একজন ‘পদলোভী’ আর ‘কাসেমী বিরোধী’র জবানবন্দী

710
  • ওয়ালীউল্লাহ আরমান

২০১৩’র ফেব্রুয়ারীর শেষ দিক৷ আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী সাহেবের নেতৃত্বে ‘ঈমান বাঁচাও দেশ বাঁচাও’ ব্যানারে বায়তুল মোকাররম উত্তরগেটে বিক্ষোভ সমাবেশের ঘোষণা করা হয়৷ প্রচারের দায়িত্ব পালনের জন্য মুহতারাম কাসেমী সাহেব ফোনে আমাকে নির্দেশ দেন৷ সেভাবেই নিউজ দিই৷ কিন্তু ঘটনাক্রমে বাদ জুমা পল্টনে পুলিশ টিয়ারশেল এবং রাবার বুলেট ছুড়ে আমাদের কর্মসূচী ভণ্ডুল করে দেয়৷ ডিআরইউতে তাৎক্ষণিক সংবাদ সম্মেলন করে পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করেন কাসেমী সাহেব হুজুর৷
সেই রাতে পল্টনে জমিয়ত কার্যালয়ে ডিবি পুলিশ হানা দেয়৷ অফিস তছনছ করে৷ আলমারি ভেঙ্গে মূল্যবান কাগজপত্র নিয়ে যায়৷ আমার এবং রেদওয়ানের ব্যক্তিগত কম্পিউটর এবং আমার পাসপোর্টও নিয়ে যায়৷ মারধর করা হয় রেদওয়ানুল বারী সিরাজী এবং তোফায়েল গাজালী কে৷ দুদিন পর আমার দেশ, ইনকিলাব এবং নয়া দিগন্তে জমিয়ত কার্যলায় তছনছের সচিত্র সংবাদ আসে৷

ইতোমধ্যে নানাদিক থেকে পরামর্শ দেয়া হয় হজরতুল আল্লাম শাহ আহমদ শফি হাফিজাহুল্লাহর নেতৃত্বাধীন ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’ এর ব্যানারে নাস্তিক-মুরতাদ বিরোধী কর্মসূচী পরিচালনার৷ তিক্ত সত্য হলো, এই ব্যানারের কারণে কিছুটা বিব্রতকর অবস্থাতেই পড়তে হয় মুহতারাম কাসেমী সাহেবকে৷

৯ মার্চ হাটহাজারীতে হেফাজতের আহবানে জাতীয় ওলামা-মাশায়েখ সম্মেলন থেকে ফিরে পরদিন ঢাকার মানিকনগর মাদরাসায় পরামর্শ বৈঠক বসে৷ জনাব কাসেমী সাহেব মুফতী ওয়াককাস সাহেবকে ঢাকা মহানগর আহ্বায়কের দায়িত্ব নিতে প্রস্তাব দেন৷ তার বিপরীতে মুফতী ওয়াককাস সাহেব বলেন, যেহেতু আপনি ঢাকায় থাকেন, সেজন্যে ঢাকা মহানগরের আহ্বায়কের দায়িত্ব আপনিই নিন৷ মুফতী সাহেবের প্রস্তাবে সবাই সমর্থন জানালে কাসেমী সাহেব হুজুর হেফাজতে ইসলাম ঢাকা মহানগর আহ্বায়ক মনোনীত হন৷ মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীব সাহেব হন সদস্য সচিব৷

পরিচিত সাংবাদিকদের অনুরোধ জানিয়ে আমি গোপিবাগ আরকে মিশন রোডের দোকান থেকে রাত সাড়ে আটটায় নিউজ পাঠাই৷ সাধারণত এতো রাতের নিউজ কাভারেজ পায় না৷ কিন্তু সময়ের চাহিদায় পরদিন ১১ মার্চ প্রথম আলো, নয়াদিগন্ত, আমার দেশ, ইনকিলাব, সংগ্রাম, বাংলাদেশ প্রতিদিনে ‘ঢাকা মহানগর হেফাজতের কমিটি গঠন’ শিরোনামে সংবাদ আসে৷ এটা কোনো কৃতিত্বের দাবী নয়, তবে ঢাকায় হেফাজতের প্রথম নিউজটি আমার হাতে হয়েছে এবং সংবাদকর্মীদের কাছে প্রথম মেইলটিও আমার মেইল আইডি থেকে গিয়েছে এটা ভাবলে একটা তৃপ্তির অনুভূতি জাগে মনে৷

