তারেককে ঘিরে সিন্ডিকেট ফাঁদ

1133

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের মতো লন্ডনে অবস্থানরত দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ঘিরেও গড়ে উঠেছে একাধিক সিন্ডিকেট।

সিন্ডিকেটের অপতৎপরতায় একদিকে যেমন তারেক রহমানের ইমেজ সঙ্কটে পড়ছে তেমনি দলেরও মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা।

নেতাকর্মীরা জানান, বিএনপির দুই সদর দফতর। একটি রাজধানী গুলশানে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়। অপরটি দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের লন্ডনে। গুলশানের সিন্ডিকেট নিয়ে সারাদেশের নেতাকর্মীদের মাঝে চলছে তোলপাড় অবস্থা। অন্যদিকে, লন্ডন সিন্ডিকেট রয়েছে নিরাপদে।

তারা জানান, চিহ্নিত ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা শুধু তদবিরবাণিজ্য নিয়েই ক্ষান্ত থাকছেন না, দলের ও তারেক রহমানের দৈনন্দিন গোপনীয় তথ্য পাচারও করছেন। কিন্তু শক্তিশালী এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কারো মুখ খোলার সাহসও নেই।

এদিকে নিজেদের সুবিধার জন্য লন্ডনের সাথে গুলশান সিন্ডিকেট যোগসূত্র তৈরী করেছে। সিন্ডিকেটের এই চিহ্নিত সুবিধাবাদীরা তারেক রহমানকে রাজনৈতিকভাবে কোনো সহযোগিতা না করে প্রতিনিয়ত দেশের সিনিয়র নেতাদের নিয়ে কুৎসা রটনা আর অভিযোগ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন।

নেতাকর্মীরা জানান, এসব সিন্ডিকেটের আশীর্বাদপুষ্ট বিলাসবহুল বিভিন্ন কার্যালয় গড়ে উঠেছে লন্ডন, ঢাকাসহ নানা স্থানে। তদবিরবাণিজ্যের এসব কার্যালয়কে দলের নেতাকর্মীরা ‘দরবার শরীফ’ বলেই চিনে। সিন্ডিকেট প্রধানকে পদ প্রত্যাশার আশায় মোটা অঙ্কের নজরানা দেয়ার পদ্ধতিও রয়েছে এসব দরবার শরীফে।

বিএনপি সূত্র জানায়, ওয়ান ইলেভেনের সময়ে চিকিৎসার জন্য জিয়া পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্রকে লন্ডন যেতে হয়। শুরুতে দলের নেতাকর্মীদের কাছ থেকে অনেকটা নক্ষত্রের দূরত্বেই থাকতেন তিনি। তখন তারেক রহমানের সাথে যোগাযোগ মাধ্যম ছিলেন তৎকালীন যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি প্রয়াত কমর উদ্দীন। কিন্তু পরিস্থিতির পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে তারেক রহমান এখন দলের নেতাকর্মীদের নিয়মিতই সাক্ষাত দিচ্ছেন। লন্ডনের কিংসষ্টনে তার বাড়ির অদূরে হোটেল কিংসষ্টন লজের লবিতে প্রায় বিকেলেই তিনি বসছেন নেতাকর্মীদের সাথে। আর এখানেই পদ আর পদবির জন্য নেতারা ধরনা দেন নিয়মিত। দেখা পেতে দেশ থেকেও তারা আসেন নানা মাধ্যমে। নেতার দেখা পাবার এ পথটুকু পাড়ি দিতেও বিভিন্ন ঘাটে তারেক রহমানের কাছের মানুষদের খুশি করতে মোটা অঙ্কের লেনদেন চলে। আবার তার ঘনিষ্টতার সুযোগে দলের অনেক গোপনীয় তথ্য পাঁচারেরও অভিযোগ রয়েছে।

নেতাকর্মীরা জানান, লন্ডনে পর্দার অন্তরালের রাজনীতির কুটকৌশলের নানামুখী খেলা চলছে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ঘিরে। তারেক রহমান লন্ডনে কার সাথে কোথায় সাক্ষাত করছেন, গোপন বৈঠকের আলোচনার বিষয়বস্তু আর সিদ্ধান্তের সব তথ্যই মুহূর্তে হাত বদল হচ্ছে। সেসব খবরাখবর পৌঁছে দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন সংস্থার কাছে।

