ইউপি নির্বাচন: পাহাড়ের সমীকরণে নাকাল জাতীয় রাজনীতি!

1032

এখন রিপোর্ট।।

এক ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনেই যেন পরিষ্কার হয়ে গেল পাহাড়ের রাজনীতিতে জাতীয় আর আঞ্চলিক দলের পার্থক্য। আঞ্চলিক রাজনীতিতে জাতীয় প্রভাব-প্রতিপত্তির সীমারেখা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ইউপি ভোট।

এবারের ইউপি নির্বাচনে রাঙামাটির ৪৯টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪৮ ইউনিয়নের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সীমানা জটিলতার কারণে কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনা ইউনিয়নের নির্বাচন স্থগিত রয়েছে।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হওয়ার পরেই আঞ্চলিক রাজনীতিতে প্রথম আলোচনাটি শুরু হয় পাহাড়ের অন্যতম ক্ষমতাধর রাজনৈতিক দল সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত না হওয়া এবং সরাসরি প্রার্থী দিতে না পারা নিয়ে। কিন্তু নির্বাচনের শেষে দেখা গেছে, জেএসএস সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই বিজয়ী হয়েছেন অর্ধেক ইউনিয়নে অর্থাৎ ২৪টিতে।

আর পাহাড়ের অন্য দুই আঞ্চলিক দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) আটটি এবং জনসংহতি সমিতি-এমএন লারমা একটি ইউনিয়নে বিজয়ী হয়েছে।

অপরদিকে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ১৩টি আর বিএনপি একটি ইউনিয়নে বিজয়ী হয়েছে। আর পুরো জেলায় একমাত্র নির্দলীয় প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হয়েছেন লংগদু সদর ইউনিয়নের কুলিনমিত্র চাকমা আদু।

আর তাই ভোট শেষে পাহাড়ের রাজনীতি সংশ্লিষ্ট অনেকেরই মত, পাহাড়ের রাজনীতিতে জাতীয় এবং আঞ্চলিক দলগুলোর অবস্থানগত পার্থক্য যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল এই নির্বাচনের ফলাফল।

‘সন্তুষ্ট নয়’ আওয়ামী লীগ
রাঙামাটির ৪৮টি ইউনিয়নের মধ্যে মাত্র ১৩টিতে বিজয়ী হওয়ায় স্পষ্টতই অসন্তুষ্ট ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দলটির প্রধান নেতাদের দাবি, আঞ্চলিক দলগুলোর অবৈধ অস্ত্রের দাপট না থাকলে অন্তত ২৫ থেকে ৩০টি ইউনিয়নে বিজয়ী হতেন তাঁরা।

রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজি মো. মুছা মাতব্বর বলেন, ‘আমরা বারবার দাবি করে আসছিলাম, জেএসএস-ইউপিডিএফ আর সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত তিন আঞ্চলিক দলের অস্ত্রবাজির কাছে পাহাড়ের মানুষ অসহায়। এদের অবৈধ অস্ত্রের দাপটের কারণে মানুষ স্বাভাবিকভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করে আঞ্চলিক দলগুলোর সশস্ত্র কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা পর্যন্ত এখানে শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।’

রাঙামাটি সদর, জুরাছড়ি এবং নানিয়ারচর উপজেলায় একটি ইউনিয়নেও জয়ী হতে পারেনি আওয়ামী লীগ। জুরাছড়ির চারটি আর রাঙামাটি সদর উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নেই বিজয়ী হয়েছেন সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির প্রার্থীরা। আর নানিয়ারচর উপজেলার চারটি ইউনিয়নেই বিজয়ী হয়েছেন ইউপিডিএফ প্রার্থীরা। এই তিনটি উপজেলায় সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচনেও বিজয়ী হতে পারেনি আওয়ামী লীগ, এমনকি সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনেও নৌকার বাক্সে পড়া ভোটের সংখ্যা ছিল নগণ্য।

নানিয়ারচর সদর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ঝিল্লোল মজুমদার, রাঙামাটির সাপছড়ি ইউনিয়নের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান এবং কাপ্তাইয়ের রাইখালীর প্রার্থী মংক্য মারমাও অভিযোগ করেছেন, আঞ্চলিক দলগুলোর সশস্ত্র ক্যাডাররাই ভোটের পুরো প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করেছে। এদের কারণে ভোটের স্বাভাবিক পরিবেশ ছিল না। এই দলগুলোর ক্যাডাররা ভোটকেন্দ্রে না থাকলে কেন্দ্রের আশপাশে সশস্ত্র অবস্থান নিয়ে সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ করেছে। এবং প্রশাসনও এদের বিষয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ তাঁদের।

বিএনপির ভরাডুবি
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে রাঙামাটি জেলায় বিএনপির ইতিহাস কখনই সুখকর নয়। তবু জেলার লংগদু, কাউখালী এবং কাপ্তাইয়ে বরাবরই ভালো ফলাফল করত দলটি। তবে এবার পুরো জেলায় একমাত্র লংগদু উপজেলার গুলশাখালী ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছেন জেলা বিএনপির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আবু নাছের। তবে এখানে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় জয় পাওয়া সহজ হয়েছে তাঁর জন্য।