এরপর আহলুল্লাহ ওয়াসেল ভাই, আমি ওয়ালী উল্লাহ আরমান, আতাউল্লাহ আমীন ভাই, ফখরুল ইসলাম ভাই, আব্দুল জলিল ভাইর সমন্বয়ে ঢাকা মহানগর হেফাজতের প্রচার সেল গঠিত হয়৷ এটা সত্য যে, শুরু থেকেই ঢাকা মহানগর হেফাজত কমিটি নিয়ে বিরোধ ছিলো৷ একদিকে ইসলামী ঐক্যজোট নেতারা নিজেদের প্রভাব বজায় রাখার জন্য চাচ্ছিলো মহানগর সদস্য সচিব হবেন তাদের মুফতী ফয়জুল্লাহ সাহেব৷ এর কয়েকদিন পর মহানগর কমিটি পুনর্গঠনের জন্য তারা হেফাজত মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী সাহেব, সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী ভাই, মাওলানা মইনুদ্দীন রুহি প্রমুখকে দাওয়াত দিয়ে লালবাগে হেফাজতের বৈঠক ডাকান৷ মাওলানা মহিউদ্দীন ইকরাম ভাইর পরিকল্পনায় মিটংয়ের আগে থেকেই আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রাখি যে, তারা মহানগর সদস্য সচিব পরিবর্তনের কথা বললে আমরা চতুর্দিক থেকে প্রতিবাদ জানাবো৷ বাস্তবে হয়ও তেমনটাই৷
মুফতী ফয়জুল্লাহ সাহেব দাড়িয়ে “আহ্বায়ক নিয়ে কোনো কথা নেই, তবে সদস্য সচিব পদে পুনর্বিবেচনা করতে হবে বললে” চতুর্দিক থেকে সমস্বরে আমরা প্রতিবাদ জানাই এবং জুনায়েদ আল হাবীব সাহেব স্বপদে টিকে যান৷

ঢাকা নগর কমিটিতে তাদের পদপদবী যাই হোক, ৫ মে পর্যন্ত লালবাগ মাদরাসা দোর্দণ্ড প্রতাপে ঢাকার একক কেন্দ্র হিসেবে কর্তৃত্ব নিজেদের হাতেই রাখে৷ এই তিন মাসে লালবাগের রাজনৈতিক চালের মোকাবেলায় বারিধারাও কিছু চাল রপ্ত করে৷ তাছাড়া কূটনৈতিক জোনে থাকার কারণে কিছু কৌশল তাদের এমনিতেই আয়ত্ব করতে হয়৷

পাঁচ মে পরবর্তী ইতিহাস কমবেশ সবার জানা৷ একদিকে কিছু নাম ঘৃণা আর ধিক্কারের পাত্র হয়, কেউ কেউ রাতের আঁধারে লন্ডন পাড়ি জমায়, গ্রেফতার হন দুয়েকজন, আর অধিকাংশ নেতা [শীর্ষ, মাঝারী, তৃতীয় সারি] আত্মগোপনে যান৷ ক’মাস পর মুফতী ওয়াককাস সাহেবও গ্রেফতার হন৷
আল্লামা কাসেমী সাহেব বারিধারা কেন্দ্রিক হেফাজতের কাজ শুরু করেন৷ প্রচারের মূল দায়িত্ব আমার উপর অর্পিত হয়৷ সাথে ছিলেন আতাউল্লাহ আমীন ভাই, মাওলানা আব্দুল মালেক ভাই প্রমুখ৷

শাপলা চত্বর ম্যাসাকারের পর জমিয়তের প্রথম আমেলার বৈঠক হয় ২০১৩ সালের আগস্টে মানিকনগর মাদরাসায়৷ বৈঠকে মাওলানা ওবায়দুল্লাহ ফারুক সাহেব তার স্বভাবসুলভ ভাষায় বলেন, “এখন জমিয়তের চেয়ে আমরা হেফাজতকে নিয়ে সামনে বাড়বো৷”
জবাবে মুফতী ওয়াককাস সাহেব বলেছিলেন, “এভাবেই কিন্তু আমরা খেলাফত আন্দোলন নিয়ে অতিব্যস্ত হবার পর কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতা ওখানে রেখে ফিরে আসতে হয়েছিলো৷ সুতরাং আমরা চাই হেফাজত হেফাজতের গতিতে চলুক, আমরা জমিয়তের সাংগঠনিক কাজ সামনে বাড়াবো৷”