নেতাকর্মীরা জানান, এর আগে হোটেল কিংসষ্টন লজে তারেক রহমানের সাথে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের একটি বৈঠকের অডিও ফাঁস করা হয়। ওই বৈঠকে একমাত্র উপস্থিত থাকা লন্ডন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কয়সর এম আহমেদই এই অডিও ফাঁস করেছেন বলে সন্দেহ নেতাকর্মীদের। তারও আগে প্রয়াত ড. পিয়াস করিমের সাথে ইস্ট লন্ডনের কমার্শিয়াল রোডের একটি হোটেল কক্ষে তারেক রহমানের সাক্ষাত ও আলোচনার বিষয়বস্তুও প্রকাশ্যে চলে আসে। জাসাস নেতার পুত্রের ঘটনাও এরই অংশ। দলকে বেকায়দায় ফেলার জন্যই ফাঁস করে দেয়া হয় ঘটনা।

লন্ডন বিএনপি সূত্র জানায়, কিংসষ্টন লজ হোটেল ও এ হোটেলের লবিকে ঘিরে লন্ডনে গড়ে উঠেছে তারেক রহমানের কাছের মানুষ বলে দাবিদারদের কয়েকটি বলয়। এখানে নিয়মিত যেমন অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী তরুণরা আসেন তেমনি আবার দলের আর্ন্তজাতিক সম্পাদক মাহিদুর রহমান, ব্যারিষ্টার সায়েম, জাবি ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি পারভেজ মল্লিকদেরও যাতায়াত রয়েছে।

নেতাকর্মীরা জানান, লন্ডনে বসবাসরত তারেক রহমান কৃচ্ছতার সাথে জীবনযাপন করলেও তার কাছের মানুষ বলে দাবিদার এমন অনেকের দেশে বা লন্ডনে কোনো পেশা না থাকলেও বনে গেছেন বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক। আবার এসব পক্ষগুলোর এক পক্ষ অন্য পক্ষকে ঘায়েল করতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছেও তুলে ধরছেন নিজেদের নানা সংববেদনশীল তথ্য।

সূত্র জানায়, লন্ডন বিএনপি নেতা কয়সর এম আহমেদের ব্যাবসায়ী পার্টনার সুশান্ত দাস গুপ্ত লন্ডন আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক। সজীব ওয়াজেদ জয়ের সাথেও রয়েছে তার সম্পর্ক। যুক্তরাজ্যের কমিটি গঠনসহ ৩৯টি সাংগঠনিক ইউনিট কমিটি গঠনের নামে বাণিজ্য, অর্থনৈতিক বিভিন্ন অনিয়ম, কার্ড জালিয়াতিসহ নানা অভিযোগের সাথে কয়সরের নাম জড়িয়ে আছে। এছাড়া তারেকের সহকারী সানির সহযোগিতায় দেশের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ তার নিজ এলাকা সুনামগঞ্জের বিভিন্ন কমিটি গঠনেও প্রভাব বিস্তার করার নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

তারেক রহমানের সহকারী সানির বিষয়ে নেতাকর্মীরা জানান, প্রয়াত কমর উদ্দীনের হাত ধরে বাংলাদেশ থেকে শিক্ষার্থী ভিসায় আসা সানি একজন শিক্ষার্থী ও হোটেলবয় হিসেবে তারেক রহমানের কাছে ঠাই পান। তারেক রহমানের পার্সোনাল এসিষ্টেন্ট সানি এখন আবির্ভূত হয়েছেন তারেকের পার্সোনাল সেক্রেটারি রূপে। আর এর বদান্যতায় দেশে বসবাসরত তার বড় ভাই কয়েক বছরের ব্যবধানে গড়ে তুলেছেন বিশাল বিত্ত-বৈভব।

অপরদিকে, লন্ডনে সানির একক আধিপত্য ও ক্ষমতার কাছে অসহায় হয়ে উঠেছেন দলের ত্যাগী আর পরীক্ষিত নেতাকর্মীরা। তারেক রহমানের সাথে সাক্ষাত করিয়ে দেয়ার নামে কিংবা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দেয়ার নামে বিভিন্ন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও নেতাদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।

