কবিতা যখন রাজপথে নামে সেটা স্লোগান হয়ে যায় —স্নিগ্ধা বাউল

2415
স্নিগ্ধা বাউল

কোনো টুকটাক সময় বের করে কবিতা লেখার কবি নন, যার জীবনের সবটা জুড়েই কবিতারই রাজত্ব, যিনি সত্যিকার অর্থেই এই ইটপাথরের শহরে বন্দি করে রাখেন একটি বাউল মনকে, তিনি স্নিগ্ধা বাউল। বাউল তার পৈতৃক পদবি, তিনি পেশায় শিক্ষক, কবিতা চর্চা করছেন, পড়ছেন, পড়াচ্ছেন, শিখছেন, লিখছেন, এই ধারাবাহিকতায় এবারের একুশে বই মেলায়ও বেরিয়েছে তার একটি কবিতার বই ‘শীতের পুরাণ চাদর’। এই নিয়ে তার দুটি বই বেরিয়েছে। ‘এখন’ এর পক্ষ থেকে এই বাউল কবির সঙ্গে তার কবিতা, জীবন, বোধ এসব নিয়ে কথা বলেছেন জান্নাতুল ফেরদৌসী সনি। ছবি তুলেছেন মুজতাহিদ হাসান রিফাত।

জান্নাতুল ফেরদৌসী সনি : কেমন আছো তুমি?
স্নিগ্ধা বাউল : ভাল আছি, তুমি কেমন আছো?

ভালো আছি আমিও, তোমাকে দেখে বেশি ভালো লাগছে। যদিও তুমি বসিয়ে রেখেছো আমাকে অনেকক্ষণ।
আমি কাজে আটকে পড়েছি, তুমি বুঝতেই পারো আমি যথেষ্ট যুক্তিসহযোগে দেরি করেছি। আমি দুঃখিত।

তোমার পোস্টিং তো নরসিংদী ছিলো, বাড়িও সেখানে। এখন ঢাকায় পোস্টিং কেমন লাগছে?
ভালোই, সবজায়গায় মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি।

তুমি নিজে থেকেই এসেছো নাকি সরকারি সিদ্ধান্তে?
অবশ্যই সরকারি সিদ্ধান্তে।

ঢাকায় কবিতা চর্চা ভালো হচ্ছে নাকি নরসিংদীতে ভালো হচ্ছিলো। কবিরা সাধারণত কেন্দ্রের চর্চাকে প্রাধান্য দেয়, তোমার ক্ষেত্রে কী ঘটছে?
আসলে নরসিংদীর ব্যাপারটা অন্য ঢাকার ব্যাপারটা অন্য। নরসিংদীতে ছিলাম আমরা আমরা। এখানে আমরা ছাড়াও অনেক অনেক কিছু আছে। নরসিংদীতে ছিলো একটা গোষ্ঠীবদ্ধ স্বাধীন চর্চা, আর এখানে এত বিভিন্নতা বিশাল ব্যপ্তি! সেসব থেকে প্রতিনিয়ত শিখছি, স্বাদ নিচ্ছি ব্যপ্তির, ভিন্ন পর্যবেক্ষণের। এরজন্য যে ঢাকায় আসা জরুরি ছিলো এমন না। তবে ঢাকায় এসে অনেক নতুন কিছু দেখছি শিখছি। কিন্তু নরসিংদী আমার কবিতা চর্চার ভিত্তি বলতে পারো, সেই জায়গা থেকে আমি নরসিংদীর কবিতা চর্চাকে খুব মিস করি, এবং আমি চাই নরসিংদীর সেই চর্চাটা যেন থেমে না যায়। তবে একটা নির্দিষ্ট কথায় বলতে চাইলে নরসিংদীতে শেখার চাইতে আবিষ্কারপ্রধান ছিলাম কিন্তু ঢাকায় এসে সেটা একেবারেই শেখার যায়গায় চলে এসেছে।

