সক্রেটিসকে এখনো জবাব দিতে পারিনি —লুৎফর হাসান

2774
লুৎফর হাসান

শুধু গানই নয়; তিনি কবিতা, গল্প, উপন্যাসও লিখেন। সুরও করে থাকেন। তবে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন নিজের কণ্ঠে গাইতে। নিজেকে বিরহী বাউল হিসেবেই পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। এরকমই একজনের সঙ্গে আজ দীর্ঘ আলাপ হবে, যিনি ঘুড়ির ওড়াউড়িকে সুরে বেঁধেছেন, প্রেমের প্রবল আকাঙ্ক্ষাকে বিরহে প্রতিস্থাপন করে। ‘ঘুড়ি তুমি কার আকাশে ওড়ো’ গানের শিল্পী লুৎফর হাসানের সাথে ‌‘এখন’-এর পক্ষ থেকে কথা বলেছেন জান্নাতুল ফেরদৌসী সনি।

এখন : কেমন আছেন?
লুৎফর হাসান : ভালো, তুমি কেমন আছো?

ভালো, আমি আপনার পাঠক ও শ্রোতা, এসব নিয়ে কথা বলতে এসেছি আপনার সাথে। তাই একটু বেশিই ভালো আছি।
আরে কী বলো, এতো বড় মানুষ আমি এখনো হয়েছি নাকি? হওয়ার চেষ্টায় আছি।

হ্যা, তবুও তো নিজেকে অহংকারী বলতে ভালো লাগে আপনার, আপনি যেমন বলেন…
হ্যা, এটা ঠিক বলেছ, আমি খুব অহংকারী আর সেটা কিসের অহংকার জানো? সততার অহংকার। আমি যা করি আমি তা বলতে পারি, আমার বলার সাহস আছে, সমাজ সংসারকে যে আমি অমান্য করে চলি তাও না, কিন্তু আমি যা করি তা আমি স্বীকার করার সাহসটা রাখি। আমার জীবনে লুকানো কোন বিষয় নেই। অনেক কিছু লুকানো দরকার ছিলো তবুও লুকাইনি বলে আমার পরিবার আমার গুরুজনেরা মাঝে মাঝে যে আমার কাছ থেকে কষ্ট পান না এমন না, পান। আমি তবুও নিজেকে লুকিয়ে চলি না। কারণ এটাই আমার সবচেয়ে বড় অহংকার।

প্রেম?
প্রেম কী?

আপনি আপনার ফেসবুকের বায়োতে লিখেছেন আপনি বিরহী বাউল, বিরহের সাথে অবশ্যই প্রেমের খুব সম্পর্ক, সেক্ষেত্রে আপনার জীবনে অনেক প্রেমও থাকার কথা, সেসব আমরা যেহেতু জানি না এখনো, নিশ্চয়ই লুকানো আছে আপনার কাছে…
নাহ, অবশ্যই লুকানো নেই, আমার সমস্ত উপন্যাস, গল্প কবিতা সমস্ত কিছুতে আমার প্রেমেরাই ছড়িয়ে আছে।

আপনার সেইসব প্রেমেদের গল্প শুনবো তার আগে শুনতে চাই, কেনো আপনার নিজেকে বিরহী বাউল মনে হয়?
আমি আসলে প্রেমে পড়ি দুঃখ পাবার জন্য। শুরু থেকে যদি বলি, আমাদের বাংলা সাহিত্যে যারা আমাদের পূর্বতন ছিলেন যাদের কাছে আমরা শিখেছি যেমন, শরৎচন্দ্রকেই দেখো, আমাদের একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর কাছে তার যেই জনপ্রিয়তা সেটার মূল কারণ কিন্তু তার দুঃখগাথার দক্ষতা। এসব ছাড়াও আমাদের দুঃখবোধের যেই শৈল্পিক মাধ্যম- পুথি, বিচ্ছেদি গান, পালাগান এসবের মূলটা কিন্তু বিরহই। তাছাড়া আমরা ভাটির অঞ্চলের মানুষ, আমার বাড়ির পাশে বিল আছে তো বড় এক বিল, নদী ছিলো, ঝিনাই নদী, তো সবসময় নদীর কাছে, বিলের ধারে দাঁড়ালেই বাঁশির সুর ভেসে আসতো। আমি নিজেও খুব ছোটবেলা থেকেই গান গাই। কিন্তু সেই তখন থেকেই আমি কখনোই রোমান্টিক গানের প্রতি আগ্রহী ছিলাম না, সবসময় বিরহী গানই গাইতাম, শুনতাম শিখতে চাইতাম। গানে হোক কবিতায় হোক, যাকিছুই হোক আমাকে সবসময় বিরহ ছুঁয়েই যেতো না, আমার মনে হয় বিরহই আমাকে তৈরি করছে আমি হতে। কারণ আমার মনে পড়ে, যখন মানুষ প্রেম বুঝে, মানে যে বয়সে একটা মানুষ প্রেম বুঝে ওঠে সেই বয়সের আগেই আমি বিরহকে চিনে ফেলেছি।

লুৎফর হাসান

কতো বয়সে?
প্রেমিক হয়েছি আমি খুব ছোটোবেলায়, দুঃখও পেয়েছি সেই তখনই। ১৯৯১ সালে, তখন আমি প্রথম প্রেমে পড়ি। তখন আমার বাড়ির পাশ দিয়ে একজন মেয়ে স্কুল থেকে বাড়ি, বাড়ি থেকে স্কুলের জন্য হেঁটে যেতো, এই হেঁটে যাওয়া পথের পাশেই একটা হেলে যাওয়া আমগাছ ছিলো, ছেলেপেলেরা মানে আমরাই ওই গাছের উপর চড়ে গাছের ডালে শুয়ে শুয়ে মেয়েদেরকে দেখতাম। এটাই তখন মেয়েদের দেখার একটা উপায় ছিলো আমাদের, অনেকটা উৎসবের মতো। কিন্তু কেউ কিছু বলতো না কখনোই, যেটাকে এখন ইভটিজিং বলে সেটা ছিলো না। সাহসই করতো না কেউ এসবের, এক কথায় বলতে পারো অশ্লীলতা খুব কমই ছিলো, বরং মেয়েদের প্রতি একধরণের মুগ্ধতা থেকে সবাই এরকম উৎসব করে মেয়েদেরকে দেখতো। তো তখন, সকলেই সুন্দরী ফর্সা গোলগাল গালের মেয়েদেরকে দেখতো। আমিও দেখিনি যে তা নয়, কিন্তু আমি বেশি খেয়াল করতাম যে একটা কালো দেখতে মেয়ে প্রতিদিনই যাচ্ছে কিন্তু ওকে কেউ দেখছে না বা দেখার জন্য পিড়াপীড়ি নেই কারো। আমি সেই মেয়েটাকেই দেখতাম। চুপচাপ কোলাহলহীন সে হেঁটে যাচ্ছে, ওর ভেতরে বাহ্যিক যে সৌন্দর্য সেটা ছিলো না কিন্তু আমি সেই বয়সেই ওর ভেতরে যেই সৌন্দর্যটা দেখতে পেতাম এবং মুগ্ধ হতাম। ওর চুপচাপের হেঁটে যাওয়াতে যে সারল্যটা ছিলো আমি তাই দেখতাম বসে বসে। এরপর প্রেম হয়ে গেলো আমার তার প্রতি, চিঠি লিখলাম, আমার বাড়ির পাশেই ডাকঘর ছিলো, সেখানে যেয়ে চিঠি ফেলে আসতাম। এই পোস্ট অফিসটির কাছে আমি অনেক ঋণী! তো সেই চিঠি ফেলতে যেয়ে একদিন ধরা খেয়ে গেলাম আব্বার কাছে, আব্বা আমাকে বাড়ির সামনে গাছের সাথে বেঁধে রাখলেন, বাঁধলেন কখন, যখন স্কুল ছুটি হয়ে মেয়েরা বাড়ির পাশে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো তখন। সবাই আমাকে দেখলো, মেয়েরা একটু হাসলো আমাকে দেখে, যে এতোবড় একটা ছেলেকে বেঁধে রেখেছে। সেই মেয়েটিও দেখলো, এবং তারপর থেকে সে আর আমার সাথে কথা বলেনি, আগে কিছুটা বলতো। দেখা হলে ভালো আছো জিজ্ঞেস করলে বলতো- “হুম, ভালো” এইটুকুতেই আমার মনে হতো যেন অনেক কথা বলে ফেলেছি। তারপর যখন থেকে আর কথা বলছেনা আমি খুব দুঃখ পেলাম মনে।
এরপর আরো অনেক বার প্রেমে পড়েছি, আমাদের গ্রামে বাইরে থেকে এক আপু আসতেন মাঝে মাঝে বেড়াতে, মনে হতো যেন দেবী এসেছেন আমাদের গাঁয়ে। আমি তার প্রেমে পড়েছিলাম, ব্যর্থ হয়েছি।
আমার এক খালাতো বোন ছিলো ভীষণ সুন্দরী, তার প্রেমে পড়েছি এবং তাকে জানিয়েছিও। সে তখন রেগেমেগে বলেছে, নিজের চেহারা আয়নায় দেখেছো কখনো? এটা সে ভুল বলেনি আমি দেখতে খারাপ ছিলাম। তাতেও আমি খুব দুঃখ পেয়েছি। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে যেয়ে আরেকজনের প্রেমে পড়লাম, তখন আমি বেশ গান গাই, মোটামুটি চেনামুখ হয়ে উঠেছি ক্যাম্পাসে, আমার এখনকার জনপ্রিয়তার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি অনেক অনেক বেশি জনপ্রিয় ছিলাম। সেই মেয়েটিও আমার গান ভালোবাসতো আর আমি ভালোবাসতে লাগলাম তাকে, লিকলিকে একটা মেয়ে, নাম- আশা। কোমর পর্যন্ত চুল, চশমা পরতো, দেখলে মনে হতো যেন একটা আস্ত কবিতা। কিন্তু যখনই সেই কথাটি তাকে জানিয়েছি সে বললো— আপনি তো পড়েন ইসলামিক স্টাডিজে!
আমি অবাক! একটা সাবজেক্ট দিয়ে আমার প্রেম নির্দেশিত হলো! কিন্তু এই ঘটনার অনেক পড়ে আমার দুপুরের জন্মেরও কিছু পরে সেই মেয়েটির সাথে আমার ট্রেন দেখা হয়েছে, আমি চিনতে পারিনি সে নিজেই চিনে নিয়ে এসে, নেমে যাওয়ার সময় আমাকে বলেছে, “গুল্লু ভাই, আমি ভালো নেই। সম্ভবত আপনার সাথে থাকলে আমি ভালো থাকতাম”। আমাকে সবাই ক্যাম্পাসে ‘গুল্লু’ বলেই ডাকতো, তো পুরো ক্যাম্পাস লাইফে আমি শুধু ভালোই বেসে গেছি আমার কারো সাথে প্রেম হয়নি। আমার উত্তরগুলো বেশ বড় হচ্ছে, তুমি যেহেতু বেশি সময় নিয়ে কথা বলতে চেয়েছো তাই আমি বড় করেই বলছি সব।

