একেলে শিশু ও সেকেলে আমি

939

17192015_10210795028410056_3653982589506254959_o copyফারজানা নাজনীন 

স্থানীয় একটি বালিকা বিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী স্কুল গেইটে আমাকে দেখেই বললো,

– আন্টি আপনার ফোনটা একটু দেয়া যাবে..? আম্মুকে কল দিবো…
– হ্যা নাও
– মেয়েটি যখন ফোন কানে লাগিয়ে কথা বলা শুরু করেছে তখনি খেয়াল করলাম, মেয়েটির ডান হাতের নখগুলো রুপকথার গল্পের রাক্ষসীদের মতো ইয়া বিশাল। বাম হাতের দিকে তাকিয়ে আমি হতভম্ব…! ডাইনিদের মতো লম্বা নখ কিন্ত সুন্দর করে কেটে শেপ করা।
ফোন রেখেই আমাকে বলছে- আন্টি আপনার দেশের বাড়ী কোথায়….?
– চাঁদপুর… তোমার..?
– টাঙ্গাইল।
– তুমি কোন ক্লাসে পড়ো মা?
– ক্লাস সিক্সে।
– এই স্কুলে কোন ক্লাস থেকে?
– ক্লাস ফাইভ থেকে।

এ স্কুলটি হাতের নখ লম্বা বা স্কুলের শৃঙ্খলার ব্যাপারে যথেষ্ট কড়া বলেই জানি। অতএব ধরে নিচ্ছি শিশু মেয়েটি ঈদের ছুটিতে গিয়ে বড় নখ করেছে এবং আজ প্রথম ক্লাস বলে নখ কাটেনি। ক্লাস সিক্সে পড়া একটি বাচ্চা মেয়ের ১০ আঙ্গুলের নখে সাইজ দেখে ভাবলাম, ওর মা কে? কেন এতো বাচ্চা মেয়েকে ইছরে পাকা বানাচ্ছে? এ বয়সেই এতো ফ্যাশন সচেতন বা স্টাইলিশ হবার আদৌ কী আছে?

  • হাসিন এবার ক্লাস সেভেনে পড়ে। মাশাল্লাহ বড় হয়েছে তার কিছু ছাপ আজকাল আমি দেখেও থাকি। এই তো আজকেই স্কুল ছুটির পর তার খুব প্রিয় একজন বন্ধু অমি’কে (ছদ্মনাম) প্রথমবারের মতো বাসায় নিয়ে এসেছে। বন্ধুকে বাসায় আনার পরেই খেয়াল করলাম হাসিনের আচার আচরণে ব্যস পরিপক্বতা, আন্তরিকতা, অতিথিপরায়ণতা, দায়িত্বপরায়নতা। মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম বন্ধু’র সাথে কী কী গল্প করে এবং তথ্যাদি বিনিময় করে।

বাসায় প্রবেশ করে কয়েক মিনিট ড্রইং রুমের সোফায় বসেই উঠে দাঁড়িয়ে অমি’কে ইশারা করছে এবং বলছে কোনটা কোন রুম। তিন বেডের বাসার তৃতীয় বেড রুমটা মুলত স্টোর ধরনের এবং হাসিনের বিগত ১২ বছরের সকল খেলনার সমাহার। অতি শান্ত বালক বলেই হাসিন তার কোন খেলনা নষ্ট বা ধংস করে ফেলেনি। এবং ইতিমধ্যে আমার বাসাকে ছোটখাটো একটি টয়জ মিউজিয়াম বানিয়ে ফেলেছে।

খেলনার রুমের প্রতি বন্ধুর কোন আগ্রহ দেখালো না। অত:পর নিয়ে গিয়ে দেশ বিদেশ থেকে সংগৃহীত নানান রকমের সাইজের সুপার হিরো স্টুডিও তে… এসব এর দিকে ফিরেও তাকালো না!

স্টাডি রুমে নিয়ে গিয়েই,
– এই টেবিলে আমার বাবা পড়ে
– এই টেবিলে আমি পড়ি
– এই রুমের বারান্দা দিয়েই আমি আমার সোনান মামা, আফনান মামা’র সাথে চিৎকার করে গল্প করি। দেখ দেখ ঐটা আমার মামাদের বাসা।

