হক সাহেবের দেশে

1213

মাহমুদ হাসান খান।।

শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নাম শোনেননি, এমন মানুষের দেখা পাওয়া ভার। একাধারে আইনজীবী, দানবীর, সুবক্তা হিসেবে তিনি পাক-ভারত উপমহাদেশে সুপরিচিত ছিলেন। বাংলার বাঘ হিসেবে খ্যাত অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হকের দেশ, ধান-নদী-খালের দেশ বরিশাল ঘুরে আসতে পারেন দু-একটা দিন সময় পেলে।

বরিশালকে এখানকার অধিবাসীরা আদর করে ডাকেন ‘বইরশাল’। বরিশালের রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস। এর প্রাচীন নাম চন্দ্রদ্বীপ। প্রায় চার হাজার বছর আগে ইন্দোচীন থেকে ‘বাঙ’ নামের এক জাতি এ চন্দ্রদ্বীপ এ বসতি স্থাপন করে। বাঙ শব্দের অর্থ জলাভূমি। ‘বাঙ’ নামের এ জাতি তাদের ক্ষেতে আল দিয়ে চাষ করত বলে এ এলাকাকে বাঙালাবাদ বলা হত।

এই বাঙালাবাদ থেকেই বাঙালি শব্দটি এসেছে বলে মনে করা হয়। পাল ও সেন আমলেও বঙ্গ বলতে এই দক্ষিণ বঙ্গকেই বোঝাত। ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, দক্ষিণবঙ্গের বাঙালা থেকেই আজকের বাংলার নামকরণ হয়েছে। আর বরিশাল নামটি এসেছে ব্যারিসল্ট থেকে। সপ্তদশ শতকে এখানকার বন্দরে ইউরোপীয় বণিকরা লবণ বাণিজ্য করতে আসত। নদীতে ব্যারিকেড দিয়ে সল্টের শুল্ক আদায় করা হতো বলে নামকরণ করা হয়ে ব্যারিসল্ট, কালক্রমে যা হয় বরিশাল।

কী দেখবেন : শহর বরিশালে রয়েছে অনেক কিছু্ দেখার।

স্টিমার ঘাট

কীর্তনখোলা নদীর তীরেই স্টিমার ঘাটের অবস্থান। বেশ বড় একটি জেটি প্রায় সময় খালি থাকে। তবে খুব সকাল আর সন্ধ্যায় স্টিমার ঘাটে ভিড়লে এর ব্যস্ততা বেড়ে যায়। ভেবে রোমাঞ্চিত হবেন যে প্রায় ৭০-৮০ বছর আগে ইংল্যান্ডের রিভার অ্যান্ড স্টিম নেভিগেশন (আরএসএন) কোম্পানির বিশাল বিশাল সব স্টিমার চলাচল করত এ ঘাট দিয়ে। বাহারি নাম ছিল সে সবের—ফ্লেমিংগো, ফ্লোরিকান, বেলুচি ইত্যাদি। বরিশাল থেকে ঢাকা, খুলনা, কলকাতা যেতে স্টিমারই ছিল ভরসা।

বলা হয়ে থাকে, ব্রিটিশ সরকার নাকি বরিশালে রেলপথ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছিল; কিন্তু স্টিমার কোম্পানির মালিকরা ব্যবসা হারানোর ভয়ে লন্ডনে বসে সে উদ্যোগের দফারফা করে দেয়। বর্তমানে নতুন-পুরোনো মিলিয়ে সপ্তাহে ছয় দিন স্টিমার চলাচল করে।