না না, কোনো সমস্যাই নেই। আমিও সেটাই চাইছি, অনেক গল্প হোক। আপনার বিরহের কারণ বলতে বলতে কিন্তু আপনার প্রেমগুলোও এসে পড়ছে, এখনো পর্যন্ত আপনার প্রেম চর্চার গল্প আসেনি একটিও, খুব অন্যরকম কিন্তু…
হ্যা হ্যা, তুমি বলেছিলে না, বিরহের সাথে খুব বেশি সম্পর্ক তো প্রেমেরই তাই বিরহ বলতে যেয়ে প্রেমই বলছি মূলত! তো যাই হোক, প্রেম যাই এসেছে আমি কখনো কাউকে চিরতরের আমার করে পাইনি। কেউ কেউ আসেইনি, কেউ কেউ এসেছে আবার নিজেদের প্রয়োজনে চলে গেছে।

লুৎফর হাসান
দুপুর আর দুপুরের মা

দুপুরের মা?
দুপুরের মাকেও আমার খুব পছন্দ হওয়ার কারণেই বিয়ে করা। সে তখন ভীষণ সুন্দরী। দুপুরের মাকে দেখে আমার হুট করে ভালো লেগে যায় খুব। কিন্তু তাকে যখনই জানিয়েছি সেও সেই একই কথা বললো,- “নিজের চেহারা আয়নায় দেখেছেন কখনো?” এই কথা শুনে জেদ করে দুপুরের মাকে আমি তুলে নিয়ে যেয়ে বিয়ে করেছি। বিয়ের পর আমরা কিছুদিন সংসারও করেছি। কিন্তু দুপুরের মায়ের সাথে একটা ভুল বোঝাবুঝির কারণে সে বাবার বাড়ি চলে যায় পাঁচ বছরের জন্য। এই পাঁচবছরে আমি ভাবিনি সে আবার কখনো ফিরবে আমার কাছে, এই অভাবনীয় সময়ে আমার কিছু সফল প্রেম হয়, সফলও ঠিক না, ওই যে প্রেম চর্চা বললে সেটা হয়। এই সময় আমার দুটো প্রেম হয়, এই দুটি প্রেমই আমাকে পূর্ণ করে তোলে জীবন উপভোগের জন্য। আমার শিল্প সাহিত্য চর্চায় ওদের দুজনের অবদান এখনো সবচেয়ে বেশি।

আপনি লিখেছেন, “ভালোবাসতে শেখো, অজান্তে শরীর স্বর্গ চেনাবে!” আপনি কি এমনি করে ভালোবাসায় স্বর্গের দেখা পেয়েছেন? নাকি এখনো অপেক্ষায় আছেন?
হ্যা পেয়েছি। আমার জীবনে সকল প্রেমিকারাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই যে পাঁচবছরে আমার দুজন প্রেমিকা ছিলো, একজন তনু অন্যজন শাওন,  এরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভালোবাসায় বা প্রেমে আমি এখনো পূর্ণ নই, তবে ভালোবাসা যে স্বর্গীয় সেই অনুভব আমি পেয়েছি। আমি শুধু ভালোবেসে গেছি। ভালোবাসায় আমি কখনো শরীর খুঁজিনি, ভালোবেসে গেছি। যেমন, এখন যা হয় মেয়েদের সাথে প্রেম করে সেইসব স্মৃতি ভিডিও করে রাখে কেউ একটু কিছু করলেই নেটে ছেড়ে দেয়, ব্ল্যাকমেইল করে, মেয়েদের শরীর নিয়ে খেলে, অসভ্যতা করে। এইসব আগে ছিলো না খুব বেশি, তবে ছিলো। আমি কখনো এসব চিন্তাও করিনি, এমনকি আমি কারো সাথে প্রতারণাও করিনি কখনো। আমার শুধু ভালোবাসতেই ভালো লাগে। মেয়েদেরকে আমি খুব সম্মান করি, অনেক আগে থেকেই আমি মেয়েদের প্রতি কেমন একটা মুগ্ধতায় অভিভূত হয়ে আছি, এজন্যই আমি সবসময় চাইতাম আমি একটা কন্যা সন্তানের বাবা হবো। আমি কোনদিনই কাউকে দুঃখ দেইনি, আমার সব প্রেমিকাই আমার জন্য ঝোলায় ঝোলায় ভর্তি দুঃখ রেখে গেছে, সেসব নিয়ে আমি এই যে জীবনকে যাপন করে যাচ্ছি, আমার মনে হয় শেষ পর্যন্ত আমার জীবনে বিরহই জয়ী হয়েছে, আমিও তাই বিরহকেই আমার সমস্ত শৈল্পিক চর্চায় এতোখানি নিয়ে নিয়েছি, এজন্যই নিজেকে আমার বিরহী বাউল মনে হয়!