ওদিকে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদকের পাশাপাশি ঢাকা মহানগর হেফাজতের প্রচারের কাজও করতে থাকি সমান্তরালে৷
লালবাগ কেন্দ্রিক নেতাদের জাতীয় নেতৃত্ব এবং মিডিয়া সংশ্লিষ্টতা সাড়ে তিন দশকের৷ সেই বৃত্ত মোকাবেলায় অনেকটা একাকী লড়তে হয়েছে আমাকে৷ কারণ মুহতারাম কাসেমী সাহেব জমিয়ত নেতা আর আমি কর্মী, স্বাভাবিকভাবেই আমার চেষ্টা ছিলো হেফাজতের প্রচারের ফোকাসটা যেনো জমিয়তের দিকেই মানে কাসেমী সাহেব হুজুরের উপর থাকে৷

তখনো পর্যন্ত কাসেমী সাহেব হুজুর মিডিয়া এড়িয়ে চলতেন৷ বিভিন্ন ইস্যুতে গণমাধ্যম তার বক্তব্য নিতে চাইলে আমি হুজুরকে বলি৷ জবাবে হুজুর বলেন, তুমি বলো তো, “এর কি জবাব হতে পারে?”
আমি সম্ভাব্য জবাবটি বললে হুজুর বলেন, “ঠিক আছে, আমার নাম বলে এটাই বলে দাও৷”
বিবিসির ওয়ালী উর রহমান খান, রয়টার্সের রিপোর্টার, অস্ট্রেলিয়ান টিভি সাংবাদিক আলাদাভাবে কাসেমী সাহেব হুজুরের সাক্ষাতকার নিতে চায়৷ তিনি নিমরাজি থাকলেও আমাদের জোরাজুরিতে সবগুলোতেই ভিন্ন ভিন্ন সময়ে কথা বলেন৷
বাংলাদেশ প্রতিদিন কাসেমী সাহেব হুজুরের সাক্ষাতকার নিবে৷ তাদের লিখিত প্রশ্ন আমাকে দেয়৷ আমি হুজুরের সামনে তুলে ধরি৷ তিনি বলেন, “তুমি জবাবগুলো লিখে আমাকে দেখাও৷” আমি লিখে ফোনে হুজুরকে শুনাই৷ বলেন, “সুন্দর হয়েছে৷ ওটাই দিয়ে দাও৷” অতঃপর বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রথম পৃষ্ঠায় আমার মোবাইলে তোলা ছবিসহ হুজুরের সাক্ষাতকার আসে৷ [এগুলো সম্পর্কে মুহতারামের ওই সময়ের একান্ত কাছের সকলেই অবগত আছেন]

ইতোমধ্যে সময় অনেক গড়িয়েছে৷ রাজনীতির পাকা ড্রিবলার মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী সাহেব ও মাওলানা তাফাজ্জুল হক আজীজ সাহেব, শ্রোতাপ্রিয় ভোকাল মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীব সাহেব জমিয়তে যোগ দিয়েছেন৷ তারা পূর্ব থেকেই মুহতারাম কাসেমী সাহেবের কিচেন কেবিনেটের মেম্বার ছিলেন৷ জমিয়তে আসার পর তারা সার্বক্ষণিক বারিধারাতেই পড়ে থাকেন৷ অবশ্য এটা তাদের ব্যাপার, তারা থাকতেই পারেন৷

কিন্তু তাদের তৎপরতার ফলে আস্তে আস্তে সক্রিয় দায়িত্বশীলদের দূরে সরানো শুরু হয়৷ প্রথমে মাওলানা গোলাম মহিউদ্দীন ইকরাম ভাইকে হেফাজতের প্রোগ্রাম থেকে দূরে সরানো হয়৷ ২০১৫ এর রমজানে হেফাজতের দুটি প্রোগ্রাম তথা প্রথমত, সংবাদ সম্মেলন সম্পর্কে জানতেই পারিনি৷ আর ইফতার মাহফিলের সংবাদ পাই সেদিন সকালে৷

রমজানের পর পুনরায় সংবাদ সম্মেলনের জন্য কাসেমী সাহেব হুজুর নিজে আমাকে ফোনে নিউজ দেয়া এবং সংবাদকর্মীদের দাওয়াত দিতে নির্দেশ দেন৷ আমিও হুকুম তামিল করি৷ তার আগের রমজানের দুটি প্রোগ্রামে সাংবাদিকদের উপস্থিতির চেয়ে ওইদিনের প্রোগ্রামে উপস্থিতিও বেশী হয়৷