অশ্বিনী কুমার টাউন হল

শহরের ঠিক কেন্দ্রস্থলে রয়েছে অশ্বিনী কুমার টাউন হল। একদা দক্ষিণাঞ্চলের সাংষ্কৃতির সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত এ টাউন হলটিরও রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস। ১৯০৬ সালে রাজা সাহেবের মহলে ব্রিটিশবিরোধী মিছিলে পুলিশ হামলা চালায়। সে সময় এ ঘটনার প্রতিবাদ করার জন্য বরিশালবাসী একটি স্থানের প্রয়োজনীয় অনুভব করে।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯২০ সালে মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের সভাপতিত্বে বরিশালে একটি টাউন হল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং একটি কমিটি গঠিত হয়। ১৯২১ সালে এর কাজ শুরু হয় এবং শেষ হয় ১৯৩০ সালে। মাঝে ১৯২৩ সালে অশ্বিনী কুমারের মৃত্যু হলে এর নামকরণ করা হয় অশ্বিনী কুমার টাউন হল। এটি নির্মাণে খরচ হয় ৪০ হাজার রুপি। আর এ অর্থ সংগ্রহ হয় খেলাফত আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলনের সময় গৃহীত ফান্ড থেকে।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই টাউন হলটিতে বরিশালের নানা সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠান হয়ে আসছে। বরিশালের আরেক সুসন্তান বিপ্লবী সতীন্দ্রনাথ সেন এই হলের একটি রুমে থাকতেন।

বিএম কলেজ

প্রায় ১২৬ বিঘা জমির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বিএম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ একটি দর্শনীয় স্থান। কলেজটির রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। বরিশালের ম্যাজিস্ট্রেট রমেশ চন্দ্র দত্তের অনুপ্রেরণায় মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত ১৮৮৪ সালে তাঁর বাবার নামে ব্রজমোহন ইনস্টিটিউট স্কুল (বিএম ইনস্টিটিউট) প্রতিষ্ঠা করেন।

১৮৯৮ সালে এটি কলেজে উন্নীত হয়। তখন থেকেই এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি সুনামের সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলে শিক্ষা বিস্তার করে আসছে। সে সময় প্রবেশিকা পরীক্ষায় সারা ভারতে শতকরা ২২ ভাগের বেশি পাস করেনি; কিন্তু বিএম ইনস্টিটিউট থেকে শতকরা ৮২ ভাগ ছাত্র পাস করলে সারা ভারতে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সে সময় প্রফেসর ক্যানিংহাম বিএম কলেজ পরিদর্শন করে রিপোর্ট দেন : ‘বিএম কলেজের মতো উৎকৃষ্ট কলেজ থাকিতে বাঙালি ছেলেরা বিদ্যা শিক্ষার জন্য কেন অক্সফোর্ড যায়, আমি বুঝিতে পারি না।”

বহু গুণী লোকের পদভারে মুখরিত ছিল এ কলেজ। কবি জীবনানন্দ দাশ এ কলেজ থেকে ১৯১৭ সালে আইএ পাস করেন।

বিবির পুকুর

বরিশাল শহরের প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে দারুণ সুন্দর একটি পুকুর, যা বিবির পুকুর নামে পরিচিত। এটিও দেখতে ভুলবেন না। সন্ধ্যার দিকে আলো ঝলমলে পুকুরটির পাড়ে বসে আড্ডা আর খাবারের নানান সমারোহ। আসুন দেখি, এ পুকুরটি কী করে হলো।

বাংলা মুদ্রণ সাহিত্যের জনক বলে পরিচিত উইলিয়াম কেরি ১৮০০ শতকে কিছুদিন বরিশাল ছিলেন। সে সময় তিনি পর্তুগিজ জলদস্যুদের কাছ থেকে জিন্নাত বিবি নামে এক মহিলাকে উদ্ধার করেন। কিন্তু সে সময় সেখানকার সমাজ মেয়েটিকে আশ্রয় দিতে না চাইলে কেরি নিজেই তাঁকে আশ্রয় দেন এবং জিন্নাত বিবির নামে একটি তালুক কেনেন। জিন্নাত বিবি সে তালুক নিজে ভোগ না করে জনসাধারণের জন্য একটি পুকুর খনন করান, যা ওই এলাকার জলকষ্ট দূর করত। এটিই পরে বিবির পুকুর নামে পরিচিতি পায়। পুকুরপাড়ে এ কেরি সাহেব একটি গির্জাও তৈরি করেন, যা বরিশাল এলাকার প্রথম গির্জা। এটি তৈরির কারণে এলাকাটির নামই হয়ে যায় গির্জা মহল্লা।