আপনার কবিতায়, গানে যেই তুমি থাকে, এতো রকমের তুমি, সেই তুমি কি আসলে বিভিন্নজন নাকি একজন? সে কি আসলেই এক্সিস্ট করে নাকি কল্পনার?
আমি কখনো নিজে না দেখে কিছু লিখি না, দেখার বাইরে আমি কখনোই কিছু লিখি নাই। আমি এই সত্যটা বলতে ভয় পাই না। কারণ আমার কবিতায় যে ঘাসফড়িংকে তুমি দেখবে সেই ঘাসফড়িং সত্যই আমার জীবনে ছিল, কোন এক ঘাসফুলকে নিয়ে আমি লিখেছি, কোনো এক সন্ধ্যামালতীকে নিয়ে আমি গেয়েছি, আমি কোন অরুন্ধতীকে নিয়ে লিখছি… আমার জীবনের এই সন্ধ্যামালতীরা সত্য, ঘাসফড়িং সত্য, ঘাসফুল সত্য, হ্যা? এই হচ্ছে ব্যাপার যে আমি আসলে মিথ্যে বা কল্পনা লিখি না, আমি যা লেখি, যা গাই আমি কাউকে না কাউকে অনুভব করেই গাই, আর সে এক্সিস্ট করে এমন কেউই।
যারা বলে, তারা পৃথিবীর কাউকে নিয়ে লিখছে না, তারা লিখছে অন্য কিছুকে উদ্দেশ্য করে এদেরকে আমার ভণ্ড, ভিতু আর চরিত্রহীন মনে হয়। কারণ, আমি ওটা পারি না। আমি রাইটার, আমি আমার প্রেমিকাকে দেখে সে সামনে না থাকলেও কল্পনা করতে পারবো, এটা ভিন্ন। কিন্তু সম্পূর্ণ না দেখে কাউকে কীভাবে কল্পনা করা যায় আমার জানা নেই। আমি সমাজকে ভয় পাই না, আমি জানি আমার জীবনটা খুব ছোটো আমার যা ইচ্ছে-আকাঙ্ক্ষা সমস্ত কিছু নেয়ার এবং প্রকাশ করার এটাই আমার সুযোগ। তাই আমি সমাজকে আড়াল করে কিছু লিখতে চাই না। যে আমার প্রেমিকা তার অন্য সংসার থাকলেও আমি তাকে আমার শিল্পে স্থান দেবোই। কারণ এটাই আমার কাজ বলে আমার মনে হয়। তোমাকে তো সব বলাও যাচ্ছে না, তুমি ছোট আর এতো সময়ই কোথায় তোমার বা আমার, কিন্তু আমার আত্মজীবনীতে আমি আমার সমস্ত প্রেমিকদের নাম ধরে ধরে লিখবো।
এই কাজটা আমার মনে হয় যারা করে, বলে যে আমি কাউকে নিয়ে লিখছি না, অন্যকিছু আছে এই লেখায় তারা যেটা করে সেটা অনেকটা চুরির ধান্ধার মত। যেমন আরামদায়ক ঝামেলামুক্ত একটা অবস্থান তৈরি করে নিজের জন্য। একসাথে অনেক সম্পর্কে থাকে, সবাইকেই বলে এটা তুমি, অথবা সবাইকেই বলে এটা কেউ না! আমার এমন সমস্যা নেই, আমি একটা সময়ে একটা সম্পর্কেই থাকতে পছন্দ করি, হ্যা সে চলে গেলে আমি দুঃখ পাই, কাঁদি, কবিতা লিখি, গান গাই, কিন্তু তার জন্য আমার জীবনকেও থেমে থাকতে দিই না! নতুন প্রেম এলে আমি পুরনোকে মনে রেখেই নতুন প্রেমে পড়ি।
প্রতিনিয়ত প্রেমে থাকা একজন শিল্পীর জন্য জরুরি, আমি একটা গান লিখেছি, সেই গানটা প্রথম আমি কাকে শুনিয়ে জিজ্ঞেস করবো যে কেমন হয়েছে? একটা সুর করলাম, একটা ছবি আঁকলাম আমি কাকে দিয়ে প্রথম বিচারটা করাবো? আর যাকে দেখানো যায় আমার মনে হয় তাকে অবশ্যই প্রেমিকা হতে হয়! কারণ আমাকে সবচেয়ে বেশি তো সেই বুঝবে! কথা জমা রাখার জন্য একজন মানুষ প্রয়োজন। আমি খুব আয়ুর লোভী! আমার বাঁচতে ইচ্ছে করে অনেক অনেক বছর! তেমনি আমার সবসময়ই প্রেমের মধ্যে থাকতে ইচ্ছে করে। প্রেম জীবনের একটা সৌরভ, এর সুঘ্রাণে জীবন সুন্দর থাকে।

