রোথাং রেখা

1335

স্নিগ্ধা বাউল

মানালীর সকালটা ছিল ঝকঝকে। ঢাকা থেকে বয়ে নিয়ে যাওয়া আমার লাল ওভারপুলটা এখনো কাজে লাগাতে পারিনি। ড্রাইভার জাবেদ জানালো ‘উপর বহত ঠান্ডি হোগি’। সকাল সকাল স্নান সেরে লাল ওভারপুল, লাল টুপি আর লাল টিপে আমাকে অত্যন্ত সুন্দর লাগছিল। যদিও সুন্দর কারে বলে একটু পরেই টের পাই।

আমাদের মূল গন্তব্য যেহেতু কাশ্মীর তাই সকালে ঢুকে যাই এজেন্সিগুলোর কাছে। সবার একই বক্তব্য ‘লাদাখ লে’ যাওয়ার চিন্তা বাদ দেও। বাদ দিলাম। এবার হাতে মানালী। গাড়ি মল রোড থেকে বের হতেই একটা পাতলা ব্রিজ, পাথর ভেঙ্গে জল সেখানে কলকল করছে। জলধারা হাতের বা দিকে ফেলে আমরা ছুটে চললাম। বলে রাখি আগেই, এবারের গন্তব্য রোথাং পাস এবং এটি আমার দেখা সুন্দরতম স্থান। জানলাম রুথাং যেতে প্রায় আড়াই ঘন্টা লাগবে। পথে পড়বে সোলাঙ ভ্যালি।

Rothang-1আমরা গান শুনছিলাম এবং ছবিও তুলছিলাম। আঁকা বাঁকা পাহাড়ী পথ। গাড়ি ছুটছে অনেকগুলো। সম্ভবত প্রতিদিন দুইশ গাড়ি রোথাং যেতে পারে এবং আগের রাতেই তার জন্য রেজিস্ট্রেশন করতে হয়।

আপেল গাছগুলো হাতের দুই পাশে, বলে রাখি চিরল পাতার ফাঁকে প্রথম আপেল ঝুলতে দেখে আমি যার পর নাই উত্তেজিত। যদিও কাশ্মীর গিয়ে তব্দা খেয়েছি। তব্দা খাওয়া সবেমাত্র শুরু। এই প্রথম চোখে পড়লো প্রকৃত অর্থে যা ভ্যালি। পাহাড় থেকে পাহাড়গুলো যেন ছিটকে গেছে। অথবা আলাদা হয়েছে কোন জোর জবরদস্তিতে। এত এত মোচড় আর টানাটানিতে কুঁচকে গেছে পাহাড়গুলোর শরীর, তৈরি হয়েছে এক অশরীরী সৌন্দর্য।

এ পথে এত এত পাহাড় যে পুরো কাড়াকাড়ি। একটার ছায়ায় আরেকটা পাহাড় হয়ে গেছে কালো দৈত্য, কখনো একটা পাহাড়ের মাথায় আরেকটা পাহাড়ের মাথা সূর্যের আলোয় চকচক করছে যেন সোনালু। ঘণ্টাখানেক পর একটা ছোট্ট গ্রাম পেলাম। এখানে গাড়িগুলো থামবেই। এখানে পাওয়া যাবে নাইলনের বিশেষ পোশাক যা বরফ গরিয়ে যেতে সাহায্য করবে। আমরা থামলাম না।

এই পথ ধরে যেতে যেতে আপনার অসংখ্যবার থামতে ইচ্ছে করবে। গাড়িচালক সতর্কতার সাথে এড়িয়ে যাবে, কারণ তাকে একই বহরে ফেরত আসতে হবে। আমরা এ পর্যায়ে ক্লান্ত। ছবি তোলা বন্ধ করে হা করে তাকিয়ে আছি। যত সৌন্দর্য দেখছি তার সিকিও আমরা ক্যামেরায় ধরতে পারছি না। পথে কিছু নিরাপত্তার পোস্ট আছে, এন্ট্রি করে গাড়ি যখন ছুটছে তা একদম উপর। এ সময়ে একটু অক্সিজেনের অভাব হবে এবং হাতের কাছে জেল রাখতে হবে নাকে দেবার জন্য।

