মেননকে ছাড়তে হচ্ছে ভিকারুননিসার দায়িত্ব

1092

মুরসালিন মুআজ।।

অভিজাত স্কুল ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই কখনও অ্যাডহক কমিটি আবার কখনও বিশেষ কমিটি গঠন করে তিনি এ দায়িত্বে রয়েছেন।তবে শেষ পর্যন্ত আদালয়ের রায়ে রাশেদ খান মেননকে ছাড়তে হচ্ছে পরিচালনা পর্ষদ সভাপতির দায়িত্ব।  অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানিয়েছেন রায়ের কপি পৌঁছার পর এ আদেশ কার্যকর করা হবে। আর রায়ের কপি পেলে নিয়মিত আপিলের ঘোষণাও দেন তিনি।

মহাজোট সরকারের প্রথমবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন মেনন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা কমিটির সভাপতি হন তিনি। উপরন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ায় তিনি হয়ে ওঠেন সর্বেসর্বা।

দীর্ঘ সাত বছরের বেশি সময়ে তার বিশেষ কমিটি বা অ্যাডহক কমিটির কার্যক্রম। এমনকি হাইকোর্ট থেকে নির্বাচনের জন্য আদেশ দেওয়া হলেও সেই রায় অনুযায়ী তিনি কোনো নির্বাচনের ব্যবস্থা নেননি।

ভিকারুননিসা নূন স্কুলের গভর্নিংবডির সর্বশেষ নির্বাচন হয় ২০০৮ সালে। তবে ২০০৯ সালে করা আইন অনুযায়ী সেই কমিটি বাতিল করে শুরু হয় মেননের কতৃত্ব। গত ৭ বছরে চারবার অ্যাডহক ও দুবার বিশেষ কমিটি হয়। প্রথম অ্যাডহক কমিটি হয় ২০১১ সালের ১৪ জুলাই। দ্বিতীয় অ্যাডহক কমিটি হয় ২০১২ সালের ২৪ জানুয়ারি। ওই কমিটি চ্যালেঞ্জ করে ২০১২ সালে আদালতে রিট হয়।

২০১২ সালের ১০ জানুয়ারি দুই বছরের জন্য বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটির বিরুদ্ধে হাইকোর্ট রুল জারি করেন। রুল পেন্ডিং থাকা অবস্থায় ২০১৫ সালের ১২ মে আবার অ্যাডহক কমিটি হয়। একইভাবে রুল পেন্ডিং থাকা অবস্থায় ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর দুই বছর মেয়াদি বিশেষ কমিটি হয়।

আদালত থেকে নির্বাচনের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও অ্যাডহক কমিটি ও বিশেষ কমিটিতেই চলতে থাকে ভিকারুননিসা স্কুল। এই কমিটি চ্যালেঞ্জ করে ১৬ জানুয়ারি আদালতে রিট করলে ১৯ জানুয়ারি আবারও রুল হয়।

হাইকোর্টের নির্দেশনা সত্ত্বেও কমিটির নির্বাচন না দেওয়ায় এবার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভর্নিংবডি ও ম্যানেজিং কমিটি প্রবিধানমালা ২০০৯ সালের ৫ ও ৫০ ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আদালতে সম্পূরক আবেদন করা হয়।

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক অধ্যাদেশের (১৯৬১) আওতায় ‘মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিংবডি ও ম্যানেজিং কমিটি প্রবিধানমালা-২০০৯ এর ৫ ধারা (গভর্নিংবডির সভাপতি মনোনয়ন) এর (১) উপবিধিতে বলা হয়েছে, কোনো স্থানীয় নির্বাচিত সংসদ সদস্য তার নির্বাচনী এলাকায় অবস্থিত বোর্ড কর্তৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এমন সংখ্যক উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিংবডির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করিতে পারিবেন।

(২) উপ-বিধান ১ এর অধীন সভাপতির দায়িত্বগ্রহণের জন্য স্থানীয় নির্বাচিত সংসদ সদস্য, তার নির্বাচনী এলাকায় অবস্থিত যে সকল উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব গ্রহণ করতে ইচ্ছুক তার উল্লেখসহ লিখিতভাবে এই প্রবিধানমালার অধীন বোর্ডের চেয়ারম্যানের নিকট তাহার অভিপ্রায় ব্যক্ত করিবেন এবং উক্তি অভিপ্রায় পত্র সংশ্লিষ্ট বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠানসমূহের সভাপতি হিসেবে তাহার মনোনয়নরূপে গণ্য হবে।

৫০ ধারায় বলা হয়েছে, বিশেষ ধরণের গভর্নিংবডি বা ম্যানেজিং কমিটি-বিশেষ পরিস্থিতে বোর্ড এবং সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের কোনো বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য বিশেষ ধরনের গভর্নিং বডি বা, ক্ষেত্রমতে ম্যানেজিং কমিটি করা যাইবে।

সেই রিটের প্রাথমিক শুনানি শেষে গত ১৩ এপ্রিল এক রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হিসেবে সংসদ সদস্যদের দায়িত্ব পালন এবং নির্বাচন ছাড়া কমিটি গঠন কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না— তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট।