লুৎফর হাসান

আচ্ছা, এরকম একজন প্রেমিক আপনি, যখন ছোটো ছিলেন তখন কেমন ছিলেন, তখন প্রেম তো অবশ্যই নারীর প্রতি ছিলো না কিন্তু মানুষ হিসেবে তো আপনি তখনই তৈরি হচ্ছিলেন, আপনার শৈশব কৈশরের সেই গড়ে ওঠার গল্প শুনি…
বাংলাদেশের বা এই উপমহাদেশেরই বলা যায়, সন্তানদেরকে নিজের মত করে মানুষ হতে না দিয়ে বাবা-মা খুব বেশি আহ্লাদিপনা করে থাকেন। যেমন আমার ছেলেকে এটা বানাবো সেটা বানাবো ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আমার ছেলে কী হতে পারবে, বা চায়, সেটাকে তারা পাত্তা দেন না! আমি এই আহ্লাদিপনার শিকার!
আমি জন্মের আগেই আমার বাবা আল্লাহর কাছে বলেছেন, তাকে যদি আল্লাহ প্রথম সন্তানটি ছেলে দেন তাহলে তিনি তাকে কোরআনে হাফেজ বানাবেন! এটা আমার কাছে আব্বার খুব অসৎ চিন্তা মনে হয়েছে, কারণ মেয়ে হলে কী? সেটা খারাপ? তা তো নয়? তাছাড়া আমার আব্বা উচ্চশিক্ষিত, তিনি মূর্খও না। কিন্তু তার চাওয়াটা এসব প্রমাণ করে না। তো যাই হোক তার আশা পূর্ণ হয়েছে, আমি ছেলে হয়েই জন্মালাম, এবং বাবা আমাকে প্রথম প্রাথমিক বিদ্যালয়েই ভর্তি করান। সেই মধুপুর স্কুল ছিলো জঙ্গলের মধ্যে, সবুজ গাছপালা আর পাখির শিষ, বাচ্চাদের কলকাকলি! ভীষণ অন্যরকম সুন্দর এক জায়গা। কিন্তু কোনো এক কারণে সেখান থেকে নিয়ে আবার পাকুটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করান আমাকে। এখানে পঞ্চম শ্রেণী পাশ করার পর সবাই যখন হাইস্কুলে ভর্তি হচ্ছে আমাকে ঠেসে ধরে হাফেজি মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিলেন আব্বা। আমি সেখানে যেয়ে দেখি আরবি ব্যকরণ, ওখানে অযু ফরজ হওয়ার কারণ, অযু নষ্ট হওয়ার কারণ, মেয়েদের মেয়েলি বিষয়আশয় এসব আমার সেই বয়সে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো, কারণ আমি দেখতাম আমার পাশের বাড়ির বন্ধু পড়ছে রবীন্দ্রনাথ, কুদরাত-এ-খুদা।
যাইহোক, জোর করে ঢুকিয়ে দিলেও আমি এটাকেও সিরিয়াসলিই নিলাম এবং ভালো করলাম। বাড়ির পাশেই যে মাদরাসা, তার পাশেই কাকলি সিনেমা হল তাই সেই মাদরাসায় আমার পড়া নিষেধ। আমার গ্রামে একটা নদী তার নাম ঝিনাই, গ্রামের সামনেই বিস্তৃত দুই দিকে দুইটা বিল, শেওলা বিল আর হেলেঞ্চা বিল। এই দুই বিলের মাঝখানে একটা মাটির রাস্তা। এই কাচা রাস্তা ধরে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে আমি তখন খুবই বাচ্চা ছেলে, এতো কষ্ট করে মাদরাসায় যেয়ে পড়তাম। অথচ আমাদের গ্রামেই ভালো ভালো হাইস্কুল ছিলো। ব্রিটিশ আমল থেকেই ছিলো। আমার গ্রাম ভীষণ সুন্দর, নবগ্রাম নাম। সেই সুবর্ণ গ্রাম ফেলে আমি থানা শহরে যেয়ে পড়তাম। কিন্তু আমার আবার সেই অর্থে কোনো কষ্ট হতোও না। কারন দুই বিলের মাঝখান দিয়ে যেতে যেতে প্রকৃতি আমাকে আবিষ্ট করে রাখতো, আমি কষ্ট অনুভব করার সময়ই পেতাম না, আমার সমস্ত উপলব্ধি জুড়ে শুধু সবুজ শান্তি বিরাজ করতো। আমার উপন্যাসে, লেখায় যে বিস্তৃত বর্ণনাংশ পাবে সেসব আমার মনে হয় আমি এখান থেকেই নিই এখনো।
যখন বর্ষা , জল থই থই একেবারে, দুইপাশে সাগর রেখে যেন মাঝখান দিয়ে আমার জন্য কে রাস্তা বানিয়ে দিয়েছে! আবার শীতের দিনে মৌসুমী ফসল। সর্ষের হলুদ ফুলে মনে হতো হলুদ স্বপ্ন বিছিয়ে রেখেছে কেউ, গম ক্ষেতের গম যখন পেকে ওঠেনি তখন একটা অদ্ভুত রং নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো, দেখা যেতো কী, একটা গম ক্ষেত যেতে যেতে ঢালু হয়ে নদীর পাড়ে চলে গেছে, কিছুটা পাড় ভাঙ্গা, একেবারে শেষ পর্যন্ত সেই রঙটা ছড়িয়ে আছে, তারপরেই নদী ছল ছল করে শব্দ করছে, এই যে রং আর শব্দের এই সমন্বয় এসব নিয়ে নিয়ে আমি তখন থেকেই যেন ঋদ্ধ হয়ে উঠছিলাম। এসব সৌন্দর্য আমি গিলে গিলে খেতাম যেন।
আবার এসব দেখা সেই চোখ নিয়ে চলে যেতাম সিনেমা হলে যখন আরেকটু বয়স বাড়লো তখন। সিনেমা হলেও সেই একই প্রকৃতি, সাগরের পাড়ে দাঁড়িয়ে নায়িকা গান গাচ্ছে, নায়ক গান গাচ্ছে, বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘর গৃহস্তও যদি দেখাতো সেখানেও তো সেই একই গ্রাম আমার নবগ্রামেরই মতো। আমি কেবলই মুগ্ধ হতাম। রুবেল আমাদের প্রিয় নায়ক ছিলো তখন, জসিম, শাবানা, আলমগীর এদের কান্না দেখলে আমরা খুব সহজেই কেঁদে ভাসতাম। আর যেসব গান হতো সিনেমায় ,কী অসাধারণ সেসব গান! বাংলা সিনেমার গানের স্বর্ণযুগ বলতে পারো সেইসময়কে। কোনো কপি পেস্ট না, কোনো প্রভাব না। সমস্তই মৌলিক গান। আমার এই সিনেমা দেখার গল্প নিয়ে আমি একটা কিশোর উপন্যাস লিখেছি, “সগৌরবে চলিতেছে” তুমি জেনে থাকবে!
এই মাদরাসার জীবন, আর নবগ্রাম এসব মিলে আমি ভালোই ছিলাম। নবগ্রামে সবধরণের মানুষ ছিলো, হিন্দু-মুসলমান, ধনী হিন্দু, মানে খুব প্রভাবশালী হিন্দু ব্রাক্ষ্মণ আবার মুচি মেথর সবই ছিলো। মুচি বাড়িতে নিরঞ্জন নামে একজন ছিলেন,  সে ভালো তবলা বাজাতো। তার সাথে আমার বেশ খাতির ছিলো, সে তবলা বাজাতো আমি গান গাইতাম।
সিনেমা দেখে প্রভাবিত হয়ে বাড়ি থেকে টাকা পয়সা নিয়ে আমি সিলেট চলে গিয়েছি একবার, এরপর এরকম আরো অনেকবার বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে গিয়েছি হাতিয়া, সন্দ্বীপ, কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, বান্দরবান। সিনেমায় দেখায় এমন সব যায়গায় আমি তখনই ঘুরে ফেলেছি। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যেয়ে বাংলাদেশের সবকটি জেলা ঘুরে দেখেছি। এসব আমার ভেতরকে চিনতে আমাকে খুব সাহায্য করেছে বলে আমার ধারণা। কারণ আমার বর্ণাঢ্য বিচিত্র একটা জীবন ছিলো তখন থেকেই। মসজিদে আজান দিতাম আমি। খাসি-ভেড়া-গরু-মহিষ এসব জবাই দেয়ার জন্য আমাকে যেতে হতো।
এই শৈশব আর কৈশোরে আমার খারাপ লাগার মধ্যে একটাই ছিলো শাসন। প্রচণ্ড শাসন! আর নবগ্রাম আমাকে ভরিয়ে তুলেছে এতোকিছুর পরেও। আমার নবগ্রাম আর বাংলাদেশ ও তার প্রকৃতিই একমাত্র শিক্ষক। আমাকে কেউ কখনো হাতে কলমে একটি সারগামও শেখায়নি। তাই প্রকৃতি ছাড়া কাউকে খুব বেশি ক্রেডিট আমাকে এখন দিতে হয় না! জীবনে মানুষ তো বারবার পিছলে পড়ে, আমিও পড়েছি শতবার কিন্তু প্রকৃতি ছাড়া কেউ কখনো আমার হাতটি ধরে বলেনি, উঠে এসো, যাও, আগাও!