সংবাদ সম্মেলন শেষে আমি বারিধারার অফিসে মুহতারাম কাসেমী সাহেব হুজুরের কাছে সবিনয়ে মিনতি জানাই, ‘হুজুর! আপনার নির্দেশে এই তিনবছর হেফাজতের প্রচারের কাজ করতে সচেষ্ট ছিলাম৷ এতে ঢাকা হেফাজতের অনেকে আমার উপর রুষ্টও হয়েছে৷ কিন্তু আপনার হুকুম তামিলে তাদের তোয়াক্কা করিনি৷ আমার কোনো ভুল হলে সেটা আমি জানতে পারলে সেটা শুধরাবো৷ কিন্তু হুজুর গত মাসের দুটি প্রোগ্রামের ব্যাপারে জানতেই পারিনি৷ মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী সাহেব এবং মাওলানা ফজলুল করীম সাহেব [তাদেরকে সামনেই বলি] আমাকে বলতে নিষেধ করেছেন৷ যদিও আমি জেনেছি, আপনি ওইসময় এতেকাফে বসে প্রচারের দায়িত্ব আমাকে দিতে বলেছিলেন৷’
তিনি বললেন, “প্রচারের কাজ তুমিই করবা৷” লম্বাচওড়া ঘটনার সারসংক্ষেপ হলো, মাওলানা ফজলুল করীম কাসেমী নানা কূটচালে এরপর আমাকে মহানগর হেফাজতের কাজ থেকে সরে যেতে বাধ্য করেন৷

একই কাজ জমিয়তের ব্যাপারে করেন মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী সাহেব৷ ২০১৪’র এপ্রিলে তিনি জমিয়তে যোগ দিয়ে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বাগিয়ে নেন৷ যথা কেন্দ্রীয় সহসভাপতি [যদিও তিনি অন্য যেকোনো সংগঠনের প্রোগ্রামে গিয়ে নিজেকে জমিয়তের সিনিয়র সহসভাপতি পরিচয় দেন৷ প্রমাণ হিসেবে আজকের নয়া দিগন্ত ২য় পৃষ্ঠায় মুসলিম লীগের নিউজ দেখতে পারেন৷ যেখানে তার পরিচয় দেয়া হয়েছে ‘জমিয়তের সিনিয়র সহসভাপতি’৷ বিষয়টি সম্পর্কে গতকাল জুমার পর মুসলিম লীগ মহাসচিব কাজী আবুল খায়েরকে জিজ্ঞেসও করেছিলাম যে, আপনাদের প্রেসক্লাবের আজকের প্রোগ্রামে ঘোষণা করলাম ইউসুফী সাহেব জমিয়তের সিনিয়র সহসভাপতি, অথচ সেই দায়িত্বে আছেন আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী সাহেব? তিনি হেসে জবাব দেন, “ইউসুফী সাহেব নিজে ঘোষককে এই পরিচয় লিখে দিয়েছেন”] দ্বিতীয়ত তিনি জমিয়তের গঠনতন্ত্র সংশোধন কমিটির সদস্য, সাংগঠনিক উপকমিটির সদস্য এবং প্রচার উপকমিটির আহবায়ক হন৷ যার সদস্য ছিলেন মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী ভাই, মাওলানা বাহাউদ্দীন জাকারিয়া সাহেব, মাওলানা গোলাম মহিউদ্দীন ইকরাম ভাই এবং মাওলানা মতিউর রহমান গাজীপুরী সাহেব৷ আর সদস্য সচিব আমি৷ মজার বিষয় হলো, মাওলানা ইউসুফী সাহেব আহ্বায়ক হিসেবে কখনো সহায়তা তো দূরের কথা বরং তিনি দুয়েকবার শুধু এ কথা বলার জন্য ফোন দিয়েছেন যে, “আজ নিউজ গেলে আমার নামেও একটা বক্তব্য দিবেন৷”

২০১৫ এর সেপ্টেম্বরের ১১/১২ তারিখ বারিধারায় জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন শেষে আমি মুহতারাম কাসেমী সাহেব হুজুরকে সবিনয়ে বলি, ‘কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের প্রচারের জন্য আপনি যেভাবে নির্দেশ দিবেন, ইনশাআল্লাব আমরা সর্বোচ্চ প্রচারণা চালাবো৷’ জবাবে কাসেমী সাহেব হুজুর বলেন, “প্রচারের কাজ তো তোমাকেই করতে হবে৷ আজকের মিটিংয়ের নিউজ করে দিও৷” আফসোসের বিষয় হলো, আমি সেখান থেকে বেরোনের পরপর মাওলানা ইউসুফী সাহেব হুজুরকে বলেন, “কাউন্সিলের প্রচারের কাজ আমরাই করবো, সেজন্যে ওয়ালী উল্লাহকে লাগবে না৷”

