শাহাদাত হোসেন তৌহিদ :
প্রতিমা শিল্পী যেমন তার সকল দক্ষতা ও সৃজনশীলতা দিয়ে তুলিতে সাধের প্রতিমা তৈরি করেন। মনের মাধুরী মিশিয়ে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলেন চোখে, মুখে, কানে, নখে, হস্তে, বাহুতে, চুলে তথা সমস্ত মানবাকৃতিতে। পূর্ণতা পায় দেবীর অনন্য মোহনীয় রুপ! মর্ত্যের মানুষের কাছে সে প্রিয়ার রুপে আবির্ভূত হন। ঠিক একজন বিউটিশিয়ানও ক্লাইন্টদের চাহিদা অুনযায়ী তার দক্ষতা ও সৃজনশীলতা দিয়ে মানুষকে ফুঁটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। মনের মাধুরী মিশিয়ে তিনি নারীর ভেতরের সৌন্দর্যটাকে বের করে আনেন। বিভোর করে দেন দর্শকদের। তখন তিনি প্রিয়ার রুপে আবির্ভূত হন তার প্রেমিকের কাছে।
তেমনি একজন মেক-আপ আর্টিষ্ট সঞ্চিতা বণিক। তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন তার কাজের দক্ষতা, উপস্থাপনের নান্দনিকতা, গুণগত মান, সততা ও পরিশ্রমকে পুঁজি করে। তার কাজে রয়েছে সৃজনশীলতা ও সৌন্দর্যের ছাপ, চোখেমুখে তার প্রচুর শেখা ও জানার নেশা। পেশাগত কাজকে তিনি সবকিছু থেকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। কাজের দক্ষতা দিয়ে তিনি আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন এ প্রজন্মের রমণীদের। ছাগলনাইয়া, ফেনীসহ আশপাশের স্থানীয় তরুণীদের কাছে তিনি পছন্দের অন্যতম একজন মেক-আপ আর্টিষ্ট। বিয়ে, বৌ সাজ, হেয়ার স্টাইল, রিবোন্ডিং, ফেসিয়াল, ব্রু ফ্লাগ, চুল কাটিং, চুল কালার, নাক-কান ফোঁড়ানো, মেহেদী, গায়ে হলুদসহ নানা বিষয়ে দক্ষ তিনি।
শখের বসেই সঞ্চিতা সাজসজ্জার প্রতি আগ্রহী হন। ২০১০ সালের দিকে ফেনীর একটি পার্লারে মেক-আপের কাজের সাথে যুক্ত হন। দীর্ঘ ২ বছর প্র্যাকটিক্যাললি সহকারি আর্টিষ্ট হিসেবে কাজ করেন। পাশাপাশি বিভিন্ন ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করেন। ফলো করেন দক্ষ বিউটিশিয়ারদের কাজসমূহ, ক্লাইন্টদের চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ শেখার চেষ্টা করতে থাকেন। এভাবে করে কাজ করতে গিয়ে নিজের অজান্তে মেক-আপের প্রতি তার ভালোলাগা-ভালোবাসা তৈরি হয়ে যায়। তাই আর বসে না থেকে কোমর বেঁধে নেমে পড়েন।
এরপর ২০১৩ সালের দিকে ছাগলনাইয়াতে স্থানীয় একটি পার্লারে প্রধান আর্টিষ্ট হিসেবে কাজ করেন। দীর্ঘ ৭বছর কাজ করার পর ২০১৯ সালের শুরুতে ছাগলনাইয়া কলেজ রোড় এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন ’সেঁজুতি বিউটি ওয়ার্ল্ড পার্লার’ নামে নিজস্ব একটি প্রতিষ্ঠান। যদিও তার কাছে প্রতিষ্ঠান দেয়াটা যতটানা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো তারচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো সঠিকভাবে এ কাজে কতটুকু দক্ষ হতে পেরেছেন। একটা প্রতিষ্ঠান দেওয়ার আগে তার জন্য যথাযথভাবে ওই কাজের দক্ষতা অর্জনের গুরুত্ব উপলদ্ধি করে প্রতিষ্ঠান দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন সঞ্চিতা।
মেক-আপ আর্টিষ্ট ও সফল নারী উদ্যোক্তা সঞ্চিতার শুরুর গল্পটা ছিলো এমনই। বর্তমানে তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত ও সফল নারী উদ্যোক্তা। নানা প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন দ্রুত। তার এই এগিয়ে চলার পেছনে ছিলো একান্ত মনোযোগ, কাজের প্রতি একনিষ্ঠতা, সীমাহিন পরিশ্রম ও প্রচন্ড জানার আগ্রহ। অভিভাবক হিসেবে পেছন থেকে ছিলেন তার বাবা, স্বামী। তারা তাকে সাহস যুগিয়েছেন। রয়েছেন এগিয়ে চলার সঙ্গী হিসেবে। আর ছিল ক্লাইন্টদের আস্থা-ভালোবাসা ও নির্ভরযোগ্যতা।
তিনি জানান, পার্লারের কাজগুলো বর্তমানে বহির্বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ ও এই কাজটার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রামের পাশাপাশি আমাদের জেলা- উপজেলা শহরগুলোতেও এর ব্যতিক্রম নয়। তিনি জানান, ক্লাইন্টদের চাহিদার মধ্যে বেশি হল- হেয়ার স্টাইল। যেমন রিবোনডিং এটা সবার খুব পছন্দ, ভ্রু প্লাগটা একটা কমন বিষয় হয়ে গেছে, এর সাথে বিভিন্ন প্রোগ্রামে সাজসজ্জাতো রয়েছেই। এখন ফাউন্ডেশান বেইজ মেক-আপ খুব চলছে।
