মা বললেন- তুমি কবি হতে যেওনা তোমার দুঃখ-দুর্দশা আহত করবে আমাকে’ -এস এম জাহাঙ্গীর আলম

2136
এস এম জাহাঙ্গীর সরকার মনে করেন- বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ যতটা রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক ভিত্তি ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত ঠিক ততটাই সাংস্কৃতিক ভিত্তি ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিসের ২২তম ব্যাচের কর্মকর্তা ও প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী ফেনী জেলা পুলিশ সুপার তিনি। বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম শ্রেণির গীতিকার ও কণ্ঠশিল্পী। গীতিকার ও সুরকার হিসেবে তার রয়েছে শতাধিক গান। যে গানগুলো বেশি আলোচিত-আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি/শুনেছি অনেক গান-যদি লাল টিপ নীল শাড়ী পড়তে’, এতো ভালোবাসী যারে আজো বলা হয়নি তারে’, সৌভাগ্য আমার/আমি পেয়েছি তোমায় ওগো বিশ্ব নেতা তুমি শেখ হাসিনা’, কান্দে বাঙ্গালি কান্দে বঙ্গবন্ধুর লাইগা’ ইত্যাদি। মূল উপজীব্য বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, প্রকৃতি, প্রেম, মানবতা। গত ৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে অসীম সাহসিকতা, বীরত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ প্রেসিডেন্ট পুলিশ মেডেল (পিপিএম) পদক পেলেন তিনি। সম্প্রতি ফেনী পুলিশ লাইন স্কুলে হাঁটতে হাঁটতে তিনি শোনালেন তার অতীত জীবনের কথা, সঙ্গীত ও ব্যক্তিজীবনসহ নানা বিষয়ে। শ্রোতা ছিলেন শাহাদাত হোসেন তৌহিদ।

-আপনার সঙ্গীত জীবনের শুরুর গল্পটা শুনতে চাই?
জাহাঙ্গীর সরকার: সঙ্গীতের প্রতি ঝোঁক ছোটবেলা থেকেই। আমার জন্মগ্রাম পাবনার ফরিদপুর উপজেলার সোনাহারা গ্রামে শৈশবে ওস্তাদ নরেশ চন্দ্র হালদারের কাছে ৮ বছর বয়সেই আনুষ্ঠানিকভাবে হাতেখড়ি নিয়ে সারগাম গীত, ঠাট সঙ্গীত ও কিছু নজরুল সঙ্গীতের উপর তালিম নেয়ার সৌভাগ্য হয়। পরবর্তীতে আর্য্য সঙ্গীত সমিতির শিক্ষক ওস্তাদ জয়ন্তী লালা, সৈয়দ ওয়াহিদুজ্জামান (জুনু পাগলা), সুজিত রায়, গীতিকার জি. কে দত্ত, প্রয়াত প্রবাল চৌধুরীসহ অনেকের সাথে সঙ্গীত বিষয়ক জ্ঞান লাভের সুযোগ হয়। “ছোট বেলা থেকেই গান করে আসছি। বর্তমানে আধুনিক সংগীতের চর্চাও করছি। এর আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে বিটিভি ওয়াল্ডসহ দেশের কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলেও গান প্রচারিত হয়েছে আমার। আমার জন্ম ১৯৭৪ সালে বাবা- মরহুম নজরুল ইসলাম, মা- আনোয়ারা বেগম। তিন ভাইয়ের মধ্যে আমি সবার ছোট।

-একজন সঙ্গীত শিল্পি হিসেবে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
জাহাঙ্গীর সরকার : একজন সঙ্গীত শিল্পী সঙ্গীতের ক্ষুধা কিংবা আভ্যন্তরীন তাড়না আমৃত্যু পূরণ হয় না। তাড়না থাকে বলেই আরেকটু ভালো করার চেষ্ঠায় অবিরত শিল্পী তাঁকে নতুন করে নিজেকে উদ্ভাবন ও উপস্থাপনের চেষ্ঠা করে। আমি এখনও শিখছি। বর্তমানে মান্যবর লিটন চন্দ্র ধর’র কাছে নজরুল চর্চা করছি। মনে রাখতে হবে, এলাকা ও ব্যক্তি বিশেষ যে কোন অঙ্গনের সঙ্গীত শিক্ষার মধ্যে কিছু বিষেশায়িত বৈশিষ্ট শিখবার সুযোগ পাওয়া যায় যা আরাধনা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