অক্টোবরের ৪ তারিখ আমি বারিধারা যাই৷ সেদিন কুরবানীর জন্য মাদরাসা বন্ধ ছিলো৷ একাকী দু’ঘন্টার মতো আল্লামা কাসেমী সাহেব হুজুরের কাছে জমিয়তের সার্বিক বিষয়ে কথা বলি৷ যন্ত্রণাকাতর মনে কাউন্সিলের প্রচার কাজ থেকে আমাকে দূরে সরানোর কথাও বলি৷ কিন্তু চার-পাঁচ মাস পূর্বের মতো এবার আর তিনি স্বাভাবিকভাবে আমার কথার উত্তর দেননি৷ আমি মুফতী ওয়াককাস সাহেব এবং তার মধ্যকার দূরত্বের কথা বলে মিনতি জানাই, ‘আপনাদের অভিন্ন গতিতে চলতে দেখলে কর্মীরা উৎসাহ পায়৷’ আমার জবাবে মুহতারামের নির্লিপ্ততা আমাকে বলে দেয়, “কালের প্রবাহ এবং যুগের নির্মমতা অনেক কিছু বদলে দিয়েছে৷”

আমি বুঝতে পারি, বড় বড় রথিমহারথিকে যখন স্তাবক হিসেবে পাওয়া যায়, মহাপ্রতাপশালী সম্রাটদের দরবারে তখন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুসারীদের তেমন প্রয়োজন পড়ে না৷ বরং তারা হয়ে যায় অপাংক্তেয়৷

আমি কিছু নসীহত নিয়ে মুহতারামের কাছ থেকে বিদায় নিই৷ কিন্তু নিতান্ত আফসোস জাগে, যখন মনে হয় ওইটাই ছিলো উম্মতের এই মহান রাহবার এবং মানুষ গড়ার কারিগরের সাথে নিবিড়ে কথা বলার শেষ মুহূর্ত৷ কারণ পরিচিতরা সবাই এ কথা বিলক্ষণ জানে যে, একবার যদি তার মনে কারো ব্যাপারে নেতিবাচক কিছু ঢুকিয়ে দেয়া যায়, সেটা দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর হয়ে দাড়ায়৷

আসলে চাটুকার এবং কুচক্রিরা যখন সরলমনের কাউকে ঘিরে রাখে, আফসোসে পুড়তে হয় অবিচারের শিকার মানুষদেরকে৷ কিন্তু তাতে পৃথিবী তো থমকে যায় না, চলতে হয় নিজের গতিতে৷

প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং কোটারি স্বার্থ তৈরীর দুরভিসন্ধিতে দুই পিলারের মাঝে যারাই ফাটল তৈরী করলেন কোনো একদিন আপনাদেরকে জবাব দিতেই হবে৷ কিন্তু তাতে ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের, বন্ধুর সাথে বন্ধুর সম্পর্ক যে বিচ্ছিন্ন হলো, তাতে তো আর জোড়া লাগবে না৷

রোবট সোফিয়ার মতো অল্প বয়সী আবেগী শিষ্য-শাগরেদ-অনুসারী যাদের মগজে বানোয়াট বক্তব্য ঢুকিয়ে সাময়িক বিদ্বেষ তৈরীর বিকৃত আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে লাভ নেই, নিশ্চয়ই এটাও একদিন আপনাদের জন্য পরিতাপ বয়ে আনবে৷

কেউ কেউ আছে আঞ্চলিকতার কারণে অন্ধের মতো না জেনেই যা তা বলে৷ তারা না সংগঠন বোঝে, আর না সংগঠনের ইতিহাসের কিছু জানে৷ এরা বিশেষ মহল কর্তৃক মিসগাইডের শিকার৷
কেউ আছে প্রাতিষ্ঠানিক কারণে অযাচিত বক্তব্য দেয়, মন্তব্য করে৷ তারা বিবেক বন্ধক দিয়েছে৷
কেউ কেউ আছে, কর্মী হিসেবে আমার প্রচেষ্টা আর পরিশ্রম সবই দেখেছে৷ আগাগোড়া এই অনিয়ম আর স্বেচ্ছাচারিতার সব জেনেও তারা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায়, বিদ্বেষ আর বিষোদ্গারের কোরাসে কণ্ঠ মেলায়৷

প্রথম দুই শ্রেণীর প্রতিক্রিয়া নিয়ে আমার কিছুই এসে যায় না৷ কিন্তু পরিতাপ জাগে, করুণার উদ্রেক হয় তৃতীয় পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের হীনম্মন্যতা দেখে৷ তবে, এটাও বাস্তবতা৷ এটা মেনে নিয়েই চলতে হয় আমাকে৷

লেখক: জমিয়তের সাবেক প্রচার সম্পাদক ও বর্তমান কৃষি বিষয়ক সম্পাদক।