আবারও কি কান্নাই বিপদ ডেকে আনবে ব্রাজিলের?

634

চার বছর আগে নিজের দেশে হওয়া বিশ্বকাপে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার চরম মূল্য দিতে হয়েছিল লুইস ফেলিপে স্কলারির দলকে। এবারও সেই আবেগাপ্লুত ব্রাজিলকে দেখা যাচ্ছে রাশিয়ায়। যেটা দেখে অনেকেই বলছেন, এটা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সেলেসাওদের স্বপ্নপূরণ কঠিন হয়ে যেতে পারে। আজ সার্বিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে আবেগও হয়তো নেইমারদের অদৃশ্য প্রতিপক্ষ।

গত শুক্রবার সেন্ট পিটার্সবার্গে কোস্টারিকার বিপক্ষে ম্যাচটার কথাই মনে করে দেখুন না। ব্রাজিল ২-০ গোলে জেতা ম্যাচটার শেষ বাঁশি বাজতেই মাঠে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন নেইমার। দুই হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করলেন। পরে নিজেই জানিয়েছেন সেই কান্নার কারণ, ‘এখানে (রাশিয়া) আসতে আমি কিসের মধ্য দিয়ে গিয়েছি, তা সবাই জানে না। এই কান্না আনন্দের, সমস্যা কাটিয়ে ওঠার এবং জয়ের ইচ্ছা প্রকাশের।’

চোটের কারণে তিন মাসের বেশি মাঠের বাইরে থাকা, তারপর একটা পুরো দেশের প্রত্যাশা নিজের কাঁধে নিয়ে রাশিয়ায় আসা, প্রথম ম্যাচে সেই প্রত্যাশার ধারেকাছেও না যেতে পারা পারফরম্যান্স। চারপাশ থেকে ধেয়ে আসা সমালোচনা। এত কিছুর পর কোস্টারিকার বিপক্ষে গোল করে একটু আবেগাপ্লুত নেইমার হতেই পারেন।

তবে সেদিন তাঁর এই কান্না মনে করিয়ে দিয়েছে চার বছর আগের ব্রাজিলের কথাও। ২০১৪ বিশ্বকাপে চিলির বিপক্ষে টাইব্রেকারে জেতার পর এভাবেই কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড়েরা। যেটিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন থিয়াগো সিলভা ও নেইমার। যা দেখে সেই সময়ের কোচ লুইস ফেলিপে স্কলারি পরের ম্যাচগুলোর আগে নেইমারদের জন্য বিশেষ মনোবিদ ডেকে এনেছিলেন। তাতেও খুব একটা লাভ হয়নি। কোয়ার্টার ফাইনালে কলম্বিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে হুয়ান ক্যামিলো জুনিগার ট্যাকলে নেইমারকে হারায় ব্রাজিল। তাঁকে ছাড়া খেলতে নামা সতীর্থরা জার্মানির বিপক্ষে সেমিফাইনালের আগেই জাতীয় সংগীতের সময় অঝোরে কেঁদেছেন। তারপরের গল্পটা তো সবারই জানা। ৭-১ গোলে হেরে নতুন ট্র্যাজেডির জন্ম দেওয়া।

এবারও বাছাইপর্বে দুর্দান্ত খেলে আসা ব্রাজিলের কাছে আকাশচুম্বী প্রত্যাশা। প্রথম ম্যাচ না জিততে পারায় সেই প্রত্যাশাই পাহাড়সম হয়ে যায় বলে দাবি রাইট ব্যাক ফাগনারের, ‘আমরা বাছাইপর্বে ও প্রীতি ম্যাচে যা করেছি, সেটাই অনেক প্রত্যাশা তৈরি করেছে। ওটাই চাপ হয়ে গেছে আমাদের, ওতেই প্রথম ম্যাচটা জেতার বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছিল।’

এই চাপ অনুভব করাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু ব্রাজিলিয়ান–সমর্থকেরা যেটা খুব ভালোভাবে নেননি, তা হচ্ছে মাঠে নেইমারের নিয়ন্ত্রণহীন আবেগ, পরে কান্না। কেউ কেউ তো তাঁকে নাটুকেপনার দায়েও অভিযুক্ত করছেন। রেফারির একটা সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হয়ে মাটিতে বল ছুড়ে মেরে হলুদ কার্ড দেখেছেন। কোস্টারিকার বিপক্ষে ওই ম্যাচেরই ৮৩ মিনিটে রেফারির নির্দেশে থিয়াগো সিলভা প্রতিপক্ষের কাছে বল দেওয়াতে মাঠেই নেইমার তাঁকে গালিগালাজ করেছেন। সিলভার তাতে রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। যদিও তিনি পাল্টা কিছু বলেননি; বরং ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ‘নেইমার আমার ছোট ভাইয়ের মতো। আমি সব সময় তাকে আগলে রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু কোস্টারিকার খেলোয়াড়দের বল ছেড়ে দিয়েছিলাম বলে সেদিন ও আমাকে খুব অপমান করেছিল। কিন্তু আমি ওদের বলটা ছেড়ে দিয়ে ভুল করিনি। কারণ, তখন খেলাটা দ্রুত শুরু করা দরকার ছিল।’

এ ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাবেক ফরাসি ফরোয়ার্ড এরিক ক্যান্টোনা তো নেইমারকে ছিঁচকাঁদুনে হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইনস্টাগ্রামে ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি সক্রেটিসের দেশের জার্সি গায়ে প্রত্যয়দীপ্ত মুখের একটা ছবি দিয়ে লিখেছেন, ‘আর প্রতারণা নয়, আর মায়াকান্না নয়। আমরা ব্রাজিলকে যেভাবে ভালোবাসতাম, সেভাবে ভালোবাসতে চাই।’ যার অর্থ, নেইমারদের সক্রেটিসদের ব্রাজিলের মতো দেখতে চান ক্যান্টোনা।

রাশিয়া বিশ্বকাপে অবশ্য শুধু নেইমার একাই কাঁদেননি। জার্মানির বিপক্ষে জয়ের পর হাভিয়ের হার্নান্দেজকেও কাঁদতে দেখা গেছে, গত রোববার জাতীয় সংগীতের সময় কেঁদেছেন প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে আসা পানামার অধিনায়ক রোমান তোরেসও। কান্না নতুন নয় ব্রাজিলের জন্যও। ১৯৫৮ ফাইনালে সুইডেনকে হারিয়ে কেঁদেছিলেন সদ্য কৈশোর পেরোনো পেলে। ১৯৮২ বিশ্বকাপে ইতালির বিপক্ষে নিজের ভুলে দলকে একটা গোল খাওয়ানোর পর কেঁদেছিলেন ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডার তুনিনহো কেরেজোও।

খেলা মানেই আবেগ, মাঠে সেটির প্রকাশও থাকবেই। তবে সেটি মাত্রা ছাড়িয়ে গেলেই বিপদ। তখন সেটি প্রভাব ফেলে পারফরম্যান্সে। নেইমারকে নিয়ে ব্রাজিলের ভয়ও সেখানেই।