সেই রুলের শুনানি শেষে গত ১ জুন এই দুটি ধারা বাতিল করেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের সেই রায় স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করলে গত ৮ জুন চেম্বার আদালত কোনো আদেশ না দিয়েই (নো অর্ডার) ১২ জুন শুনানির জন্য আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন। পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে সেই আবেদনের শুনানি শেষে আপিল বিভাগও আবেদন স্থগিত করেনি।

আদালতের এই রায়কে ঐতিহাসিক বলে উল্লেখ করেন রিটকারী আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ। তার ভাষ্যমতে, অযোগ্য অধ্যক্ষ সুফিয়া খাতুনকে একচেটিয়া বাণিজ্য চালাচ্ছেন রাশেদ খান মেনন। যোগ্য অধ্যক্ষ রোকেয়া বেগমকে মেননের উপস্থিতিতে সন্ত্রাসীরা স্কুল থেকে বের করে দেয়। ভর্তি বাণিজ্যে রাজি না হওয়ায় রোকেয়া বেগমকে চুলের মুঠি ধরে বের করে দেওয়ার হুমকি দেন মেনন। সন্ত্রাসীরা অধ্যক্ষের রুমের তালা ভেঙে তা দখল করে।

এই রায়ের ফলে সেই বাণিজ্যের অবসান হলো বলে মনে করেন এই আইনজীবী। তিনি বলেন, ‘এই রায়ের ফলে দেশের ভর্তি বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য ও কমিটি বাণিজ্যের অবসান হলো।’

এই আইন বাতিল হওয়ায় শিক্ষামন্ত্রীও নৈতিকভাবে পদে থাকার যোগ্যতা রাখেন না বলে মনে করেন তিনি। কারণ তিনি শিক্ষাকে বাণিজ্যে পরিণত করেছেন।

এই মামলা পরিচালনা নিয়ে তিনি রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেলের বিরুদ্ধেও আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ আনেন। ইউনুছ আলী আকন্দ বলেন, ‘২০১৫ সালে মেনন ও স্কুলের অধ্যক্ষ ২০১৫ সালে বলেছিলেন এইচএসসি পরীক্ষার পরে কমিটির নির্বাচন দেবে। এখন পর্যন্ত কোনো নির্বাচন দেয়নি। ওই মামলার আপিলে অ্যাটর্নি জেনারেল স্কুলের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন। অর্থাৎ তিনি বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষে শুনানি করে স্টে অর্ডার নেন। তিনি দুইপক্ষে মামলা পরিচালনা করে বার কাউন্সিল রুল-৪ এর চ্যাপ্টার-৪ পরিপন্থি কাজ করেছেন। তাই অ্যাটর্নি জেনারেলের সনদ বাতিল হওয়া উচিত।’

আপিল বিভাগের আদেশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘প্রথমে ভিকারুননিসা নূন বিশেষ কমিটি নিয়ে রিট হয়। পরে দ্বিতীয় সম্পূরক রুল ইস্যু হয় কেন বিধির ৫ ও ৫০ বাতিল হবে না। বেসরকারি স্কুল পরিচালনা সংক্রান্ত ২০০৯ সালের যে বিধি এর ৫ ও ৫০ ধারায় সংসদ সদস্যদের ম্যানেজিং কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি উল্লেখ আছে। রুল শুনানি শেষে হাইকোর্ট বিভাগ রুলটি অ্যাবসলিউট (যথাযথ) ঘোষণা করেছেন এবং বিধির ৫ ও ৫০ বাতিল বলে ঘোষণা করেছে। হাইকোর্টের এই আদেশের বিরুদ্ধে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের পক্ষ থেকে আপিল বিভাগে আবেদন (প্রভেশনাল লিভ পিটিশন) করেছিলাম। আপিল বিভাগ এর ওপর কোনো আদেশ দেননি।’

তবে রায়ের কপি প্রকাশিত হলে তখন নিয়মিত আপিলের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে জানান তিনি। মাহবুবে আলম বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়সহ লিভ পিটিশন দায়ের করলে তখন বিষয়টি বিবেচনা করবেন বলে জানিয়েছেন আপিল বিভাগ। হাইকোর্টের রায়ের কপি পেলে আমরা স্কুলের পক্ষ থেকে নিয়মিত লিভ পিটিশন দায়ের করব।’

কখন থেকে এই কমিটি বাতিল বলে গণ্য হবে জানতে চাইলে মাহবুবে আলম বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়টা যতক্ষণ পর্যন্ত স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে না কমিউনিকেট (পৌঁছবে) হবে সে পর্যন্ত তো তার দিকনির্দেশনাগুলো স্কুলের কাছে অজানা রয়ে গেছে তাই না।’

এর ফলে হাইকোর্টের রায় বহাল থাকল কি না, জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল সরাসরি উত্তর দেননি।

তিনি বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়টা উনারা স্থগিত করেননি। উনারা লিভ পিটিশন দায়ের করার পরে রায়টা দেখে এ-সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন বলেছেন।’

এখন/এমএম

ফেসবুকে আমাদের লাইক করুন: http://www.facebook.com/ekhon247