সাংস্কৃতিক নীতিমালা তৈরি হয়নি স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও

1269

এখন রিপোর্ট।।

বাঙালিসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ। সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম, অতঃপর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের মতো স্বাধীন বাংলাদেশেও জাতি গঠনে সাংস্কৃতিক মুক্তি উপলব্ধি করা হয়। অথচ স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও একটি সাংস্কৃতিক নীতিমালা তৈরি হয়নি।

১৯৮২ সালে মেক্সিকো সিটিতে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক কনভেনশনে প্রতিটি রাষ্ট্রকে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির বিষয়গুলো চিহ্নিত করে নীতিমালা তৈরির তাগিদ দেওয়া হয়। এই নীতিমালার উপযোগিতা সম্পর্কে বলা হয়েছিল, সংস্কৃতি হচ্ছে একটি জাতির আত্মিক, বস্তুগত, বৃদ্ধিগত, আবেগগত, চিন্তা ও কর্মধারার প্রকাশ। একমাত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের দ্বারাই একটি দেশ ও জাতি তার স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে পারবে।

এটি কার্যকর করতে জাতিসংঘ ২১ মে ‘বিশ্ব সংস্কৃতি দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। এটির উপযোগিতা অনুভব করে বাংলাদেশেও। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে নয়, দেশের রাষ্ট্রচিন্তকদের উদ্যোগে। স্বাধীনতার প্রায় ১ যুগ পরে ১৯৮৮ সালে জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানকে চেয়ারম্যান এবং ড. আলাউদ্দিন আল আজাদকে সদস্য সচিব করে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট ‘জাতীয় সংস্কৃতি কমিশন’ গঠন করা হয়। এই কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন, অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, বেগম লায়লা আরজুমান্দ বানু, এম কে আলম চৌধুরী, ড. আশরাফ সিদ্দিকী, ড. আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দীন, সাঈদ আহমদ, ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ড. এনামুল হক, মুস্তাফা মনোয়ার, আবদুর রাজ্জাক ও ড. মাহমুদ শাহ কোরেশী।
তারা আন্তরিকভাবে কাজ করে সরকারের কাছে রিপোর্ট পেশ করলেও তৎকালীন সরকার তা আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করেনি।
পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালের সরকার অর্থাৎ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এটি নিয়ে আবার আলোচনা হয়।

তৎকালীন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী এবং বর্তমান সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘সাংস্কৃতিক নীতিমালা করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমি উদ্যোগ গ্রহণ করি; কিন্তু সেটা আর বাস্তবায়ন হয়নি―যা দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত।’

এরপর বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময় কিছুটা আলোচনা হলেও শেষ পর্যন্ত এটির কাজ হয়নি। জাতীয় সাংস্কৃতিক নীতিমালা প্রণয়নের লক্ষ্যে গঠিত পর্যালোচনা ও বাস্তবায়ন সুপারিশ প্রণয়ন কমিটি ২০০৪ সালে তৎকালীন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী বেগম সেলিমা রহমানের কাছে কমিটির সিদ্ধান্ত ও সুপারিশমালা পেশ করে। তিনি প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন কিন্তু তা আর আলোর মুখ দেখেনি।

বর্তমান সরকার এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নিয়েছে কি না জানতে চাইলে দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘আমি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নই। আমাদের দেশে বিগত দিনে এটা নিয়ে কেউ কথা বলেছেন কি না তাও জানা নেই। তবে, আমার মনে হয় আমাদের দেশের সংবিধানে যেভাবে এ দেশের সংস্কৃতি সংরক্ষণের কথা বলা আছে, তাতে আলাদা কোনো নীতিমালার প্রয়োজন নেই। তারপরও বিষয়টি আমি ভেবে দেখব। সংস্কৃতির জন্য কল্যাণকর হলে আমরা অবশ্যই এ কাজ করব।’

একটি দেশে সাংস্কৃতিক নীতিমালার উপযোগিতা আছে কি না এ বিষয় সম্পর্কে কয়েকজন বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কথা বললে তারা এটির গুরুত্ব তুলে ধরেন।

সংস্কৃতিমন্ত্রীর বক্তব্যের আংশিক দ্বিমত পোষণ করে সাংস্কৃতিক নীতিমালার গুরুত্বের কথা তুলে ধরেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। তিনি বলেন, ‘সংবিধানে তো সবই বলা আছে। তবে এর ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন। সাংস্কৃতিক খাতে কী কী পড়বে কী পড়বে না। সাংস্কৃতিক বিকাশে কোন কোন খাতে বাজেট বরাদ্দ হবে কিংবা হবে না এর তো একটা নীতি থাকা চাই। ভিনদেশি সংস্কৃতির কতটুকু গ্রহণ করব কতটুকু করব না, তা এ নীতির আওতাভুক্ত হতে পারে। আর এতে করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কাজ করার একটা বৃহৎ বলয় পাবে। জাতির মেধা বিকাশে এ খাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বাড়বে।’
ইমিরেটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন, ‘সাংস্কৃতিক নীতিমালা নয়, আমি বলব সাংস্কৃতিক নীতির প্রয়োজন আছে। মেধা বিকাশ ও সুন্দর মানসিকতার জন্য যদি শিক্ষানীতি থাকে তবে সাংস্কৃতিক নীতি কেন নয়।’

বিশিষ্ট লোকগবেষক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান বলেন, ‘এটা বিগত সময়ে অনেকে উদ্যোগ নিয়েছেন। কিছু নীতিমালা হয়েছেও। জাতীয় গ্রন্থনীতি হয়েছে। কিন্তু সামগ্রিক অর্থে সাংস্কৃতিক নীতিমালা নেই। আমি মনে করি এটা হওয়া দরকার।’

এখন/এসএস