লুৎফর হাসান

আচ্ছা, এই মুগ্ধ জীবনের পরেই তো আপনার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। সেই জীবনে কেমন ছিলেন?
বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আসলে আমি দেখলাম, আমি অন্য এক লুৎফর হাসান। আমি মনে করি যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েনি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ছোট করছি না, কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে জীবন সেটা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেপেলেরা কল্পনাই করতে পারবে না। যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ওই এলাকায় ছিলো বা থেকে আসে সেই বুঝে যে সে কোথায় গেছে! একটা মানুষকে স্বর্গের হাওয়া উপলব্ধি করার জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হবে সেই তরুণ বয়সে, এটা আমি মনে করি। এমনকি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কারো কাছে তুমি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের গল্প করে একেবারেই আরাম পাবে না। তারা বুঝবেই না এটা কেমন!
আমার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে যে, আমি তো আগে ছিলাম বাবা মায়ের শাসনে বন্দি এক মাদরাসা ছাত্র, কিন্তু এখানে এসে আমি প্রথম দেখলাম আমি খুব স্বাধীন। এখানে আব্বা এসে আমাকে জাম গাছে বেঁধে রাখবে না, এখানে আম্মা আমাকে হেঁসেল থেকে চুলার মুখের লাঠি এনে পিটাবে না। আমি টুপি মাথায় না দিলেই আব্বা আমাকে পিটাতো খুব। টুপিই না কেবল, শেষের দিকে আমাকে পাগড়ি আর জুব্বাও দিয়ে দিয়েছিলো, যদিও আমি সেই টুপি খুলে রেখে সিনেমা হলে যেয়ে সিনেমা দেখতাম, কিন্তু একটা কড়া এবং খুব কড়া শাসনের মধ্যে ছিলাম। সেখান থেকে রাজশাহী বিশ্বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এসে এই স্বাধীন জীবন তার উপর এমন মনোমুগ্ধকর পরিবেশ এমনকি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পথটাও আমার মনে হয় আমাকে এই লুৎফর হাসান হতে সাহায্য করেছে।
তখনো যমুনা ব্রিজ হয়নি, একটা ডিঙ্গি নৌকায় করে যমুনা পাড় হতাম, সেই নদীর পরে বিস্তৃত চর , সেই চর হেঁটে পাড় হতাম। চরের পরে আবার নৌকায় নদী পাড় হতাম, সেই নদী শেষ হলে সিরাজগঞ্জ, নদী থেকে খুব খাড়া পাড় বেয়ে উঠতে হতো উপরে, খুব ভয়ে ভয়ে পাড় হতাম, বেশ ব্যাগ থাকতো কাধে তাই! সবশেষে সিরাজগঞ্জে এসে রাতের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতাম, ট্রেনে উঠে গান গাইতাম, গাইতে গাইতে ভার্সিটি চলে যেতাম।
এই যে এমন কষ্ট করেও ভার্সিটি আসতেই আমার ভালো লাগতো। কারণ এখানে আমি স্বাধীন, এখানে আমার গানের অনেক অনেক শ্রোতা, এখানে আমি তুমুল জনপ্রিয়! বিশেষ করে মেয়েদের কাছে নিজের জনপ্রিয়তা আমাকে সত্যিই গর্বিত করে তুলতো। আমি নিজেও এসব জায়গা কিছুটা তৈরি করেছি, একটা মেয়ে আমার গান শুনে ‘বাহ’ বলবে আমি মূলত তখন এটার জন্যই গাইতাম, আমি নিজেকে নানান ভাবে শুধু এই বাহবা শোনার জন্যই তৈরি করতাম, সেসবই আমার চর্চা ছিল গানের ক্ষেত্রে। যখন রাস্তায় একা আছি, একটা মেয়ে পাশে দিয়ে গেলেই আমি গুনগুন করে গেয়ে উঠেছি, নিজেকে আমি গানের মাধ্যমে পরিচিত করতে চাইতাম, কারণ আমি দেখতে খুব একটা ভালো ছিলাম না, আর যখন দেখলাম সত্যিই মেয়েরা আমার গানের জন্য বিহ্বল হচ্ছে আমি সত্যিই অনেক বেশি আনন্দ পেতাম, উৎসাহ পেতাম।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পরেই কি গানে চলে এসেছেন? নাকি অনেক দেরি হয়েছে আসতে?
বিশ্ববিদ্যালয় শেষ হওয়ার পরে আমি ঢাকা আসলাম, সে এক দুঃসহ সময়। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজার জীবন পার করে, যখন থেকে মাস্টার্সের ভাইবা দিয়ে ফেললাম এই দিন থেকে আমি আবার যেভাবে এসেছি সেভাবেই সেই দীনবেশে বের হয়ে যেতে হয়। সাথে হয়তো কিছু বিদ্যা বুদ্ধি আর মানসিক শক্তি থাকে এর বেশি কিছুই থাকে না, আমার অন্তত ছিলো না। সেই পথের ছেলে পথে। এই শহরে আসার পর আমি খুব একা হয়ে গেছি, পাশে কেউ নেই। বাবা স্বচ্ছল ছিলেন কিন্তু সেই বয়সে আর তার কাছ থেকে টাকা নেয়ার অবস্থা ছিলো না।
আমাকে একাই চলতে হয়েছে, বাসের হেল্পার ছিলাম, ত্রিশ টাকা ভাড়ায় বুড়িগঙ্গায় নৌকায় ঘুমিয়েছি, কারণ পকেটে থাকতো পঞ্চাশ টাকা। বাকি বিশ টাকায় পরের দিন সারাদিন চলতে হবে। ইটভাটায় কাজ করেছি। পরে আবার বৈধ উপায়ে গাড়িবাড়িও করেছি। আমি তাই সবধরণের জীবনই প্রায় দেখেছি ভিক্ষুকের জীবন ছাড়া। তাই আমি বেশ সাহসী হয়ে কথা বলি, আমার স্পর্ধা তাই এতো বেশি। তুমি কে হে ভাই? কথা বলতে এসেছো আমার কাছে? কতোটুকু চেনো জীবন? তোমাকে কি খা খা জোসনায় বুড়িগঙ্গায় শুয়ে রাত কাটাতে হয়েছে? নীচে জলের ছলছল সতর্কবার্তা? নৌকা দুলছে তোমার জীবনের মত, যেকোনো সময় ঝড় এসে লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারে। আজ একটু বেড়াতে যাবো, কোথায়? জাদুকাটা নদী। রাতে একটু জোছনা বিলাস করবো, হাওরে রাত কাটাবো। তাই সবাই মিলে নৌকায় রাত কাটাচ্ছি, এটা সেরকম নয়। এটা জীবনের প্রয়োজন। এর উপলব্ধি তুমি কোথায় পাবে?

লুৎফর হাসান

আপনার গান আগে নাকি লেখা আগে, অনেকেই আপনাকে মূলত শিল্পী ভাবেন আর ভাবেন সেই জনপ্রিয়তার সুযোগে লিখছেন। আসলে কী?
এমন যারা ভাবে, তারা হয়তো আমার লেখা এবং আমাকে না জেনেই ভেবে নেয়। তাদের ব্যপারটা একেবারেই বাদ। কারণ আমার গানের মতই আমার লেখারও পাঠক আছে। আমি নিজেও অবশ্য ভাবিনি মানুষ আমার লেখা এতোটা নেবে! এখানে অবশ্য আরেকটা বিষয় আছে, সিন্ডিকেট হলে সে কবি বা লেখক, না হলে না। মানে একটা দলের সাথে আমাকে চলতে হবে, এরাই আমাকে কবি বা লেখক করে তুলবে আমার লেখার কোন শক্তি নেই। সেসব যায়গা থেকে হয়তো এসব তারা বলবে। কিন্তু আমি জানি আমার কবিতা হয়, আমার লেখা দশজন পড়ার একটা কারণ আমি আমার লেখায় দিতে পারি বলে আমি মনে করি। আমার আরো কী মনে হয় জানো? আমি লেখি ভালো, আমি গাইও ভালো, আমি আঁকিও ভালো, কিন্তু যত্নের অভাবে আমি এগুতে পারছি না ঠিক যতো দ্রুত গতিতে আমাকে আগাতে হবে সেভাবে। যত্ন বলতে বুঝিয়েছি, আমার একার যত্নে তো হবে না, পারিপার্শ্বিক সকলের একটা যত্ন লাগে, আমার জীবনে সেটা তো নেইই। বরং অনেক বেশি অসহযোগিতা আছে, তবে গানটা যত্ন পেয়েছে, সেটাকে বাঙালি আদর করেছে, সেটা বেঁচে আছে এবং থাকবেও। আমি মনে করি আমার লেখাকেও একদিন এমন জায়গায় এই মানুষেরাই পৌছে দেবে।

আপনি কোন চর্চাটা আগে শুরু করেছেন, গান নাকি লেখালেখি?
গানও আমি ছোটোবেলা থেকেই গাই, লেখাও তখন থেকেই লেখি। আমার মামা তখনই আমাদের বাড়িতে সেই অজপাড়াগায়ে আমার মায়ের পড়ার জন্য অনেক বিখ্যাত বিখ্যাত বাংলাদেশ ও কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা পাঠাতেন। আমি সেসব পড়তাম, আমার আম্মা খুব বড় মাপের পাঠক। সেই পুরনো আমলের খাটের সাথে হেলান দিয়ে তিনি সারাক্ষণ দেশ বিদেশের সমস্ত সাহিত্য পড়তেন। তিনিই আমাকে সুনীল, শক্তি, জয় গোস্বামী, কমলকুমার বা আরো যারা যারা আছেন সবাইকে চিনতে শিখিয়েছেন। আমরা সেই নবগ্রামে বসেই গান শুনতাম অঞ্জন দত্তের, সুমনের। তাই আমার যে মূল, যে গড়ে ওঠা এসব নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললে সেটা একেবারেই অকথাসুলভ আচরণ। এখনো আমি এমন একটা মানুষ, সারাদিনই লিখি সারাদিনই গান গাই।
প্রযুক্তির কল্যাণে আমাদেরকে এখন কারো বাহবার জন্য অপেক্ষা করতে হয় না, একটা কবিতা মাথায় আসলো লিখে ফেলেছি ফেসবুকের ওয়ালে পোস্ট করেছি। কয়জন দেখলো কয়জন দেখলো না তা নিয়ে এতো মাথাব্যথা নেই। যে কয়জন পড়েছে এটাই লাভ, এটা ধরো যে প্রযুক্তির সুফল। কিন্তু গানের ক্ষেত্রে এখন যেটা হচ্ছে , গান যদি তুমি সামনে নিয়ে আসতে চাও অনেক বেশি বাণিজ্যিক হতে হবে তোমাকে। মিউজিক ভিডিও ছাড়া কোন গান কেউ শুনবেই না। আর এটা কঠিন এবং কষ্টসাধ্য বিষয়। আমি তাই এখন ঠিক করেছি আমি একটা ইন্সট্রুমেন্ট নিয়েই খালি গলায় গান গেয়ে শোনাবো শ্রোতাদের। আর লেখার ক্ষেত্রে আমি আমার জীবনকেই লিখি মূলত। তাই এখানে কেউ গুরুগিরি ফলাতে আসার কেউ নেই।