– এই রুমের বারান্দার গ্রীল কেটেই কদিন আগে আমাদের বাসায় চোর ঢুকতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলো। এবং সাথে আনা নতুন স্ক্রু ড্রাইভার ও প্লাস ফেলে গেছে…. দেখবি দেখবি চোরেদের ফেলে যাওয়া সেসব জিনিসগুলো…?
অমি খুব একটা চমকিত হলো না এবারেও।
-অমি এটা আমাদের মাস্টার বেড রুম….. এ কথা শোনার পরেই প্রথমবারের মতো অমি মুখ খুললো,
– হাসিন তোদের বাসায় ওয়াই ফাই আছে..?
– আছে..
– এটা কী তোর আম্মু’র কম্পিউটার.?
– হ্যা
– এটাতে ইন্টারনেট আছে..?
– হ্যা আছে তো…
– আমি একটু ফেসবুকে ঢুকতে পারবো? তোর আম্মু দিবে?
– আমি তো ফেসবুক চালাইনা। দেখি মা’কে বলে।

মা মা ও মা অমি একটু কম্পিউটার ব্যবহার করতে চায়। দিবো..?
হ্যা দাও…. (নিরুপায় হয়ে নীতিবিরুদ্ধ সিদ্ধান্ত)

অমি ফেসবুক ওপেন করেই হাসিনকে এক এক করে বলতে লাগলো, সে ফেসবুকে কি কি করে।
বন্ধু তালিকায় কে কে আছে…. এবং কোন কোন বন্ধুর আম্মা ফ্রেন্ড লিস্টে আছে….
– হাসিন তোর ফেসবুক নাই..?
– না নাই।
– ওমা তুই ফেসবুক খুলস না কেন? আমি তোরে খুলে দিবো?
– আমি আমার মা’য়ের ফেসবুক চালাই।
– কি চালাস তোর আম্মুর ফেসবুক দিয়ে?
– আরেহ আমার মা’য়ের ফেসবুকেই বেশী মজা। ওখানে একজন ফটোগ্রাফার আছে যিনি পানির নীচের প্রানী ও মাছের ছবি থেকে প্রবালের ছবি তোলে এবং পাখীর ছবি ও তোলে। আমার মা বলেছেন আরেকটু বড় হলে আমাকে ফেসবুক খুলে দিবে।
.
– অমি খেতে আয়….
– চল….
– অমি জানিস আমার মা দারুণ চিকেন ফ্রাই করে। খেয়ে দেখ একদম KFC ও ফেইল (ডাক্তারের মতো আমার রান্না নিয়ে বাড়িয়ে প্রশংসা করে)।
-চল আমরা খাবার হাতে নিয়ে কম্পিউটারের সামনে গিয়ে খাই আর ফেসবুক চালাই।
-অমি ফেসবুক চালিয়েই আইডি লগ আউট না করেই আমার বাসা ত্যাগ করলো।

যাবার আগে বলে গেলো
-আন্টি বাসায় গিয়ে আপনাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাবো!
হাসি দিয়ে বিদায় দিলাম আর আদর করে দিয়ে বললাম- বাবা মন দিয়ে পড়ালেখা করো…

  • আমার স্কুল ও কলেজ জীবনের বান্ধবীদের কয়েকজন ছেলেমেয়ে আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড হয়েছে। এদের মধ্যে একজনের মেয়ের একাধিক ফেসবুক আইডি আছে। কোন এক লিংক থেকেই আইডি সন্ধান পেয়েছি। দ্বিতীয় গোপন আইডি টা একটু ঘুরে যা পেলাম। পিচ্চি মেয়ের ফলোয়ারের অভাব নেই।

প্রতিটা ছবিতে লাইকের থেকে লাভ রিয়েকশন ও কমেন্টে ছেয়ে গেছে। কমেন্টে গুলাও ব্যস বাহারি – সুইটি, হটি, কিউটি যাক এ নিয়ে আর বেশী না বলি। ও  বাবা এই ছোট মেয়ে নাভি দেখায়ে পাতলা ফিনফিনে শাড়ী ও পরে সেটা আবার পাবলিক পোস্ট….!! পিচ্চি মেয়েটাকে এই শাড়ী কিনে দিলো কে? এই ছবি তুলে দিলো কে? এই শাড়ী এভাবে পড়তে দিলো কে? কেন কেন? বান্ধবী তুই কই? অবশ্যই আমার বান্ধবী এবং তার স্বামী!