ক্রমশ উপরে উঠছি আমরা। এবার দৃষ্টিসীমায় ধবধবে পাহাড়চূড়া। এ যেন অপার এক জগত। এখানে কোন সীমাবদ্ধতা নেই, কেবল অনুভূত হচ্ছিল সৃষ্টির লীলার কাছে নিজের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রতা। পাহাড় এবার ডাকছে। কত হাজার ফিট অনুমান করতে পারছি না, তবু একটা বড় পাথর গড়িয়ে পড়লে তা নিশ্চিহ্ন হবে। পাহাড় কখনো কালো কখনো ধূসর আর সাদাও হচ্ছে।

rothang-2রোথাং এর জিরো পয়েন্টে এক এক করে গাড়িগুলো এসে থামলো। গাড়ির দরজা খুলতেই টের পেলাম এসব ওভারপুল আর গ্লাভসেও হবেনা। নেমেই দৌড়। চারদিকে খোলা এক প্রান্তর। উত্তর থেকে যে বাতাসটা আসছিল তা যেন অন্য গ্রহের। বাতাসের সাথে পেঁজাতুলোর মতো বরফ। গায়ে মাখিয়ে নিচ্ছলাম হিমালয়ের দুরন্তপনা।

আমাদের ছাড়ায়ে পূর্বদিকে রাস্তাটা ছুটে গেছে আরও পাহাড়ের আড়ালে। বড় বড় ট্রাকগুলো একটা পাহাড়ের আড়ালে গেলেই আর দেখা যাচ্ছেনা। ওই পথটাই লাদাখের। কেমন ডাকছে যেন অশরীরী। এখানেও রয়েছে জমানো ঝিলের জল। বরফ হচ্ছে আবার গলছে। ভাবছিলাম আর কিছু না পাই নিশ্চিত দুএকজন নোয়াখালীর লোক পাবো, ভাগ্য সুপ্রসন্ন দুইজন ঢাকাইয়া পেলাম। দল বেধে ছবি নিয়ে এবার ফেরার পালা।

ফিরতি পথে তো থামবোই। প্রথম থামলাম ভেড়ারপাল দেখে। আশ্চর্য আমরা নামতেই একটা বাঁশি বাজলো আর কয়েক সেকেন্ডে ভেড়াগুলো কেমন হারিয়ে গেলো। মন খারাপ করেও নামতে লাগলাম। সামনে ছোট একটা মাটির ঘর, পাশে আগুনের জন্য জায়গা। একটু দূরে সেই রাখাল। ডাকলাম আমি- ‘ইধার আও, হাম গুন্ডে নেহী, ভেরুকো কিও ভাগায়া’।
আমার কথা শুনে হাসলো এবং আবার বাঁশি বাজাতেই সবগুলো কোত্থেকে এসে হাজির।

ওর নাম কুন্ডুলাল। দুইশ ভেড়া নিয়ে এসেছে জম্মু থেকে। ঠান্ডায় লোম বড় হলে আবার ফেরত যাবে মালিকের কাছে। কী জীবন!!!

পথেই সেলঙ ভ্যালি। এখানে উড়া যায় আকাশে আর পাহাড়ে। বাদ দিলাম। তবে আপেল বাগানে নামতে ভুল করলাম না। বাগান সাফ। খুঁজে একটা পেলাম।
বিকেল পাঁচটা নাগাদ মানালী।

এবার এক আশ্চর্য দর্শন। দেবতা আর দেবীর মন্দিরে গিয়েছি অনেক। এখানে আছে এক রাক্ষুসীর মন্দির। নাম তার হিড়িম্বা।পঞ্চপাণ্ডবের এক ভীমের স্ত্রী। আশ্চর্য এক কাঠের বাড়ি। কোন সংস্কার নেই। একদম মনে হবে মহাভারতের কাল। এটি নিয়ে পরে লিখবো।

সন্ধ্যার পর মলরোডে। দুষ্ট ছেলেটা চারটা পানিপুরি দিয়ে বলে আটটা দিয়েছে। এই প্রথম ঠকলাম।এরমধ্যে শুরু হলো বৃষ্টি। সরাসরি লাদাখ যাওয়ার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে এবার জম্মুর পথ ধরবো আমরা। কাল ভোরে জম্মু।

স্নিগ্ধা বাউল: লেখক, কবি ও শিক্ষক।