-মানবকূল সৃষ্টির শুরু থেকে সুর-সঙ্গীতের একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক, কি মনে হয় তথ্য-প্রযুক্তির কালে সঙ্গীত কী কভূ হারিয়ে যাবে?
জাহাঙ্গীর সরকার: শিল্পী জীবনের অভিজ্ঞতা বলে, সঙ্গীত হারিয়ে গেলে মানুষের প্রাণই হারিয়ে গেলো। প্রাণ হারিয়ে গেলে মানুষ কী করে বাঁচবে বলেন? সঙ্গীতের সাধনা আজীবন মানুষের মধ্যে থাকবেই; ধরনটা হয়ত ভিন্ন হবে। সুর-সঙ্গীত-কবিতা-গল্প-উপন্যাস সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ একেকটি অঙ্গ, মাধ্যমগুলো কখনোই হারাবে না। হৃদয়ের গভীরে দাগ না কেটে প্রযুক্তির কারণে সঙ্গীত খানিকটা ভার্চুয়াল মিডিয়া নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। দিব্য চোখে এমনই মনে হচ্ছে। ভবিষ্যতে মনের উপরে ছুঁতে যাওয়া কিংবা স্পর্শ করার অনুভূতিকে কতুটুকু প্রভাব রাখবে সেটি হয়তো পরবর্তী গবেষণায় উত্তর বলা যাবে।

-সঙ্গীত গুরুমূখী একটি বিদ্যা। গুরুর আশীর্বাদ ছাড়া আসলে শিল্পী হওয়া প্রায় অসম্ভব? কি মনে করেন আপনি?
জাহাঙ্গীর সরকার : গুরুমুখী বিদ্যা অর্জনে গুরু প্রেম ¯্রষ্ট্রাভক্তি আর বিষয়ের প্রতি প্রেম কিংবা তাড়না না থাকলে আদর্শ প্রতিপ্রেম কিংবা তাড়না না থাকলে আদর্শ শিল্পী হওয়া অসম্ভব। সঙ্গীত এমন একটি বিদ্যা যা গুরু আর শিষ্য ছাড়া শেখা যায় না একান্ত বিধাতার আশীর্বাদ থাকলে তা অন্য বিষয়। যেমন- লালন শাহ, শাহ আবদুল করিম, আব্বাস উদ্দিন, রবীন্দ্র-নজরুল এঁরা গড গিফটেট। ঈশ্বরের বিশেষ কোনো আশীর্বাদ রয়েছে তাঁদের উপর। তো, সঙ্গীত যেহেতু গুরুমূখী বিদ্যা। অনেক সুক্ষ্মভাবে তা নিতে হয়।

২-সঙ্গীত সমাজের কী প্রয়োজন কিংবা কী ধরনের ভূমিকা রাখে?
জাহাঙ্গীর সরকার : নির্মল বিনোদনের জন্য গানের অবশ্যই প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সঙ্গীতের সুধা কোনো মানুষের অফুরান নয়। মানুষকে আনন্দ দেয়ার জন্যই গান-কবিতা-গল্প-উপন্যাস। পাশাপাশি সমাজে নানা বৈষম্য, সমস্যা অনাদিকাল থেকেই সঙ্গীত গুরুত্বপূর্ণ পজেটিভ প্রভাব ফেলেছে এবং ভবিষ্যতেও প্রভাব ফেলবে। যেমন মুক্তিযুদ্ধে, স্বাধীন বাংলাদেশের গানগুলো আমাদের অন্তরে চিরদিন বেঁচে থাকবে। আমাদের সমাজের ভিত্তিটাই একটা সাংস্কৃতিক ভিত্তি। সঙ্গীত যেমন একজন মানুষের মাঝে পরিবর্তন-বিপ্লব ঘটাতে পারে তেমনি একটি সভ্যতা- সময়কে উলট পালট করে দিতে পারে। দেহের জন্য আহার্য, আত্মার জন্য সঙ্গীত অপরিহার্য।

-একজন শিল্পীর দিগন্ত কী?
জাহাঙ্গীর সরকার : একজন শিল্পীর দিগন্ত হচ্ছে শ্রোতা। শ্রোতাকে আনন্দ দিতে পারাই শিল্পীর শেষ কথা। সঙ্গীতের মাধ্যমে যদি মানুষকে আনন্দই না দেয়া যায় তবে কী লাভ শিল্পী হয়ে। তাই আজীবন মানুষকে গান গেয়ে আনন্দ দিতে চাই। পাশাপাশি মানুষ যখন যে অনুভূতি থাকে সেই অনুভূতিকে ছুঁতে পারলে মানুষ সেখানে মুক্তি বা তৃপ্তি পায়, কাজেই সঙ্গীত সুখ ও বিরহ উভয় ক্ষেত্রেই একজন মানুষের খুব নির্ভরযোগ্য সহচর।

