ধর্ষণের বিরুদ্ধে একা একটা প্লাকার্ড

1101

দিন কয়েক ধরে নতুন একটি গল্প লেখার চেষ্টা করছি। যে গল্পের বৈশিষ্ট হবে দুটি। প্রথমত এর কোনো চরিত্র কাল্পনিক হতে পারবে না এবং যে গল্প এর আগে কখনো লেখা হয়নি। গল্পের প্রথম বৈশিষ্টের শর্ত পূরণ করা কঠিন কিছু নয়। আমাদের চারপাশে এমন হাজারও বাস্তব চরিত্র আছে, যাদেরকে নিয়ে শত শত গল্প লিখে ফেলা যায়। কিন্তু আগেও যে তাদের নিয়ে কোনো গল্প লেখা হয়নি, তার নিশ্চয়তা কে দিবে!

এই ভাবনা আমার কলমে এমনই এক প্রতিবন্ধকতা ও ধাঁধা সৃষ্টি করেছে যে, লেখাই শুরু করতে পারছি না। দুই একটা চরিত্র খুঁজে বের করেছি ঠিকই, কিন্তু তাদেরকে গল্পে ঢোকানোর পথ পাচ্ছি না। গল্পকার হিসেবে আমি অবশ্যই অপটু ও অকিঞ্চিৎকর। একই সঙ্গে এই রকম অসহায়ও!

Saif Hasnat Logo

গল্পের এক চরিত্র ভবঘুরে ধরনের। যদিও তার কাজ ও কাজের ইচ্ছেটা অনেক বড় ও মহৎ। এই চরিত্রের একটা সুন্দর ও ভদ্রোচিত নাম দেয়া দরকার। কোনো নামের সুন্দর হওয়া আপেক্ষিক ব্যাপার। কোনো মানুষের নাম যদি আকাশ হয়, বহু মানুষ তা পছন্দ করবে। আবার বহু মানুষের কাছে এই নাম হাস্যরস সৃষ্টি ছাড়া কিছু করবে না। সুতরাং সুন্দর নাম কী— সেই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে না ধরে নিয়েই আমি সুন্দর ও ভদ্রোচিত একটা নামের খোঁজ করতে করতে যে নামটা বেছে নিলাম তা— আব্দুস সালাম।

আব্দুস সালামের চরিত্র ভবঘুরে ধরনের, যে কথা আগেই বললাম। এটিকে আপাতত একটি সমস্যা হিসেবে দেখা যাক। তার আরো বড় সমস্যা হলো, দুনিয়ার এমন অসঙ্গতি কমই আছে, যা তার নজরে পড়ে না। প্রাথমিকভাবে অসঙ্গতিতে নজর পড়ার বিষয়টিকে সমস্যা মনে করার কোনো কারণ নেই। বরং এটা ভালো। কিন্তু সেই অসঙ্গতি দূর করার চেষ্টায় নেমে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। আব্দুস সালাম এটা বোঝেন। কিন্তু তার পরোয়া করেন না। সব রকম বেপরোয়া কাজই একেকটি সমস্যা।

ভবঘুরে আব্দুস সালামের ভেতরে একজন নিরীহ ধরনের বিপ্লবীও বাস করেন। যার বিশ্বাস, একের পর এক চলা ধর্ষণের বিরুদ্ধে একা একটা প্লাকার্ড উঁচিয়ে ধরেই সমাধান আনা যায়। এ নিয়ে যখন আব্দুস সালামকে কেউ কটাক্ষ করে, তিনি রেগে যান এবং বলেন, দেখুন, দুনিয়ায় অসম্ভব বলে কিছুই নেই। বিশ্বাস রাখলে সবই সম্ভব। যদি তাই না হইতো, মানুষ কোনোদিন চাঁদে পা ফেলতে পারতো না। বিশ্বাস ছিলো বইলাই নিল আর্মস্টং চাঁদে পা রাখছিলেন।

কিছু লোক আব্দুস সালামের কথা শুনে অনুপ্রাণিত হয়। কিছু লোক চুপ করে থাকে। এই চুপ করে থাকারা আবার দুই প্রকার। এক প্রকার প্রকাশ্যে আব্দুস সালামের পক্ষ নিতে বিব্রত বোধ করে এবং তাকে মৌন সমর্থন দিয়ে যায়। আরেক প্রকার আব্দুস সালামকে পাগল ধরে নিয়ে তার কথায় কোনো মন্তব্য করে না। এই দুই প্রকার চুপ করাদের এবং যারা আব্দুস সালামের কথায় অনুপ্রাণিত হয়, তাদের মাঝখানে আবির্ভাব ঘটে গল্পের অন্য একটা চরিত্রের।