সঞ্চিতা তার পার্লারে যেসব কাজ করেন তার মধ্যে- ফেসিয়াল, ব্রু প্লাগ, চুল কাটিং, চুল কালার, রিবন্ডিং, নাক-কান ফোঁড়ানো, মেহেদী, গায়ে হলুদ, বউ সাজসহ আরো অনেক কিছু। তার প্রতিষ্ঠানে দুজন সহকারি আর্টিষ্ট কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি তিনি অনলাইনে নারীদের শাড়ী, কাপড়সহ সাজসজ্জার আইটেমসমূহ বিক্রি করেন।
সাফল্যের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি নিজে সফল হতে পেরেছি কিনা জানিনা। তবে যা কিছু করেছি এর জন্য আমার ভেতরে ছিলো জাগ্রত স্বপ্ন। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার তীব্র বাসনা। পার্লারের কাজটাকে একটা সময়ে সমাজে ভালো চোখে দেখা হতো না, এখন আর সে অবস্থানে নেই। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে। মানুষ এটাকে পজেটিভলি দেখছে।
নারীদের কাজ করতে গিয়ে সামাজিক কিছু বাঁধা-বিপত্তি থাকাটা স্বাভাবিক। সেগুলো দৃঢ় মনোবল ও সাহসের সাথে মোকাবেল করেছেন তিনি। তার মতে, একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হলে আপনাকে অবশ্যই ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে মাঠে নেমে পড়তে হবে। প্রতিবন্ধকতা থাকবেই, তবে ইচ্ছা থাকলে তা ওভারকাম করা সম্ভব। যত কঠিন লড়াই হোক নিজের মনোবল বাড়িয়ে সাহসী হতে হবে এবং সবার সাথে পেশাগত সু-সম্পর্ক বজায় রাখতে পারলে সব সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব।
নি:সংকোচে আগ্রহ নিয়ে কাজ করে যেতে হবে। বহির্বিশ্বের ছেলে মেয়ে সবাই সমান তালে কাজ করে যাচ্ছে, সাজসজ্জা নিয়ে এ প্রজন্মের অনেক তরুণীদের আগ্রহ রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মেয়েদের মধ্যে যারা এ পেশায় আসতে চান আমি তাদের স্বাগত জানাতে চাই। কিন্তু তার আগে কাজটা সঠিকভা তাহলে আমাদের বাংলাদেশের মেয়েরা কেন পিছিয়ে থাকবে? তাই আমি মনে করি- নিজেকে নারী হিসেবে না ভাবে মানুষ হিসেবে ভাবতে হবে। মানুষের পরিষয় মানুষই। এই পরিচয়ে সে এগিয়ে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে- প্রত্যেকটা মেয়ের কিছু না কিছু করার প্রয়োজন রয়েছে নিজের জন্য, দেশের জন্য, মানুষের জন্য।
মেক-আপ নিয়ে সঞ্চিতার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা অনেক দুর। নিজেকে আরো দক্ষ ও প্রতিষ্ঠিত করতে চান। টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক-ইউটিউব থেকে প্রতিনিয়ত শিখছেন। চেষ্টা করে যাচ্ছেন নিজেকে কিভাবে আরো দক্ষ করে তোলা যায়। পাশাপাশি সমাজের অবহেলিত মেয়েদের জন্য স্বাধ্যমতো কাজ করতে চান তিনি। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও নিজ শহর ফেনীতে এ পর্যন্ত তিনি মেক-আপের উপর অনেকগুলো প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন। দক্ষ করে তুলছেন নিজেকে। প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে স্বীকৃতিস্বরুপ পেয়েছেন সার্টিফিকেট। সর্বশেষ এ বছরের অক্টোবরে মেক-আপের উপর তিনি মিরপুরে ৫দিন্যবাপি একটি প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন। এ বিষয়ে তিনি জানান, প্রশিক্ষণের কোন বিকল্প নেই। এর মধ্য দিয়ে কাজের নতুন নতুন আইডিয়া তৈরি হয়। সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়। নিজেকে সামনে এগিয়ে নিতে হলে কাজের পাশাপাশি ভালো প্রশিক্ষণ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
সঞ্চিতা ১৯৯১ সালে ২৫ ডিসেম্বর ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার বাঞ্চারামপুর গ্রামে এক সম্ভান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ২০০৭ সালে বাঞ্চারামপুর থানার উজানচর কে এন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন। তার বাবা নিমাই রায় পেশায় একজন ব্যবসায়ী, মা লক্ষী রায় (প্রয়াত)। তিন বোনের মধ্যে সে সবার বড়। ২০০৮ সালে ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার বণিক পাড়া গ্রামের রাজিব বণিকের সাথে তার বিবাহ হয়। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই কন্যা সন্তানের মা।
একজন বিউটিশিয়ান এবং নারী উদ্যোক্তার পাশাপাশি অবসরে লেখালেখির চেষ্টা করেন। সাম্প্রতিককালে সাজসজ্জার উপর স্থানীয় কয়েকটি পত্রিকায় লেখালেখি করতে গেছে। তার শখের মধ্যে রয়েছে সঙ্গীত শোনা, বই পড়া, ফিল্ম দেখা ও ত্রমণ করা।
লেখক :
প্রতিবেদক, এখনটুয়েন্টিফোর ডটকম