বেলস পার্ক

নির্মল বাতাস খেতে যেতে পারেন বেলস পার্ক। গত শতকের গোড়ার দিকে বরিশারের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন নিকোলাস বিটসন বেলস। তিনি ছিলেন ভারত দরদি ইংরেজ। বরিশালের জন্য তাঁর ভালোবাসার অন্ত ছিল না। বহু জনকল্যাণমুখী কাজ করে গেছেন তিনি। এই নিকোলাস বেলস ১৯০৯ সালে বরিশালে তরুণদের খেলাধুলার জন্য একটি পার্ক তৈরি করেন, পরে যার নামকরণ করা হয় বেলস পার্ক।

চারণ কবি মুকুন্দ দাসের বাড়ি

ব্রিটিশ সরকার এবং বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী চারণ কবি মুকুন্দ দাসের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনকাল কেটেছে বরিশালে। গত শতাব্দীর প্রথমদিকে তিনি একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন নাম দেন বান্দময়ী মন্দির। নথুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ডেরর পাশেই এ মন্দিরে নেতাজি সুভাস বসু, দেশবন্দু চিত্তরঞ্জন দাস, মহাত্মা গান্ধীসহ অনেক বিখ্যাত মানুষজন গেছেন। আপনিও ঘুরে আসুন।

ওপরের এগুলো ছাড়াও দেখতে পারেন

মাধবপাশা দুর্গাসাগর দীঘি

শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে এই ২৫০০ হেক্টর আয়তন এর এ দীঘিটি ১৭৮০ সালে খনন করান মাধবপাশা রাজ্যর রাজা জয়নারায়ণ। দীঘিটির চারপাশ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এবং মাঝে রয়েছে একটি দ্বীপ। একটি বিকেল কাটানোর জন্য দারুণ সুন্দর একটি স্থান এটি।

গুঠিয়া বায়তুল আমান মসজিদ

বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর মসজিটি অবস্থিত বরিশাল থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরের গুঠিয়ায়। দুর্গাসাগর থেকে ১০ মিনিট লাগবে যেতে।

চাখার শেরেবাংলার বাড়ি

বরিশাল শহর থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার যদিও বাড়িঘর নেই, তবে তাঁর স্মৃতির একটি জাদুঘর আছে এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত কলেজ ও স্কুল রয়েছে বেশ কটি।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় :

আধুনিক স্থাপত্যকলায় নির্মিত। শহর থেকে ৪-৫ কিলোমিটার দূরে।

যেভাবে যাবেন

বরিশাল যাওয়ার আছে নানা উপায়। প্রতিদিন রাত ৮টা ৩০ মিনিটে ঢাকার সদরঘাট থেকে তিন-চারটি বিশাল যাত্রীবাহী লঞ্চ ছেড়ে যায় বরিশালের উদ্দেশে। পরদিন সকালে বরিশাল পৌঁছে। কেবিন ভাড়া : ৯০০ টাকা (সিঙ্গেল), ১৭০০ টাকা (ডাবল), ডেক ভাড়া-২০০ টাকা। কেবিন পেতে হলে সদরঘাট গিয়ে আগে বুকিং দিতে হবে।

এ ছাড়া ঢাকার গাবতলী থেকে সাকুরা হানিফসহ নানান বাস ছেড়ে যায়। সময় লাগে ছয় ঘণ্টা। ভাড়া ৫০০ টাকা।

কীভাবে ঘুরবেন

সারা দিনের জন্য একটি অটো ভাড়া নিয়ে নিন। ১৫০০ টাকা নেবে। পাঁচ-ছয়জন বসতে পারবেন। তা ছাড়া এসব জায়গাতেই রিকশা/বাস বা শেয়ার অটোতে করে যাওয়া যায়।

কোথায় থাকবেন

বরিশাল রয়েছে থাকার নানান মানে ব্যবস্থা। তিন তারকা মানের হোটেল গ্রান্ড পার্কের ভাড়া শুরু ৩৫০০ টাকা থেকে। সাশ্রয়ী ভাড়ায় থাকতে পাবেন হোটেল কাঠপট্টির এথেনাতে। এখানে ৫০০ টাকায় রুম পাবেন। এ ছাড়া হোটেল আলী ও একই ভাড়ার ভালো মানের হোটেল।

এখন/এসএস