যে গল্পটি লিখে উঠতে পারছি না, সেই গল্পের নতুন চরিত্রের নাম রফিকুল ইসলাম। ব্যক্তিগতভাবে তিনি নিজেকে কৌতুহলপ্রবণ মানুষ মনে করেন। জ্ঞান বুদ্ধিতে তিনি আব্দুস সালামের চেয়ে অনেক এগিয়ে। তার এই এগিয়ে থাকাটা অবশ্য আত্মস্বীকৃত। রফিকুল ইসলামের সাথে আব্দুস সালামের প্রায়ই দেখা হয়ে যায় এবং পরস্পরে প্রায় সব বিষয়ে এক পক্ষে থাকেন। কিন্তু তার পরে দেখা যায়, একমত হওয়া বিষয় নিয়ে সবচেয়ে বড় গণ্ডগোলটা পাকান তারাই। যেমন, আব্দুস সালাম যখন সব সম্ভব বলে বক্তব্য দেন এবং নিল আর্মস্টংয়ের প্রসঙ্গ তোলেন, রফিকুল ইসলাম তখন বলে ওঠেন, আপনি আর্মস্টংয়ের চাঁদে যাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত? এটা নিয়ে কিন্তু প্রচুর সন্দেহ আছে।

ফলে অসঙ্গতিপূর্ণ বিষয়ে আব্দুস সালামের সচেতন থাকার চেষ্টাটা বৃথা হয়ে যায় এবং রফিকুল ইসলামের জ্ঞানী ভাবটা টেকসই হয় না। মানুষ তাদেরকে নিয়ে হাসাহাসি করতে চায়।

দিন কয়েক ধরে আব্দুস সালাম এবং রফিকুল ইসলামের চরিত্রের নানা দিক নিয়ে চিন্তা করছি আর ভাবছি, যে কোনো দিন গল্পটি লেখা শুরু করবো। এই ভাবাভাবির মধ্যে ছোট একটা ঘটনা ঘটে গেছে। ঘটনাটা হলো আব্দুস সালাম এবং রফিকুল ইসলাম, আমারই সম্ভাব্য এক গল্পের এই দুই চরিত্র আমি যেভাবে চাই, সেভাবে এগুচ্ছে না। তারা বরং নিজের চলার পথটাকে নিজেদের মতো করে ভেবে নিচ্ছে এবং এগুচ্ছে সেভাবেই। ব্যাপারটা গল্পকার হিসেবে আমার জন্য মেনে নেয়া সহজ নয় এবং এই বিষয়টি গল্প লেখার নতুন প্রতিবন্ধক হিসেবে হাজির হয়।

দুই.
ঢাকায় দিন দিন বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাব প্রকট হচ্ছে। না, এটা না লিখতে পারা গল্পের কোনো লাইন নয়। তবে ঘটনা সত্য। এই সত্যের সাথে যোগ হচ্ছে আরো একটা নির্মম ব্যাপার। ঢাকার নানা প্রান্তে জারে করে পানি বিক্রি করা হয়, সে সব জারের ৯৭ শতাংশের পানিতে পাওয়া গেছে ঝুঁকিপূর্ণ মাত্রার মলের জীবাণু। কী ভয়ানক ব্যাপার। বিশুদ্ধ পানির অভাব মেটাতে আমরা প্রতিদিন গ্লাসের পর গ্লাস মলের ব্যাকটেরিয়া পান করছি!

এবার না লেখা গল্পের চরিত্র আব্দুস সালামে ফেরা যাক। প্রায় সব অসঙ্গতি যেহেতু তার নজরে পড়ে, সেহেতু বিশুদ্ধ পানির অভাব নিয়ে তার রাজ্যের দুশ্চিন্তা। গল্পে দেখা যাবে, আব্দুস সালাম বিশুদ্ধ পানির অভাব নিয়ে জনমনে সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করছেন। কাজের ফাঁকে তার মনে হয়, শুধু বিশুদ্ধ পানি হলেই হবে না, সাধারণ মানুষের অধিকার হলো বিনামূল্যে তা পাওয়া। ‘বিশুদ্ধ পানি চাই’ এর বদলে আব্দুস সালামের চেষ্টাটা দাঁড়ায় ‘বিনামূল্যে বিশুদ্ধ পানি চাই’-এ।