স্নিগ্ধা বাউল

তুমি একদিকে শিক্ষক, একদিকে কবি। একটা প্রোফেশন অন্যটা প্যাশন। তোমার কবিত্বের বোধ কি কোনোভাবে তোমার পেশায় সাহায্য করে?
তুমি জানো, আমি বাংলা সাহিত্যেরই ছাত্র, আমি এখন পড়াইও বাংলা, আমি কবিতা লেখি সেটিও বাংলা সাহিত্যেরই অংশ এখন পর্যন্ত। সেক্ষেত্রে আমি মনে করি অবশ্যই আমার শিক্ষকতা আমার প্যাশনকে সাহায্য করে। কারণ প্রতিনিয়ত পড়ানোর মাধ্যমে আমার অনেক চর্চা হয়ে যাচ্ছে অলক্ষ্যে। একইভাবে কবিত্বও সাহায্য করে আমাকে আমার পেশায়। দুইটাকেই আমার কাছে সমান্তরাল মনে হয়।

কবি হিশেবে কবিতার চর্চা কবে থেকে শুরু করলে?
এটা খুব কমন প্রশ্ন, সবাই করে থাকে। আসলে কবিতার চর্চা তো বলে কয়ে হয় না। আমি সাহিত্য ভালোবাসি সেই ছোটবেলা থেকেই। আমাদের বাড়িতে আমার দাদা কবিতা পড়তেন, খুব ভালো কবিতা পড়তেন। ওদের একটা সংগঠন ছিলো। তখন থেকেই দেখতাম একদল ছেলেমেয়ে বাসায় এসে কবিতা পড়ছে , আমার মা মুড়ি মেখে দিচ্ছে, ওরা নাটকের রিহার্সাল করছে। এসব দেখে দেখে আমার মধ্যেও সেই বোধটা কাজ করা শুরু করে হয়তো, আমাকে খুব টানতো। পরিবেশ একটা বড় বিষয় কিনা! আমাদের আলমারি ভরা বই ছিল, সেখান থেকে নিয়ে পড়া যেই বইটির কথা আমার মনে আছে প্রথম পড়েছি বলে, সেটা হলো তসলিমা নাসরিনের ‘আমার কিছু যায় আসে না’ নামক একটি বই ‘তুমি হেঁটে যাচ্ছো, গলি থেকে ছেলেগুলো বেরিয়ে আসবে, তোমাকে কিছু বলবে, তোমার তাতে কী যায় আসে!’ সেটাকে সবাই এডাল্ট বই বলতো কিন্তু আমি লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তাম, আমি দেখতাম আমার সাথে তো মিলে যাচ্ছে। তখন আমিও আমার কথাগুলো লেখার চেষ্টা করি, ওদের মতো হয় না ভেবে অনেক সময়ই মন খারাপ করে থাকতাম। কিন্তু একটা সময় সবকিছু উপেক্ষা করে লিখতে থাকি। শব্দের পর শব্দ ঠেসে দিয়েই মনে ভাব প্রকাশকে গুরুত্ব দিতে শুরু করি, এইতো… এর বেশি কোন বিশেষ ঘটনা নেই আমার কবিতা চর্চা শুরুর।

এখন তোমার দুটি বই, দুটি সন্তান তোমার। দুইটা বই হাতে পাওয়ার অনুভূতি কি দুইরকম ছিলো?
একজন মাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় আপনার দুইটা সন্তানের জন্মের অনুভূতি দুইরকম কিনা সে এর জবাব দিতে পারবে না। কারণ সেটা বলা যায় না নির্দিষ্ট করে। তবে হ্যা, ২০১৭ সালের ১লা ফাল্গুনে আমার প্রথম বই বের হয়। সেটা অন্যরকম। আমি অনেকক্ষণ ধরে বইটা হাতে ধরে রেখেছিলাম! আমার জীবনের প্রথম কবিতার বই আমার কবিতাগুলো নিয়ে একটা বই আমার হয়েছে এই উছ্বাস আর দ্বিতীয় বই বের হওয়ার পরের উচ্ছ্বাস এক না। দ্বিতীয় বইয়েও উচ্ছ্বাস কোন অংশে কম ছিলো না। হাতে নেয়ার পর একই অনুভূতি অনুভূত হয়েছে। কিন্তু উচ্ছ্বাসে কিছুটা ভিন্নতা ছিল, কম বা বেশি না। দুইটা দুইরকম!