-সাম্প্রতিককালে একটি সাহিত্য ম্যাগাজিনে আপনার একটি কবিতা দেখা গেল, কবে থেকে, কোন বোধ থেকে কবিতা লেখা শুরু করলেন?
জাহাঙ্গীর সরকার : কবিতা লিখতে শুরু করি আমি যখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র।‘কবিতা লিখি আর লিখি/লাল মলাটের খাতায় পূর্ণ করি
হায়! আমার জন্মের আগে যদি না জন্মিত কাজী (কাজী নজরুল ইসলাম) আর রবি (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর); মনে হয় আমিই হতাম বিশ্বকবি’- এরকম ১০/১৫ টা কবিতা লিখতেই মা টের পেয়ে গেলেন। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার আমরা। তাই আমার সাথে কবিতা কিংবা সাহিত্য যায় না। মা অনুভব করে বললেন-তুমি কবি হতে যেওনা, তোমার দু:খ দুর্দশা দেখে আমাকে আহত করবে। ছোট্ট পান্ডুলিপি নিয়ে আমার সামনে উননে জ্বালিয়ে দিলেন। হা হা হা….। সেই থেকে লিখিনা। পরিণত বয়সে এসে দুচারটি লিখলেও সংগ্রহে রাখি নাই। সম্প্রতি আবার দু একটি লিখেছি। যদি মনে করি সেগুলো কবিতা হয়ে উঠেছে তবে মাঝে মধ্যে শখের সাথে সঙ্গ দেয়া যাবে।

– জেলা পুলিশ প্রশাসনে সর্বোচ্চ কর্মকর্তা হিসেবে নিজেকে কীভাবে দেখেন?
জাহাঙ্গীর সরকার: নির্দিধায় বলা যায় -আমি মানুষের সেবক হিসেবে কাজ করার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। পুলিশের কাজ অপরাধ দমন এবং তদন্তই পুলিশের প্রধান কাজ আর এ কাজ করতে গিয়ে পুলিশকে মামলা গ্রহণ, মামলার তদন্ত, আসামি গ্রেপ্তার, মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল এবং বিচার প্রক্রিয়ায় সহায়তা করতে হয়। সে হিসেবে পুলিশের কাজটি সত্যিই চ্যালেঞ্জিং। অর্থ্যাৎ সর্বস্তরের মানুষের সেবায় নিয়োজিত থাকাটাকে আমার কাজ মনে করি। ২০০৩ সালে ২২তম বিসিএস এর মাধ্যমে পুলিশে যোগদান করি। শুরুতে র্যাবে-৭ এ দুই বছর আট মাস চাকুরি শেষে রংপুরে এক বছর সার্কেল অফিসে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন কঙ্গোতে এক বছর, অতপর ঢাকা মেট্রোপলিটনে সাড়ে তিন বছর বিভিন্ন শাখায় কাজ করি। ময়মনসিংহ জেলায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে কাজ করার পর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া উইংয়ে কর্মরত থাকাবস্থায় পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পেয়ে ৭-৮ মাস ঢাকায় উপ-কমিশনার হিসেবে কাজ করি। সর্বশেষ পুলিশ সুপার হিসেবে ফেনী জেলায় যোগদান।

– মাদক দমনে সাম্প্রতিকালে আপনি তথা ফেনী পুলিশ প্রশাসন তৃতীয় হয়েছেন, এটিকে আপনি কীভাবে মুল্যায়ন করবেন?
জাহাঙ্গীর সরকার : পুলিশের নানামুখী কর্মের মধ্যে মাদক নির্মূলে কাজ করা অন্যতম অধ্যায়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী অন্যসব কাজের মধ্যে মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে পুলিশ প্রশাসন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। ফেনীতে মাদক উদ্ধারে পুলিশ প্রশাসন যথেষ্ট তৎপর রয়েছে। এক্ষেত্রে সাহসী ভূমিকা পালন করার জন্য প্রধামন্ত্রী ফেনী পুলিশের ভূয়সী প্রশংসাও করেন। মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশ, জনতা ও সুধীজন সবার সমন্বয়ে কাজ করতে চাই। যার যার অবস্থান থেকে সবাই যদি পুলিশ প্রশাসনকে সহযোগিতা করে আশা করি সমাজ মাদকমুক্ত হবে। পুলিশ তার কাজটি ঠিকমতো করতে পেরেছে তা সত্যিই ভালো লাগছে।