যথারীতি কিছু লোক আব্দুস সালামের কথায় অনুপ্রাণিত বোধ করেন। বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ খরুচে শহর হওয়ার পরও ঢাকার মানুষ সবচেয়ে কম নাগরিক সুবিধা পাওয়াদের দলে। নয়টায় অফিস থাকলে ঢাকার বেশিরভাগ মানুষকে বের হতে হয় দুই ঘণ্টা অতিরিক্ত সময় হাতে নিয়ে। কারণ রাস্তায় দমবন্ধ যানজট। এ রকম আরো বহু সমস্যা। এর মধ্যে যদি খাবার পানিটাতেও মিশে থাকে মলের ব্যাকটেরিয়া, তাহলে কিভাবে? সুতরাং আব্দুস সালামের কথায় অনুপ্রাণিত হওয়ার লোকের অভাব হয় না।

সেই লোকেদের পক্ষে পেয়ে আব্দুস সালাম যান ব্যানার বানাতে। যা নিয়ে তিনি মানববন্ধনে দাঁড়াবেন। ছাপাখানায় গিয়ে আব্দুস সালাম দেখা পান তার কথায় চুপ করে যাওয়া দুই ভাগে ভাগ হওয়া লোকেদের এবং তাদের মাঝখান দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ান রফিকুল ইসলাম। বলে ওঠেন, আব্দুস সালাম, তোমার কথা ঠিক আছে। কিন্তু জারের পানিতে মলের ব্যাকটেরিয়া আছে, তা নিয়ে তুমি কি নিশ্চিত? সংবাদপত্রে তো কতো কথাই বলে, সব কি সত্য?

গল্পটা এইভাবে এগুবে বলে চিন্তা করি। কিন্তু রফিকুল ইসলামের এই রকম প্রতিপক্ষ হয়ে যাওয়াটা সামাল দিতে পারেন না আব্দুস সালাম। তার ভেতরের নিরীহ বিপ্লবী মনটা একটা প্লাকার্ড লিখে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে যায়। কিন্তু গল্পটা আসলে আমি একটু অন্যভাবে লিখতে চাই।

তিন.
গল্পের আরো কিছু চরিত্র থাকা উচিত। দিন কয়েক ধরে তাদের নিয়েও এটা-ওটা ভাবছি। এদের মধ্যে একজন মনে করেন ধর্ষণের একমাত্র দায় নারীর পোশাক। তার কাছে নারীর পোশাকের বিভিন্ন ধরন আছে, যেমন কুরুচিপূর্ণ, উত্তেজক ও শালীন। অন্য একটা চরিত্রের চিন্তা ঠিক বিপরীত। তার মতে পোশাক কখনো ধর্ষণের কারণ হতে পারে না। পুরুষের বিপথগামীতাই ধর্ষণের একমাত্র কারণ। এই দুই পক্ষ গল্পের একটা পর্যায়ে গিয়ে পুরুষের বিপথগামীতাকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করবে।

গল্পটি নিয়ে এই রকম ভাবতে ভাবতে মনে হয়, এটি ক্রমেই একটা সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। যে সংঘাতের একটা যৌক্তিক সমাপ্তি পর্বও থাকা উচিত। কারণ একজন গল্পকার হিসেবে আমি একটি গল্প ও তার চরিত্রদের চরম অনিশ্চয়তার মুখে ফেলতে পারি না।

হ্যাঁ, এ বিষয়ে গল্পকারের ভাবনার জগতকে কেউ বাধ্য করতে পারবে না, কিন্তু লেখকের একটি ব্যক্তিগত আদর্শ থাকে। আমি হঠাৎই সেই আদর্শের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাই এবং আমার মনে হয় এটি এমন এক গল্প হয়ে থাকতে পারে, যা আসলে লেখা হবে না কখনো। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে পারি না। শুধু চূড়ান্ত হয়ে থাকে গল্পের বৈশিষ্ট দুটি— গল্পটির কোনো চরিত্র কাল্পনিক হবে না এবং গল্পটি এর আগে আর লেখা হয়নি।

সাইফ হাসনাত : ক্রীড়া সাংবাদিক ও গীতিকার।

এমনও দিন কেনো যে আসে | সাইফ হাসনাত