আপনি সবসময় বাংলা ভাষার পক্ষে কথা বলেন খুব , বানানের পক্ষে বলেন, প্রমিত উচারণের কথা বলেন, আর এই যে কথা বলায়ও দেখলাম ইংরেজিকে এড়িয়ে যাচ্ছেন খুব সন্তর্পণে, এটা কি সচেতনভাবে প্রতিবাদ কোনো, নাকি অভ্যাস?
আমি সচেতনভাবেই ইংরেজি এড়িয়ে চলি, কেনো? কারণ আমার বাংলাটা খুব পছন্দ। যেই ইংরেজি শব্দটা আমাদের ভাষায় চলে এসেছে সেটা আমি উচ্চারণ করতে রাজি আছি, কিন্তু আমি কিছুতেই অকারণে কোনো বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলতে রাজি না। ইংরেজিতে আমি কাঁচা বা দুর্বল নই, আমি ইংরেজি জানিই না। বাংলাটা এতো ভালো লাগে আমার আর এতো স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি বাংলায় আমি তাই কথায় অন্য ভাষা নিয়ে আসার অবসরই পাইনি। আমি গ্রামে গেলেও আমার গ্রামের ভাষায় মানে খাটি আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলি সবার সাথে। গ্রামে রিকশা থেকে নেমেই প্রথমে দেখা হয় নিরঞ্জনের সাথে, নিরঞ্জন এখন সেলুন দিয়েছে গ্রামে, তাকে ডাক দিয়ে বলি,
“নিরঞ্জন কিবা আছো? তুমি কতোহন আছো এইহানে? থাহো তাইলে, আমি আইতাছি, বাইত গেতাছিগা, আইতাছি, যামু আর আমু”
আমার কথাটাকে আমি যত্ন করি, ভালোবাসি। ভালো লাগে আমার। আমার দরকার পড়ে না অন্য ভাষার, পৃথিবীর সকল বড়বড় তারকারাই দেখবে নিজেদের ভাষাকে সম্মান করছে, নিজেদের ভাষায় কথা বলছে। এই বোধটা ভেতরে থাকাও অহংকারের। সংকীর্ণমনারা নিজেকে নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগে। আমি তা না। লিওনেল মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো এরা নিজেদের ভাষায় কথা বলে, ইংরেজির ধার ধারে না। আমাদের মোস্তাফিজ— ওর কাছে এটা সমস্ত বখে যাওয়া বাঙালির শেখার আছে, ও এতোবড় একটা প্লাটফর্মে চ্যাটাং চ্যাটাং বাংলা বলে চলে, তুমি বুঝলে বোঝো না বুঝলে না বোঝো! আমার কী? এই দম্ভ ইতিবাচক। এতে দোষ নেই। আর এটা সকলেরই থাকা উচিত। যেই কথাটা তুমি বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে বলছো সেটাকেই তুমি শুদ্ধ বাংলায় বলে দেখো কতো সুন্দর শোনাবে! আমাদের এলাকায় ‘অনুসরণ’কে আমরা সবসময়ই ‘ফলো করা’ বলতাম। আমরা জানতামই না যে এটা ইংরেজি শব্দ। পরে যখন পড়াশোনা করতে শুরু করলাম, জানলাম এটা আসলে ইংরেজি। আমি সব জায়গায়ই বাংলাকে প্রাধান্য দিতে চেষ্টা করি। কিন্তু আবার অনেক বেশি গোঁড়ামিও নাই। ধরো যে সেলফিকে অনেকেই নিজস্বী বলছে। আমি বলি না, আমার মনে হয় এটার দরকার নেই। আমি যদি এখন বাজারে যেয়ে বলি, “ ঠাণ্ডা পানিয় দাও”, দোকানি বুঝবে না। দোকানিকে বোঝাতে হলে আমাকে ওই কোল্ড ড্রিংক্সই বলতে হবে।

লুৎফর হাসান

আপনার লেখায় আসি আবার, আপনার লেখা উপন্যাস পড়েছি, কবিতাও পড়েছি। সবটাতেই দেখা যায় বিরহপ্রধান প্রেম, সেই গল্প তো শুনলাম, কিন্তু ভাষায়ও অত্যন্ত গীতলতা, নরম নরম শব্দ ব্যবহার সেই বহুযুগ আগের শরৎচন্দ্রের মতোই প্রায়। কিন্তু এখন তো আর সেরকম প্রেম মানুষের মধ্যে নেই, বরং অনেক বেশি স্বার্থপরতা, প্রেমহীনতা, নৃশংসতা বিরাজ করছে, খুব হত্যা-অন্যায়-সংঘর্ষ বাড়ছে। এমন অস্থির একটা সময়ে বসেও আপনি কীভাবে এমন সহজ সরল ভাষায় সাহিত্য করে যাচ্ছেন, যেহেতু সাহিত্য লেখকের সময়কেই উদ্ধরণ করে?
এটার কারণটা বলি, ধরো আমি তোমাকে আমার ব্যস্ততা বা কাজের ভিড়ের জন্য তোমার কাছে থেকে আড়াল হতে পারি কিন্তু আমি তোমাকে কোন বাজে কথা শোনাতে পারি না। আমি দুঃখ দিলেও বড় আদর করে দুঃখ দিই, নোংরাভাবে না। একইভাবে প্রতিবাদের জায়গায়ও আমি সুন্দর ভাষায় প্রতিবাদ করি, ছাড় কিন্তু দেই না আমি কাউকে, আমার সাথে ফেসবুকে আছো যেহেতু নিশ্চয়ই জানো। আমি ভীষণ প্রতিবাদী। সারাদিন আমি দেখি অস্থির সব মানুষ। কারো মনে বা কবিতায়, লেখায় প্রেম নেই। আমার যেমন অনেক লোক ফলোয়ার তেমনি আমিও অনেকের ফলোয়ার, পড়ি অনেককেই। কারো পোস্টে দেখি না কোন স্থির চিন্তা।
আমার খুব শ্রদ্ধেয় একজন, তার ফেসবুকে দেখি সে একে গালি দিচ্ছে, ওকে এভাবে নীচে নামাচ্ছে, ওকে ওভাবে নামাবে বলছে, এর ব্যপারে ক্ষেপাটে, ওকে ধরছে, ওকে ছোটো করছে। এসব দেখতে কী ভালো লাগে? আমি তো ওনাকে অনুসরণ করে বড় হচ্ছি আমি কি এসব চাই? আমি তো তার পাঠক, তার লেখায়ও তো এইসবই চলে আসবে তার মানসিকতা যেহেতু এমন, তো আমি কি সময় নষ্ট করে এসব পড়বো? এদের গানে লেখায় বা এদের দ্বারা সৃষ্ট শিল্পে আমার মনে হয় সত্যিই প্রাণ থাকে না, থাকে অস্থিরতা। কিন্তু আমি তো তা নই। আমি বাইরে এতো চঞ্চল উচ্ছল হলেও আমি ধৈর্য ধরতে জানি, আমি স্থিরতাও ধারণ করি ভেতরে ভেতরে। আমার লেখার ভাষায়ও তাই সেরকম সুর চলে আসে।
আর গীতলতা বলেছো যেটা, সেটা অলক্ষ্যেই আসে। আমি যেহেতু গান গাই, গান লিখি বা কবিতার মানুষ আমি, একারণে গদ্যেও আমার গীতলতা হয়তো চলে আসে। আমার উপমা ভালো লাগে, আমি এখন যেমন সুবোধ সরকার পড়ছি, খুব ভালো লাগছে তার মধ্যেও দেখছি আমার অনেক প্রবণতা ছিলো। একটা কবিতা তুমি অনুভব করতে পারলে না, সেটা কীসের কবিতা? আমার কবিতার পাঠক আমি হওয়ার পড়েও আরো দশজন না হলে সেই কবিতা আমি কার জন্য লিখবো? একটা নির্দিষ্ট সার্কেলের জন্য? যারা আমায় কবি বানিয়ে তুলবে? না, আমাকে তো এসব সামলাতে হচ্ছে না, তাহলে আমার তো সেই অসংলগ্ন দুর্বোদ্ধ কবিতা লেখার প্রয়োজন নেই। তাছাড়া মার্কেটে নিজেকে টিকিয়ে রাখার প্রতিযোগিতাও আমার নেই।
আমি আমার কবিতা লেখায় গানে আমার গ্রাম নবগ্রাম, আমার গ্রামের বিল হেলেঞ্চা, আমার গ্রামের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী ঝিনাই এসবকে এনে এনে বাংলা সাহিত্যে পরিচিত করে তুলেছি। টাঙ্গাইলে গোপালপুর থানা আছে তা হয়তো অনেকেই জানে না, কিন্তু এখানে নবগ্রাম নামে একটা গ্রাম আছে সেইকথা এখন অনেকেই জানে, অনেকে বলতে আমার সাথে যারা ফেসবুকে আছে ধরো সেটা দশহাজার লোকই হোক, এরা তো জানে। এইটুকুর জন্যই আমি নিজেকে ধন্যবাদ দিতে পারি। আমি যতদিন বেঁচে আছি আরো পরিচিত করতে চাই আমার গ্রাম, আমার ভাষা, আমার প্রিয় নদী এসবকে।
দুপুরকে নিয়ে একটা ছড়ার বই বের করেছি, সেখানে বাংলাদেশের বিখ্যাত সব জায়গায় দুপুরকে নিমন্ত্রণ করেছি তার সাথে নবগ্রামেও নিমন্ত্রণ করেছি। একইভাবে আমার একটা গান আছে, “তুমি যাবে কি আমার সাথে? হাত রেখে এই হাতে, তোমায় দেবো ঝিনাই নদীর ছায়া, দেবো তোমায় নবগ্রামের মায়া…”
আমার কবিতা হোক লেখালেখি যাকিছুই হোক, আমি চাই সরলভাবে সকল মানুষের কাছে পৌছে দিতে। অনেকের লেখাই আমি দেখি, অনেক বিখ্যাত নাকি তারা। তাদের লেখা পড়ে আমি কিছুই বুঝি না। এমন না আমি পড়তে পারি না, আমার মা বিশ্বসাহিত্য ভেজে খেয়েছেন, আমাদেরকেও দু এক চামচ খাইয়ে দিয়েছেন বলা যায়, আমার মায়ের প্রিয় কবির নাম শার্ল বোদলেয়ার, শেলি, কিটস, বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিনয় মজুমদার, কমলকুমার। আমার আম্মাই আমাকে বলেছে প্রথম আল মাহমুদ পড়ো, পড়েছি। গুণদাকে পড়েছি, রফিক আজাদকে পড়েছি, মধুসূদন পড়েছি। সেই তখন মুধুসূদন পড়েছি, আমি তখন থেকেই বললেই সনেট লিখে ফেলতে পারবো। বাংলা সাহিত্যকে ভাগ ভাগ করে আমার আম্মা আমাদেরকে পড়িয়েছেন। সেক্ষেত্রে দুর্বোধ্যতা যে আমাকে কবিতা বুঝতে অসহযোগিতা করবে তা কিন্তু না, যেটা দরকারি যেখানে সেখানে সেটা হলে আমি অবশ্যই বুঝবো। কিন্তু এখন অনেকেই লেখেন যাদের লেখা আমি বুঝি না।