আচ্ছা এই উচ্ছ্বাসটা কি সারা পাওয়ার উপর নির্ভর করে? যেমন বেশি সারা পাওয়ার ফলে উচ্ছ্বাসটাও বেশি কিনা?
না না, একেবারেই তা নয়। আমরা তো পাঠকের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে উচ্ছ্বসিত হবো না, পাঠক আমাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সারা দেবে। এটা হলো কবিতার বিষয়। এটাকে অন্যভাবে নেয়ার কোন সুযোগ নাই।

এখন তো ফেসবুকেই সবাই কবিতা লেখে, কবিতা প্রকাশের উদ্দেশ্য তো কবিরা বলে থাকেন পাঠকের কাছে পৌঁছানো, ফেসবুকে যেহেতু সেটা হয়ে যায় তারপরেও বই আকারে প্রকাশ করার উদ্দেশ্য কী?
পাঠকের কাছে পৌছানোর জন্য হয়তো অনেক মাধ্যম এখন তৈরি হয়েছে তা ঠিক। কিন্তু, কবির নিজের সৃষ্টিকে বুকে আগলে রাখার একটা বিষয়ও কিন্তু থাকে, এছাড়াও সাদা পৃষ্ঠায় কালো কালো অক্ষরের যে খেলা তা নিজের চয়িত শব্দ এটা দেখার একটা আলাদা আনন্দ আছে, এই আনন্দ থেকেই আমি মূলত বই বের করছি। এই প্রিন্টেড কপির সাথে পাঠক থাকলো কি থাকলো না সেটা বিষয় না, বিষয়টা একেবারেই নিজের!

তুমি কবিতায় পাঠকের উদ্দেশ্যে মূলত কী বলতে চাও?
যা লিখতে চাই তা তো এখনো লিখতে পারিনি। কী বলতে চাই সেটা একটা প্রশ্ন, হ্যা কবিতা যখন রাজপথে নামে সেটা স্লোগান হয়, কবিতা বিপ্লব ঘটায়, কবিতা দ্রোহের কথা বলে, প্রেম, ক্ষয়িষ্ণুতা, আকাঙ্ক্ষা, সমস্ত কিছুই কবিতায় বলা যায়। কবিতায় একজন মানুষ তার নিজেকেই বলে কিন্তু মানুষটা তো গড়ে ওঠে তার পারিপার্শ্বিকতার আদলেই। সেক্ষত্রে একজন কবি কী লিখবে বা লেখে সেটা পাঠকই ঠিক করে। বুঝে নেয় নিজের মত করে। এটার জন্য নির্দিষ্ট কোন বক্তৃতা নেই।

স্নিগ্ধা বাউল

পোস্ট মর্ডান সময়ে বসে কবিতা লিখছ যেহেতু, কবিতার ফর্মে তুমি কোনো এক্সপেরিমেন্ট করছো?
আসলে দশকের হিশেব, বা এই দশক অনুযায়ী কবিতার বা কাব্যধর্ম অনুসরণ এসবের কোনটাই আমি সমর্থন করি না। কারণ আমার মনে হয় আমার যা আসবে ভেতর থেকে যেভাবে আসবে আমি সেভাবেই লিখবো, এটা তো এমন না যে একটা ফর্ম আছে এই ফর্মে এভাবে শব্দ ফেলে ফেলে কবিতা লিখবো!

অনেক বড় বড় কবিরা কিন্তু এসব এক্সপেরিমেন্ট করেছেন তাদের কবিতায়, বিভিন্ন ও অভিনব ফর্ম নিয়ে তারা কাজ করেছেন? তাছাড়া আগে গানের সুর আগে করা হতো তার উপর শব্দ বসিয়ে গানের কথা লেখা হতো।
আমি সেক্ষেত্রে কখনোই এভাবে ভাবি না, আমার কাছে কবিতা এসে যায়। এখানে আমি কোনো বিশেষ ফর্ম নিয়ে আপাতত চিন্তা করি না।