  • কিছুদিন আগে হাসিন স্কুল থেকে এসে আমাকে প্রশ্ন করেছিলো : মা আমার বন্ধুরা বলেছে ইউটিউবে নাকি খারাপ খারাপ ভিডিও আছে। তাৎক্ষণিক উত্তরে বলেছিলাম- বাবা আমাদের সমাজে খারাপ ও ভালো এই দুই স্বভাব ও চরিত্রের মানুষ আছে। এক কথায় যেখানে ভালো আছে সেখানে কম বা বেশি খারাপ ও আছে। অতএব ইউটিউবে থাকতেই পারে এবং আছে ও। তবে কে কোনটা গ্রহন করবে এটা তার রুচি মানসিকতার উপর নির্ভর করে। এবং সেই মানসিকতার ভীত বা কাঠামো ও তৈরি হয় পরিবার থেকে।
  • ঈদ সালামীর টাকা পেয়ে সপ্তমশ্রেণী পড়ুয়া মিথিলা (ছদ্মনাম) স্মার্ট ফোন কিনে গোপনে সেটি ব্যবহার ও করে এবং পরিবারের কেউ দেখে ফেলতে পারে আতংকে প্যান্ট বা জামার ভিতরে সর্বদা লুকিয়ে রাখে। মিথিলাকে কে মোবাইল ফোন কিনে দিলো? বা মিথিলা কিভাবে পরিবারের সবাইকে ফাঁকি দিয়ে মোবাইল ফোন কিনে ব্যবহার ও করছে!!
    ঈদ সালামী পাবার পর অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানের কাছে সেই টাকা কেন পিতামাতা রেখে দেন? সে টাকা সন্তানের কাছে রেখে দেবার পর সন্তানে সে টাকা দিয়ে কী করলো না করলো তার-ই বা খোজ রাখেন না কেন?
  • অদ্ভুত লাগলো…! প্রতিটি বাচ্চা উচ্চমাত্রার ইছড়ে পাকা এবং প্রযুক্তি নির্ভর নানানপ্রকার আসক্তি দেখে!! এদের চালচলন, জীবনযাত্রা, বাচনভঙ্গি থেকে সব কিছুই বয়সের সাথে বড্ড বেমানান। বাচ্চাদের এইসব পাকনামোর জন্য সঙ্গ দোষকে দোষারুপ করার আগে পিতামাতাকে খেয়াল রাখতে সন্তান কার সাথে মিশছে। যাদের কথা বললাম এরা সবাই অপ্রাপ্ত বয়সের। এদের দ্বারা কৃত যেকোন ভুল, অন্যায় কিংবা অসামাজিক কার্যকলাপ থেকে যে কোন প্রকার ক্রাইম বা অনাকাঙ্ক্ষিত দূর্ঘটনার এদের ছিটেফোঁটা দায়ী ও কী করা যায়…?
  • এখন তো এদের সবাইকে তো ভালো মন্দ, আলো অন্ধকার, ভুল ত্রুটি, উচিত অনুচিত আচার আচরণ ও জীবনাচরণ অভিভাবক বা পিতা মাতা দ্বারা শেখানোর কথা। সন্তানকে হাতে ধরে যেভাবে অ আ ই ঈ পড়ানো ও লেখানো হয়েছে এবং ভুল করলে কিংবা না পারলে বারংবার চেষ্টা আগ্রহ অব্যাহত রেখেছে ঠিক সেভাবেই এদেরকে সৎ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার দিকেও নজর দেয়ার সময় উঠতি বয়সী এসব ছেলেমেয়েদের। কিন্ত কার্যত আমরা পিতামাতারা কী করছি? গোল্ডেন জিপিএ ৫ এর পিছনে ছুটিছি এবং অতি আদরে স্নেহের সন্তানকে বাদর বানাচ্ছি… অতঃপর বুক ফুলিয়ে উচু গলায় বলছি

-আমার মেয়েটা ১০ বছর বয়সেই শিখে গেছে কেমন করে আঙ্গুলের নখ বড় রাখতে হয়,একদম ববিতা’র মতো করে শাড়ী পরে কারিনা কাপুরের মতো এক্সপ্রেশন দেয়…..

  • এসব নিয়ে আমার মতো মানুষের কিছু বলা ও নিজেকে খেত বানিয়ে ফেলার সামিল। কেউ কেউ তো দাবী করেই বসেন- কী যে বলেন না ভাবী, এসবই যুগের চাহিদা। আপনি বড্ড সেকেলে…।আধুনিকতা স্মার্টনেস এবং নষ্ট ভালোবাসা প্রকাশ করতে গিয়ে পরিবার থেকেই বাচ্চাদের বিপথে ঠেলে দেয়া যতদিন বন্ধ না হবে ততদিন অপ্রাপ্ত বয়স্ক বাচ্চাদের মাঝে অপরাধ প্রবনতা কমবে না। এইসব বাচ্চারা যা নিজেরা বুঝে এবং করে তার বেশিরভাগেই ভুল। অবুঝেরাই তো ভুল করবে। ভুল করার পর সংশোধন করতে সংশোধানাগারে না পাঠিয়ে নিজেই সময় দিন এবং সন্তানকে গড়ে তুলুন সংশোধিত একজন মানুষ হিসেবে। এবং তাকে বোঝান,
    -তোমার এটা করার বয়স হয়নি।
    -এই বয়সে এটা করতে হয়।
    -একদিন সে সব রপ্ত করে নিবেই…।

লেখক: ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার