শাহাদাত হোসেন তৌহিদ:
গুণীজনরা বলে থাকেন, ‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়, কখনো কখনো স্বপ্নের চেয়েও বড়।’ স্বপ্ন থাকলে কি না করা যায়? হিরণের স্বপ্ন ছিলো ব্যতিক্রম -বাঙালি জাতির অন্যতম দিশারী হাজার বছরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সারা পৃথিবীর মানুষের মাঝে তুলে ধরা। ২০১৮ সালে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত ফুটবল বিশ্বকাপে প্র্রথমবারের মতো জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি হাতে নিয়ে সারা পৃথিবীর কাছে তুলে ধরলেন তিনি। বিস্তারিত নি¤েœ পত্রস্থ হলো।
সময়টা বেশি দিন আগের কথা নয়। গেল ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের মঞ্চে দেখা গেছে বাংলাদেশের পতাকা। ২০ জুন ২০১৮ মস্কোর লুজনিকি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত পর্তুগাল এবং মরক্কোর মধ্যকার ম্যাচে গ্যালারিতে বসে নিজ দেশের পতাকা উঁচিয়ে ধরেন এক বাংলাদেশ ভক্ত। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নিয়ে গ্যালারিতে উপস্থিত হন আরেক বাংলাদেশি ফুটবলপ্রেমী। তিনি ফেনীর সোনাগাজী উপজেলা সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগ সভাপতি আজিজুল হক হিরণ। হিরনই প্রথম বাংলাদেশী যিনি বিশ্বকাপে বাঙালি জাতির জনকের ছবি সারা পৃথিবীর মানুষের মাঝে উঁচু করে ধরেছিলেন।
সেদিন ছিলো ব্রাজিল ও কোস্টারিকার মধ্যকার সর্বশেষ ম্যাচে। পেছনের স্টেডিয়ামটি রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেডিয়াম। বঙ্গবন্ধুর ছবি হাতে গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে থাকা তার গায়ে ছিল ব্রাজিলের জার্সি, মাথায় বাঁধা বাংলাদেশের পতাকা। রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেডিয়ামে বঙ্গবন্ধুর ছবি হাতে এভাবেই ক্যামেরাবন্দি হন হিরণ। তার পাশে দাঁড়ানো এক ভক্তের গায়ে দেখা যাচ্ছিল কোস্টারিকার লাল রঙের হোম জার্সি। ম্যাচ শুরুর আগে মাঠে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন দুই দলের খেলোয়াড়রা। গ্যালারি তখনও দর্শকপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। পেছনে যাদেরকে দেখা যাচ্ছে, তাদের প্রায় প্রত্যেকেই গায়ে চাপিয়ে এসেছেন ব্রাজিলের জার্সি।
জানা যায়, আজিজুল হক হিরণ ১৯৭৪ সালের ২১ জুন উপজেলার সোনাপুর মিয়া বাড়ী (আরুমিয়া চেয়ারম্যান বাড়ি)’র এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মরহুম এজাজুল হক ও মাতার রওশন আরা বেগম। বর্তমানে হিরণ উপজেলা যুবলীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সদ্য তিনি উপজেলা ভাইস-চেয়ারম্যান ছিলেন। শৈশব থেকেই হিরণ ছিলেন খুব স্বপ¦বাজ। চাচা আওরঙ্গজেবকে দেখেই রাজনীতিতে তার আগ্রহ। ফলে ছাত্র জীবনেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৮৯ ইং সালে স্থানীয় সোনাপুর হাজী এম. এস. হক উচ্চ বিদ্যালয় শাখার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেন, এরপর ৮৯ সালে আমিরাবাদ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সদস্য নির্বাচিত হন। পড়াশোনার কারণে তাকে চট্টগ্রামে থাকতে হয়। ফলে চট্টগ্রাম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।এরপর ২০০০ সালে বঙ্গবন্ধু ‘ল’ টেম্পল চট্টগ্রাম ছাত্রলীগের শাখার সিনিয়র সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে ২০০৩ সালে সোনাগাজী উপজেলা ছাত্রলীগের আহবায়ক নির্বাচিত হন। এরপর ২০১২ সালে উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম-আহবায়ক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন।
সামাজিকভাবেও হিরণ অনেকগুলো দায়িত্ব পালন করেন। সুনাম ও নিষ্ঠার সাথে বর্তমানে তিনি সোনাপুর ১নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটিতে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন, সোনাপুর হাজী এম. এস. উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। এ ছাড়াও সোনাপুর এজাজিয়া ফোরকানিয়া মাদরাসার ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হিসেবে কাজ করছেন।
বিদ্যোৎসাহী হিসেবে রয়েছে তার বেশ সুনাম। ২ বছর আগে সোনাগাজী সাবের পাইলট মডেল হাইস্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির বিদ্যোৎসাহী নির্বাচিত হন, পরবর্তীতে মঙ্গলকান্দি বহুমুখি উচ্চবিদ্যালয় স্কুল ব্যবস্থাপনায় বিদ্যোৎসাহী নির্বাচিত হন। এ ছাড়াও অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের দাতা সদস্য হিসেবে রয়েছেন, তার মধ্যে মঙ্গলকান্দি বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় স্কুল, উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন শাহাপুর আবু হুরায়রা ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসার ব্যবস্থাপনা কমিটিতে।
অবদানের স্বীকৃতি:
কাজের স্বীকৃতিস্বরুপ ২০১৪ সালে সোনাগাজী উপজেলার শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয় সভাপতি নির্বাচিত হোন। দুইবার শ্রেষ্ঠ বিদ্যোৎসাহী নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে সোনাগাজী উপজেলার শ্রেষ্ঠ বিদ্যোৎসাহী সদস্য নির্বাচিত হোন। এর পরপরই ফেনী জেলার শ্রেষ্ঠ বিদ্যোৎসাহী সদস্য হন।
পারিবারিভাবেই হিরণ আওয়ামী পরিবারের রাজনীতির সাথে জড়িত। তার চাচা মরহুম আওরঙ্গজেব (আরু মিয়া) যিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ও আমিরাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যানও। হিরণ ফেনী ২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীর ফুফাতো ভাই। এ ছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি মেয়র মরহুম আনিসুল হক এবং সাবেক সেনা প্রধান জেনারেল আবু বেলাল সফিউল হক এর ফুফাতো ভাই।
শিক্ষাগত যোগ্যতা:
১৯৯০ সালে সোনাপুর হাজী এম এস হক উচ্চ বিদ্যালয়ে থেকে এসএসসি পাশ করেন। চট্টগ্রামে ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ চট্টগ্রাম ১৯৯২ সালে এইচ.এস.সি পাশ করেন। একই বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৫ সালে ¯œাতক সম্পন্ন করেন। এরপর ১৯৯৬-৯৭ সালে চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু ‘ল’ টেম্পল কলেজ থেকে এল.এল.বি- (প্রথম পর্ব) শেষ করেন।
উল্লেখ্য যে, ফেনীর অন্য যে কোনো উপজেলার চেয়ে সোনাগাজী উপজেলা বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ। সোনাগাজীতে দেশের সবচেয়ে বড় বঙ্গবন্ধু ইন্ড্রাষ্ট্রিয়াল পার্ক অর্থনৈতিক অঞ্চল, বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বড় বড় প্রজেক্ট হচ্ছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। এমন একটি উপজেলায় গত কয়েক বছরে তিনি তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে তা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। বয়সে তরুণ, শিক্ষা-দীক্ষা রাজনৈতিক শিষ্টাচার, দূরদর্শিতা, প্রজ্ঞা সর্বদিক দিয়ে হিরণই সোনাগাজীর রাজনীতিতে আলোচিত মুখ বলে মনে করেন সোনাগাজী থানা আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক আনোয়ার হোসেন।