লুৎফর হাসান

সনেট লিখতে পারেন বললেন, ইচ্ছে করে না লিখতে?
অবশ্যই লিখবো, কিন্তু সেটার এখনো সময় আসেনি তাই লিখছি না। এখন অন্যকিছু নিয়ে ব্যস্ত আছি। এজন্যই আমার প্রচণ্ড আয়ুর লোভ। কবে আমি আমার এতো পরিকল্পনাসব সফল করবো? অনেক কিছু করার বাকি আছে।

মধুসূদন তো কবিতায়, নাটকে যা লিখেছেন সবকিছুতে অনেক বেশি ফর্ম ভেঙেছেন, এক্সপেরিমেন্ট করেছেন, এখন যারা এই যে কঠিন কঠিন আর অভিনব ছন্দ বা ফর্মে লিখেন এরাও তো এই দাবীই করে যে আমরা ফর্ম ভাংছি, এক্সপেরিমেন্ট করছি, আপনি কী বলেন?
কেউ কেউ তো অবশ্যই সেই দাবী যৌক্তিকভাবেই করছে নিঃসন্দেহেই। কিন্তু ফর্ম ভাঙ্গা তো আর দাদুর হাতের মোয়া না যে, একটা প্রজন্মের সকলেই ফর্ম ভেঙ্গে এক্সপেরিমেন্ট করে লিখবে, কয়েকজন পণ্ডিত বাদে বাকি সবাই  কিছু পারে না, জানে না বলেই এমন সব উদ্ভট ভঙ্গি নিয়ে আসে। লোকে যেসব না বুঝে নিয়ে বলবে, বাহবা কী অসাধারণ লিখেছে! কী শব্দ! অথচ এদের পাঠক এবং এরা নিজেরা কেউই কবিতার ছন্দ বিষয়টাও জানে না। ছন্দের কী ভাগাভাগ এসবও জানে না। যখন না পারে তখন বলে আমি নিরীক্ষা করছি! হা হা হা । এসব মূর্খ নিরীক্ষার আসলে যায়গা নেই। টিকবে না এরা। সাহিত্যের ইতিহাস এত সহজ কোন বিষয় না কিন্তু।
টিকবে কী? টিকবে হচ্ছে আদর করে বসানো আদরের ছন্দ তাল লয়ের উপর ঘুমিয়ে থাকা শব্দগুলো। আল মাহমুদের রাজনৈতিক পরিচয় কী সেটা বিষয় না, বিষয় হচ্ছে তিনি যখন লেখেন, “আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেলো শেষে, হেথায় খুঁজি হোথায় খুজি সারা বাংলাদেশে” এরপর তার রাজনৈতিক পরিচয়ে তাকে ঘেন্না করো আর ভালোবাসো সেটা কোন ঘটনাই না। তার কবিতায় এমন মুগ্ধতা আছে।
আবার হেলাল হাফিজের কবিতা কেন জনপ্রিয়? এমনি? না তো। গদ্যছন্দেরই ওগুলো, কিন্তু সেগুলোকে তিনি নিপুণহাতে গেঁথেছেন! সেই গাঁথুনিতে পারদর্শিতা আছে। তাই ভালো লাগবে কিন্তু পড়েই। “এখন তুমি কোথায় আছো, কেমন আছো পত্র দিও” এই যে লেখা এর যেই মাত্রা সেটা তো বুঝতে হবে। অথচ এখন এক্সপেরিমেন্টের নামে লিখে চলছে— “গরুর চোখে তোমাকে দেখি, এরপর দুই চারটা ইংরেজি শব্দ, রোমান শব্দ, গ্রিক মিথ আনবে, এরপর আকাশে একটা সেমিনার বসছে, ওগুলোই প্রতি কবিতায় বসাবে এবং এটা নিয়েই ফেসবুক সরগরম হয়ে থাকবে তিন চারদিন। এই হলো কবি আর তাদের চর্চা। এরা যেটা করে সেটা হলো, এই যে হাততালি- লাইক এরা পেলো এদের কিন্তু মন ভরে না, কারণ ও জানে এটা কিছু হয়নি, তাই আবার ঘরে ফিরে রফিক আজাদ, শঙ্খ ঘোষ এসব নিয়ে বসে। হচ্ছে না কেনো? বারবার নিজের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তাই আমার মনে হয় আরামদায়ক কবিতাই কেবল টিকে যাবে, দুর্বোধ্য কবিতা না।

নজরুল, জীবনানন্দ, মধুসূদন এরাও তো কঠিন শব্দে লিখেছে, একেবারেই অভিধান থেকে বেছে নিয়ে নিয়ে শব্দ ব্যবহার করেছে। সেটাকে কীভাবে দেখেন?
তারা অনেক অনেক কাজ করেছেন, তার মধ্যে অনেক সুখপাঠ্য রচনা তাদের আছে, এরপর তারা যখন মৌলিক কিছুর চেয়ে এক্সপেরিমেন্টকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন তখন তারা এমন কঠিন কিছু ব্যবহার করেছেন সেটা তাদের জন্য যৌক্তিক। কিন্তু যে সহজই পারেনা সে কঠিন নিয়ে খেলবে কী?