এদিকে কাপ্তাইয়ের ওয়াগ্গ্যা এবং কাউখালীর বেতবুনিয়ায় ক্ষমতাসীনদের দাপটে সকাল ১০টাতেই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন দুই তরুণ প্রার্থী শওকত হোছাইন চৌধুরী এবং জাফর আহম্মেদ স্বপন। সব মিলিয়ে বিএনপির এককালের অঘোষিত ঘাঁটি লংগদুতে হানা দিয়ে সাতটি ইউনিয়নের চারটিতেই ছিনিয়ে নিয়েছে আওয়ামী লীগ।

এহেন ভরাডুবির পর রাঙামাটি জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হাজি মো. শাহ আলম বলেন, যারা দেশে নির্বাচনের নামে যা হয়েছে রাঙামাটিতেও তার চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু হয়নি, বরং এখানে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে যোগ হয়েছে আঞ্চলিক দলগুলোর সশস্ত্র দাপট।

মো. শাহ আলমের দাবি, যদি নির্বাচন সুষ্ঠু এবং অবাধ হতো তবে যে ২১টি ইউনিয়নে প্রার্থী দেওয়া হয়েছিল তার অন্তত ২০টিতেই বিজয়ী হতো ধানের শীষের প্রার্থীরা। এ ছাড়া এই নির্বাচনে জন রায়ের সত্যিকার প্রতিফলন ঘটেনি বলে মন্তব্য তাঁর।

ফুরফুরে মেজাজে জনসংহতি সমিতি
জেলার ৪৮টি ইউনিয়নের মধ্যে অর্ধেক অর্থাৎ ২৪টিতে বিজয়ী হওয়ায় ফুরফুরে মেজাজে আছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে বিজয়, উপজেলা নির্বাচনে জেলার ১০টি উপজেলার মধ্যে ছয়টিতে বিজয়ের পর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও অধিকাংশ ইউনিয়নে বিজয়কে দলটির প্রতি জনগণের ‘আস্থা ও সমর্থন’-এর প্রতিফলন বলে ভাবছেন দলের শীর্ষ নেতারা।

জনসংহতি সমিতির মুখপাত্র সজীব চাকমা দাবি করেন, ‘জনগণ বারবার আমাদের প্রার্থীদের বিজয়ী করে প্রমাণ করছে সরকারের কার্যক্রমে তারা সন্তুষ্ট নয় এবং তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন চায়।’ নির্বাচনের সামগ্রিক পরিবেশে সন্তোষ প্রকাশ করে বরকল উপজেলার ভূষণছড়ার ইউনিয়নের নির্বাচনে ছোট হরিণা কেন্দ্রে পুনর্নির্বাচন দাবি করেন তিনি।

আঞ্চলিক দলগুলোর ‘বিরল সমঝোতা’
ছয় মাস ধরেই পাহাড়ের আঞ্চলিক তিন দলের মধ্যে ‘বিরল সমঝোতা’ চলছে। ফলে গত ১৮ বছরে এই তিনটি দলের বিরোধে অন্তত কয়েকশ নেতাকর্মী এবং সমর্থক মারা গেলেও সাম্প্রতিক পরিবেশ ভিন্ন।

এখন জেএসএস, ইউপিডিএফ, এমএন লারমা- এই তিনটি দলের নেতাকর্মীদের প্রকাশ্যেই একসঙ্গে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। এর প্রভাব পড়েছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও। নির্বাচনের আগেই নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে নিয়ে প্রার্থী দেয় দল তিনটি। যেখানে যার অবস্থান ‘শক্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ’সেখানে সেই দলের প্রার্থী দেয় তারা। ফলও পায় হাতে নাতে। সমঝোতার নির্বাচনের ফলে জেলার ৪৮টি ইউনিয়নের ৩৩টিতেই বিজয়ী হয়েছে আঞ্চলিক দলগুলো।

একমাত্র নির্দলীয় প্রার্থী ‘আদু হেডম্যান’
জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর মার্কা আর আঞ্চলিক দলগুলোর দাপটের মাঝেও বিজয়ী হয়ে নিজের পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থানেরই যেন পরীক্ষা দিলেন লংগদু সদর ইউনিয়নের নির্দলীয় প্রার্থী কুলিনমিত্র চাকমা। সবার কাছে যিনি ‘আদু হেডম্যান’ হিসেবেই পরিচিত।

নৌকা এবং ধানের শীষের প্রার্থীর পাশাপাশি এখানে ছিল প্রভাবশালী জনসংহতি সমিতির প্রার্থীও। কিন্তু সবাইকে পেছনে ফেলে বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন আদু। নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি তাই বলেন, ‘আমি কোনো দল বা গোষ্ঠীর প্রার্থী নই, পাহাড়ি-বাঙালি সবার ঐকমত্যের প্রার্থী ছিলাম, তাই মানুষ আমাকে মূল্যায়ন করেছেন। তাই আমি কৃতজ্ঞ।’

এখন/এমএ