তিনি বলেন, হিরণের পরিবার সোনাগাজীর সুপরিচিত আওয়ামী পরিবার। সোনাগাজীতে আওয়ামী রাজনীতির জন্য হিরণ ও তাঁর পরিবারের শ্রম সবচেয়ে বেশী, ছাত্র জীবন থেকে অদ্যাবধি দলের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। তিনি ফেনী ২ আসনের সাংসদ নিজাম উদ্দিন হাজারীর নেতৃত্বে উপজেলা যুবলীগকে সুসংগঠিত করেছেন ও দলের সবাইকে নিয়ে একতাবদ্ধভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। জনপ্রতিনিধি হয়ে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও দল ও জনগণের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। উপজেলা উন্নয়নে সর্বক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন। মাঠের পাশাপাশি হিরণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বেশ পরিচিত। তার রয়েছে অনেক সমর্থক, শুভাকাঙ্খী ও ভক্ত।
হিরণের বর্ণনা:
হিরণ জানালেন, ফেনী ফুটবল ফেডারেশনের সদস্য হিসেবে রাশিয়াতে ফুটবল বিশ্বকাপে যাওয়ার সুযোগ হয় আমার। বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার আগের দিন রাত সাড়ে ১২ টায় আমার ফ্লাইট ছিলো। ঠিক সাড়ে ১০টায় ঢাকার বিখ্যাত আজাদ প্রোডাক্টস থেকে জাতির জনকের ছবিটি সংগ্রহ করি। সাথে তিনটি জাতীয় পতাকা। সেদিন ছিলো কোস্টারিকা বনাম ব্রাজিলের খেলা। ব্রাজিলের সমর্থক হিসেবে মূলত আমি ব্রাজিলের খেলা দেখতে গিয়েছিলাম।
কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে যখন স্টেডিয়ামে প্রবেশ করি আমার হাতে ছিলো জাতির জনকের ছবি আর তিনটি জাতীয় পতাকা। হাতে বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখে প্রবেশমুখে একজন সিকিউরিটি বললো, এটা কার ছবি? আমার সাথে আমার দু’জন বাঙালি ভাই ছিলো। প্রথমে এই ছবি দেখে আমাকে ঢুকতে দেয়া হয় নাই, আমাকে একটা সিকিউরিটি রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। তারা আমাকে জিজ্ঞাস করলো এই ছবিটি কার? আমি বললাম, এটি আমাদের জাতির পিতার, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা। যিনি বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের প্রবর্তন করেছিলেন। তখন ওখানকার একজন ব্যক্তিকে বলা হলো ছবিটি তুলে ধরতে, আমি বললাম না, আমার পিতার ছবিটি আমিই ধরি, এ অবস্থায় আমাকে ১৫-২০মিনিটের মতো ছবিটি ধরে রাখতে হয়েছিলো। কিছুক্ষণ পর তাদের কাছ থেকে সিগনাল আসলো যে, হ্যাঁ, এটা বাঙালি জাতির জনকের ছবি। ক্লিয়ারেন্স দেয়ার সাথে আমাকে ঢুকতে দেয়া হলো। তখন জাপান থেকে আসা একটা লোকের সাথে আমার দেখা হয়, যে বিশ্বকাপের মাঠে কে কোন দিক দিয়ে ঢুকবো এ দায়িত্বটা পেয়েছিলো।সে আমাকে দেখে বললো, ভাই আপনিই নিজেকে তৈরি করে এসেছেন। এ কথা শুনে আমার মনটা ভরে গেলো। পরে আমার হাতে যে তিনটি জাতীয় পতাকা ছিলো তিনটা আমি স্টেডিয়ামে লাগিয়ে দিয়ে আসছি। ব্রাজিলের অনেকেই আমার কাছে জানতে চেয়েছিলো ছবিটি কার? মাথায় জাতীয় পতাকা, গায়ে ব্রাজিলের জার্সি, হাতে জাতির জনকের ছবি। আমি সবাইকে উত্তর দিয়েছি, আমাদের বাঙালি জাতির জনকের। অনেকে এ অবস্থা দেখে আমার সাথে ছবি তুলেছে।
বিশ্বকাপের মাঠে জাতির জনকের ছবি আর কেউ কখনোই তোলেননি। অফিসিয়ালভাবে জাতির জনককে সবাই চিনে কিন্তু আন-অফিসিয়াললি সাধারণ জনগন সবাই চিনে না। সে কারণেই আমি রাশিয়ার সর্বসাধারণসহ আগত সকলের মাঝে জাতির জনকের ছবিটি তুলে ধরি।
আরেকটি কথা বলে রাখি যে, সারা পৃথিবীর মধ্যে আমরাই একমাত্র জাতি, যারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে। যেখানে অন্যান্য দেশে তেল, গ্যাস, ক্ষমতার জন্য জীবন দেয় সেখানে আমরা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছি এর চেয়ে বড় গৌরবের বিষয় আর কি হতে পারে?
বঙ্গবন্ধু কেবল আওয়ামী লীগের নয়, পুরো দেশের একটি সম্পদ, ৭ই মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন তিনি। সে ডাকে উদ্ধুদ্ব হয়ে সবাই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। সুতরাং তাঁকে আমাদের জাতির গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে মনে করি।
সম্পাদনা: এসবি/এসএইচটি