লুৎফর হাসান

এই সময়ে লিখছে এমন কাদেরকে আপনার ভালো লাগে?
আমি পড়তে ভালোবাসি খুব ভালোকিছু পেলে। এই সময়ের কয়েকজন রাইটার আছেন যাদের কবিতা পড়তে আমার ভালো লাগে। পেন্টাকলের লেখক ইমতিয়াজ মাহমুদ, সেজুল হোসেন, সোমেশ্বর অলি, জয়ন্ত জিল্লু নামে চট্টগ্রামের একজন লেখক এরও আগের যারা আলফ্রেড খোকন, টোকন ঠাকুর, মারজুক রাসেল, কামরুজ্জামান কামু, মোহাম্মদ ইমদাদ নামে সিলেটে একজন কবি আছে সে, এদের সবার কবিতাই খুব ভালো লাগে।

পাঠকপ্রিয়তার ক্ষেত্রে তো আপনি বলে থাকেন আমার গান আমার কবিতা সবার জন্য না। ঋদ্ধ পাঠকের জন্য, আবার এখনই বললেন সহজ পাঠকের জন্য সহজ লেখা লাগবে! এই বিষয়টা কেমন?
শোনো, যেই ছেলেটা লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে টিএসসি আর শাহবাগ ঘুরবে সেই ছেলের জন্য কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ না, আবার যেই ছেলে সারাজীবন শুধু হুমায়ূন পড়েছে তার জন্যও কিন্তু বুদ্ধদেব বসু না। আমি বলেছি এমন পাঠকের কথা যে সব পড়ে এবং সেই পড়াটা নিতে পারে, হজম করতে পারে, যার বিচার শক্তি আছে। আমি নিজেও মোটামুটি সব পড়ুয়া লোক তবুও আমি কিন্তু হেলে যাই অনেকের কাছে গেলেই। পাঠকেরও তো রকমফের আছে। আমি প্রায় প্রতিদিনই দুই ঘন্টা করে পড়ি। গত ত্রিশ বছর ধরে আমি এই পড়াশোনার নিয়মটা চালিয়ে যাচ্ছি, সেই আমিও বাচ্চা হয়ে বসে থাকি অনেকের সামনে গেলে। তারমানে আমাদের দেশে যে বোদ্ধা আর প্রাজ্ঞ পাঠক আছে সত্যিই সেটা তোমাদের জানা উচিত।

আপনি তো আপনার জীবন লিখেন বললেন, জীবনের আর কোন অধ্যায় বা দিক লেখার এখনো বাকি আছে যা লেখার প্লান নিয়ে রেখেছেন?
ভ্রমণ সাহিত্য করবো। আমি জীবনে তো দেশে বিদেশে অনেক ঘুরেছি এখনো ঘুরছি। সেইসব গল্প অনেক মধুর! সেসব নিয়ে লেখার একটা পরিকল্পনা আছে।

আচ্ছা, এবার গানে আসি, যেটা আপনার ধ্যানজ্ঞান অনেকটা বা আপনার খ্যাতির জন্য এখনো আপনার কাজের যে দিকটা সবচেয়ে বেশি দায়ী সেটা তো গানই এখনো…
হ্যা, এখনো গানই। কিন্তু গানকে আরো ভালো জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা আমার আছে।

হ্যা, এই আরো ভালো জায়গাটা কেমন আপনার চোখে?
এই ভালো জায়গাটা হচ্ছে আমি যখন গান গাইতে গাইতে মনে হবে আমার আর কিছু গাওয়ার বাকি নেই। সকল মানুষের জন্য আমার একটা করে গান থাকবে যেই গানটা একেকজন মানুষ আদর করে নিজের কাছে রাখবে এমন একটা যায়গায় আমার গানকে নিয়ে যেতে হবে আমাকে।

লুৎফর হাসান

আপনি একেবারেই আমাদের সময়ের শিল্পী, এখন আমি যেমন ইংলিশ, হিন্দি, স্পেনিশ, চায়নিজ কোরিয়ান সব ধরণের গান শুনি, বাংলাও শুনি, এতোকিছুর মধ্যেও আপনার প্রায় দশটা গান আমার প্রিয়। এসব গানের পরে আপনি এমন অনেক গান করেছেন যার প্রায় কোনোটাই আর ভালো লাগছে না বিশেষত আমার, এবং আশেপাশের অনেককেই বলতে শুনি আপনি আপনার পথটা হারাচ্ছেন। এই বিষয়ে আপনার কী বলার আছে?
হ্যা, ঠিকই বলেছো। আমার ঘুড়ি গানের পরপর আমার অনেকগুলো ঘুরির চেয়েও ভালো ভালো গান করতে পেরেছিলাম। কিন্তু তার কিছু পরে আমাকে চরম দরিদ্রতা গ্রাস করে, আমি সদ্য চাকরি হারানো মানুষ, মেয়ের দুধ নিয়ে ঘরে ফিরতে হবে, শুক্রবারে অন্তত এক কেজি মাংস নিয়ে ঘরে ফিরতে হবে, চারটা মাছ রোজ কিনতেই হবে দুইজন মানুষের খাওয়ার জন্য, বাসা ভাড়া দিতে হবে মাস শেষে এইসব চাপে পড়ে আমাকে তখন যে যেই গান গাইতে বলেছে আমি সেই গানই গাইতাম। এই যে অনুরোধে ঢেঁকি গিলেছি সেই ঢেঁকির ফসল এখনো আমাকে ভোগায়, আমি নিজেও বলি এখনো যে ঘুড়ির কিছু পরে আমার এমন কিছু গান আছে যেগুলোর শিল্পী পরিচয় দিতে আমার লজ্জা লাগে! কিন্তু কিছু করার নেই। এটাই বাস্তবতা!

কিন্তু গত কয়েকবছর ধরেই দেখছি, মিউজিক ভিডিও নির্ভর কিছু গান করেছেন যেগুলো আর আপনাকে আগের আপনার কাছে নিয়ে যেতে পারছে না! আবার আপনি দেখি এসব গানের বিরোধিতা করছেন যে এসব করে কেউ গানের জগতে নিজের নাম নিয়ে দাঁড়াতে পারবে না।
হ্যা তা হয়তো হচ্ছে। কিন্তু এখন এই এক বছর ধরে আমি আর সেরকম কাজ করছি না। চেষ্টা করছি নিজের কাছে ফেরার।

আচ্ছা, গান, লেখালেখি, পড়াশোনা এসব ছাড়া আপনার আর কী করতে ভালো লাগে?
ছবি আঁকতে, কিন্তু নানান রকম প্রতিবন্ধকতার জন্য সেটা হয়ে উঠছেনা। আমার আঁকা অনেক ছবি স্টোররুমে পড়ে আছে।

সাক্ষাৎকার শেষে
সাক্ষাৎকার শেষে

আপনি নিজের সম্পর্কে অনেক উচ্চ ধারণা রাখেন কথা বলে অন্তত তাই মনে হয়েছে, আপনি নিজে কিছু বলুন…
আমি ভীষণ অহংকারী একজন, আমি একজন কন্যা সন্তান-দুপুরের বাবা, আমি দেখতে খুব ভালো নয়, কিন্তু আমি ভীষণ ভালো কথা বলি, আমার মনে হয় আমার সাথে কথা বললে যে কেউ আমার প্রেমে পড়তে বাধ্য। সে যদি কয়েক সন্তানের মাও হয় তবুও। এমনও হয়েছে, আমার সাথে শত্রুতা চর্চা করতে এসে অনেকেই আমার প্রেমে পড়ে গেছে, আমার সাথে সখ্যতা তৈরি হয়েছে। আমি এক উদ্ভ্রান্ত প্রেমিক, অনেকটা বারুদের মতো। তবে আমি জানি না ঠিক এখনো আমার মধ্যে কী কী আছে, কী কী নেই, সক্রেটিসকে এখনো জবাব দিতে পারিনি হয়তো…

ধন্যবাদ আপনাকে, সক্রেটিসের জন্য জবাব তৈরি করে ফেলবেন, এই শুভকামনায় শেষ করছি আজকে।
ধন্যবাদ তোমাকেও!

ছবি : লুৎফর হাসানের ফেসবুক পোস্ট (পাবলিক) থেকে।