প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাংতা কাগজ’ এই নামের মানে কী? বইটা কী কী বিষয়ের কবিতা দিয়ে সাজিয়েছো?
স্নিগ্ধা- রাঙতা কাগজ আসলে এমন একটা বিষয় যে, অনেক বেশি রঙিন একটা জিনিস অথচ ভীষণ ফাঁপা! প্রচ্ছদেও তাই দেখানোর চেষ্টা ছিলো। বইতে নারীবাদ ছিলো, অনেকভাবেই ছিল, শরীরী বিষয়গুলো ছিলো, শরীরী ছুৎমার্গের বিষয়গুলো ছিলো এবং এটা ধীরে ধীরে যেভাবে সামাজিক দৃষ্টিকোণের মাধ্যেমে স্থানান্তরিত হয় সেটাও দেখাতে চেয়েছি, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কথা বলার চেষ্টা করেছি, আবার সবকিছুর পরেও অনেকের জীবনে যে টালমাটাল প্রেম এসে থাকে সেসব প্রেমের কথাও বলার চেষ্টা করেছি। নিম্নবিত্ত মানুষের কথা বলেছি, মধ্যবিত্তের কথা এসেছে, উকুন বাছার মতো ঘটনাও এসেছে, বেশ্যার কথা এসেছে, আমি আর বেশ্যর মধ্যে আমি কোন পার্থক্য দেখি না সে কথ আমি অকপটে বলেছি।

তোমার বইতে নারীবাদ এসেছে তুমি বললে, সেই নারীবাদটা আসলে কী? কেমন?
বাদ বা তত্ত্ব ওসব কথা আমার নিজেরও পছন্দ না, আমি অনেক আগে থেকেই এটা বোধ করি যে আমি আমার কথা বললে সেটাকে কেনো বাদে ফেলে দেয়া হচ্ছে? আমি নারীদের কথা বলি, আমার কথা বলি। কিন্তু কেউ যদি সেটাকে বাদে ফেলে দিতে চায় আমি তাতেও আপত্তি করি না। যেভাবেই নাও, এটা আমার কথা সেটা তুমি বুঝলেই হলো। অনেক কিছু খুঁড়ে ফুঁড়ে ফেরে আমাদের বের হতে হয়, কিন্তু আমাদের সেই আমিত্বকে আবিষ্কার করে কয়জন? একটা রিকশাওয়ালাও দিনশেষে একজন শিক্ষক হোক বা খুব সম্মানিতই হোক কিছু বলার রাইট রাখে শুধু আমি মেয়ে বলেই। আমি কথা বলি এসব জায়গা থেকে, যেটার কারণে তুমি নারী যেটার কারণে তুমি পুরুষ এই জায়গার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের- আমার সেটাই মনে হয়।

স্নিগ্ধা বাউল

কার কবিতা পছন্দ কর বেশি?
জীবনানন্দের কবিতা। আমি তাকে নিয়ে অনেক কাজ শুরু করেছি, আরো কিছু প্ল্যান আছে। সময় নিয়ে করবো।

নতুনদের মধ্যে কার কবিতা পড়?
সবার কবিতাই পড়ার চেষ্টা করি যাদের চিনি। তবে আমার বিশেষ ভালো লাগে চট্টগ্রামের কবি শেখর দেবকে। তার তিনটা কবিতার বই বেরিয়েছে। জনবিচ্ছিন্ন থেকেই তিনি চর্চা করে যাচ্ছেন, তার উপর তিনি ম্যাথের স্টুডেন্ট, ব্যাংকার। এতো প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তার এই একাগ্রতা ভালো লাগে খুব। তাছাড়াও মুজিব ইরমের কবিতা খুব ভালো লাগে, হাসান রুবায়েতের কবিতা পড়ি, ভালো লাগে।

তোমার কাছে এই যে জীবন, একজন মানুষ, একজন শিক্ষক, একজন কবি এসব কিছুর পরে আর কী হতে চাও? নাকি কবি হয়েই মরে যেতে চাও?
মরে যেতে খুব ভয় লাগে যদিও এটা একটা নিয়ম। কিন্তু জীবন বহুমাত্রিক। সকালে জীবন যেমন দুপুরে বা রাতে তা নয়, আবার গ্রীষ্মে জীবন যেমন ফাগুনে তা নয়। এটাকে একজায়গায় রাখা যাবে না! আমি মরতে চাই স্নিগ্ধা হিসেবেই। এটাই আমার এখানে ওখানে সমস্ত জায়গার গন্তব্য!