেন, সরকারের মন্ত্রীরা ঘোষণা করছেন স্বল্পতম সময়ের মধ্যে জামায়াত নিষিদ্ধ করা হবে। তাদের এ ঘোষণা অসাংবিধানিক এবং বেআইনি। জামায়াত একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। জামায়াত নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। তিনি আরও বলেন, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার ষড়যন্ত্র করে জনগণের মন থেকে কখনও জামায়াতকে মুছে ফেলা যাবে না।

অসমর্থিত একাধিক সূত্রের দাবি, জামায়াত নিষিদ্ধ হলে নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে নিষ্ক্রিয় একটি দলকেই বেছে নেবে। নিষ্ক্রিয় নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে আবদুর রাজ্জাক মুল্লাহ রাজু শিকদারের বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট। ব্যারিস্টার আরশ আলীর গণতন্ত্রী পাটি। ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমানের বিজেপি। কর আইনজীবী জাকির হোসেনের গণফ্রন্ট, ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশীর প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল পিডিবি, মে. জে. (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিমের বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির নাম শোনা যাচ্ছে।

উল্লিখিত দলগুলোর একটি দলের মহাসচিব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, জামায়াতের আদর্শের সঙ্গে এই দলগুলোর আদর্শের মিল নেই। এই নেতা মনে করেন, জামায়াত অন্য দলে ভিড়লে সংশ্লিষ্ট দলের বডির সঙ্গে কিভাবে ম্যাচ করবে, দলীয় প্রধানসহ নানা বিষয়ে প্রশ্ন আছে। এগুলো জটিল।

রাজনৈতিক একটি সূত্র জানিয়েছে, নিষিদ্ধ সাপেক্ষে জামায়াতের আগামী দিনের রাজনৈতিক সমীকরণ খুব সহজেই মিলবে না। তবে দলটির পরিকল্পনা অনেক আগে থেকেই সঞ্চারিত রয়েছে।

এক্ষেত্রে বিএনপির একটি সূত্র জানায়, রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। এই বিষয়টি মাথায় রেখে ভাবতে হবে যেকোনও কিছু সম্ভব হতে পারে।

এসব বিষয়ে জানতে চেয়ে যোগাযোগ করে দায়িত্বশীল কাউকে পাওয়া যায়নি। তবে সম্প্রতি জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমদ তার দলকে আগামী দিনের গণমানুষের রাজনৈতিক দল বলেই দাবি করেছেন। তিনি বলেন, এ কথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, জনগণ স্বাধীনমত প্রকাশের সুযোগ পেলে জামায়াতকেই মনে-প্রাণে তাদের পছন্দের রাজনৈতিক দল হিসেবে বেছে নেবে। সরকার জামায়াতের অগ্রগতির মধ্যে তার রাজনৈতিক পরাজয় দেখতে পেয়ে জামায়াতের ওপর অব্যাহতভাবে আগ্রাসী হামলা চালাচ্ছে।

মকবুল আহমাদ আরও বলেন, আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, জনগণের এ সহানুভূতি ও ভালোবাসাই জামায়াতকে সরকারের জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রেরণা জোগাবে।

সালমান তারেক শাকিল
সিনিয়র রিপোর্টার, বাংলাট্রিবিউন