তার বড় ভাই কবির আহমেদ ভূইয়া রাজধানীর উত্তরায় তার ব্যক্তিগত কার্যালয়ে গড়ে তুলেছেন সবচেয়ে বড় সিন্ডিকেট। দলের অঙ্গ সংগঠনসহ সাবেক ছাত্রনেতা থেকে শুরু করে বর্তমান ছাত্রদল এবং অনেক ধনাঢ্য শ্রেণির নেতারা নির্বাহী কমিটিতে স্থান পাওয়ার জন্য চলে আসেন এই দরবার শরীফে। তার এই কার্যালয়ে সার্বক্ষণিক অবস্থান করেন ছাত্রদলের সাবেক এক নেতা। তিনিও পদ প্রত্যাশী। তারা সকলেই দলের পদ প্রাপ্তির নিশ্চয়তা পান মোটা অঙ্কের নজরানার বিনিময়ে।

তারেক রহমানের ঘনিষ্ট হিসেবে পরিচয় দানকারী স্বেচ্ছাসেবক দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক পারভেজ মল্লিক ছাত্রজীবনের শুরুতে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৯৫-৯৬ শিক্ষাবর্ষের ২৫তম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। ওই সময়ে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ও নারী নির্যাতনকারী হিসেবে পরিচিত ছাত্রলীগ নেতা জসিম উদ্দিন মানিকের সহযোগী ছিলেন। এছাড়া ছাত্রলীগের সহ সভাপতি মিলনের সাথে মওলানা ভাসানী হলে একই রুমে থাকতেন। ১৯৯৮ সালে সালে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনের মুখে মানিক ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হলে পারভেজকেও হল থেকে বের করে দেয়া হয়। এরপর রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ছাত্রদলের ব্যানারে ভিড় করেন। পরে তৎকালীন ছাত্রদলের সভাপতির সাথে সখ্য গড়ে একাধারে দুইবার জাবি ছাত্রদলের সভাপতি বনে যান। ওই সময়েও সংগঠনের ত্যাগী নেতাকর্মীদের ডিঙিয়ে তিনি ওই পদ লাভ করেছিলেন। ওই সময়ে জাবি ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন মাহবুবা নাজনীন জেবিন। চির প্রতিদ্বন্দ্বী এই দুই সংগঠনের সভাপতিই এখন স্বামী-স্ত্রী। তারা উভয়ে এখন লন্ডনে রয়েছেন। পারভেজ মল্লিকের সাথে জেবিন তারেক রহমানের বাসায় অবাধ যাতায়ত করেন। পেশাগত জীবনে কারও কোনো কর্ম না থাকলেও তারা বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন। তাদের এই বিবাহের অন্যতম উদ্যোক্তা স্বেচ্ছাসেবক দলের ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক ও কোয়াব’র সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত পাল। তার বিরুদ্ধেও রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের সাথে ঘনিষ্টতার অভিযোগ।

অভিযোগ রয়েছে, পারভেজ মল্লিকের স্ত্রী জেবিন প্রতি বছর দেশে আসেন এবং ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠকও করেন। আর এসকল বৈঠকেই তারেক রহমানসহ বিএনপির সকল গোপন তথ্য পাঁচার করেন।

জাবি সূত্র জানায়, জেবিন প্রভাবশালী ছাত্রলীগ নেত্রী হিসেবে এখনও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কমিটি গঠনে ভূমিকা রাখেন। ওই সংগঠনের সাবেক এক কেন্দ্রীয় সভাপতির সাথেও নিয়মিত সম্পর্ক রাখছেন তিনি।

আরো অনেক নেতা রয়েছেন এই তালিকায়। এমনও উদাহরণ রয়েছে- তারেক রহমানের সাথে একদিন দেখা হয়েছে এমন নেতাও তার ঘনিষ্ট বলে নিজেকে হাজির করছেন। আর এ পরিচয়ে তিনিও হয়ে উঠছেন প্রভাবশালীদের তালিকার একজন সদস্য।

এসব বিষয়ে লন্ডন বিএনপির এক নেতা আক্ষেপ করে বলেন, জিয়া পরিবারের সদস্যদের সরলতার সুযোগে অনেকেই এমন অনৈতিক কাজ করে পার পেয়ে যাচ্ছেন।

রফিক রাফি:
সিনিয়র রিপোর্টার, নিউজবাংলাদেশ