-পুলিশ সুপার, কবি, সঙ্গীত শিল্পী, সুরকার- কোনটি আপনার কাছে বড় কিংবা কোনটাতে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করেন?
জাহাঙ্গীর সরকার : সঙ্গীত গুরুমুখী বিদ্যা। সৃষ্টিকর্তার বিশেষ আশির্বাদ না থাকলে সৃষ্টিমুখী বিদ্যার্জন কিংবা কল্যাণমুখী সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ মোটেই সম্ভব না। আমি মনে করি পুলিশের চাকুরির চেয়ে শতগুণ বেশি চ্যালেঞ্জিং একজন প্রকৃত শিল্পী হওয়া। লক্ষ্য যদি স্থির থাকে অর্জন সম্ভব। আর দুটো একসাথে চলছে এতে কোনো অসুবিধে হয় না আমার। আমি মৌলিক গান করার পাশাপাশি জনসচেতনতামূলক গান করতে বেশ ভালবাসি। আমার কথা, সুর ও কন্ঠে বেশ কয়েকটি গান বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বেসরকারি টিভি চ্যানেলে সম্প্রচার হয়েছে এবং ইউটিউব চ্যানেলেও রয়েছে। সম্প্রতি রোহিঙ্গা নির্যাতনকে নিয়ে করা আমার কথা ও সুরে মানবতায় বাংলাদেশ গানটি বেশ সাড়া জাগিয়েছে।

১-এ পর্যন্ত আপনার কয়টি গানের অ্যালবাম বের হয়েছে?
জাহাঙ্গীর সরকার : পরীক্ষামূলকভাবে প্রেমের বাউল নামে একটা অ্যালবাম বের করেছিলাম। এরপর ৫০টির বেশি গান করেছি, কিন্তু গানগুলো একত্র করে কোনো অ্যালবাম হিসেবে বের করার সময় আর হয়নি। ইতোমধ্যে দুএকটা মিক্সড অ্যালবাম, নাটক, টেলিফিল্ম ও টাইটেল সং-এ সুরারোপ ও কণ্ঠ দিয়েছি। এ ছাড়া সামনে ওয়াজী উল্লার কথা ও শামিম আশিকের সুরে খুব সম্প্রতি একটি রোমান্টিক স্যাড গান করেছি। আশা করি এটিও উপভোগ্য হবে দর্শক-শ্রোতাদের কাছে।

– একজন সঙ্গীতের মানুষ হিসেবে ফেনীর সংস্কৃতিক কার্যক্রম বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
জাহাঙ্গীর সরকার: খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার শহীদ জহির রায়হান, শহীদ শহীদুল্লা কায়সার, নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের মতো বিশ্ববরেণ্যর পূণ্যভূমি ফেনী। অতীত ইতিহাসে দেখা যায় ফেনীর সংস্কৃতি অঙ্গণ অনেক সমৃদ্ধ ছিল। বর্তমানে তা আর সেভাবে চোখে পড়ে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে মৌলবাদীদের সংস্কৃতি অঙ্গনে অনুপ্রবেশ ঘটবে এবং প্রগতিশীলের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীলরা শেকড় গাড়বে। মূলত: শহরের মধ্যখানে অধুনালুপ্ত শহীদ জহির রায়হান হলটি পুন:স্থাপন করা খুব জরুরি। সাহিত্য ও সুস্থ্য সংস্কৃতি চর্চা বাড়াতে সবার মনোযোগ কামনা করি। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনসহ স্থানীয় কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, লেখক, গীতিকার, সুরকার, নাট্যশিল্পী, অভিনেতা, আবৃত্ত্বিকার সঙ্গীতশিল্পীসহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সকল লোক ও সকল শিক্ষানুরাগীদের এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে হবে।

– পুলিশ সাধারণ মানুষের বন্ধু হতে পেরেছে বলে মনে করেন?
জাহাঙ্গীর সরকার: মানুষ মানুষের জন্য। প্রত্যেকের মনন থেকে বিবেকের তাড়নায় তার পাশের দুর্বল মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করা উচিত। একে অপরের প্রতি সহানভূতি নিয়ে যে সমাজ গড়ে উঠবে, সে সমাজ হবে নিরহংকার, হানাহানি মুক্ত ও অপরাধমুক্ত। এককথায় মানবিক মূল্যবোধের চাদরে ঢাকা সমাজ। প্রত্যেক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ নিজের বিবেককে জাগ্রত করে এরকম একটি সমাজ গঠনে এগিয়ে আসা উচিত। সে হিসেবে পুলিশ সাধারণ মানুষের বন্ধু হয়েই কাজ করছে। সমস্যা হলো যে সমাজের জন্য এ বক্তব্য প্রযোজ্য সে সমাজ আমরা তৈরি করতে পেরেছি কিনা? যেখানে অভিযুক্তের পাশে সমাজের মানুষের দৃঢ় সমর্থনের চিত্রটি এখনও ষ্পষ্ট নয়। অপরাধীরা অপরাধ স্বীকারের সহজ সরল প্রবণতা দেখা যায় না। বিচার পক্রিয়ার সাথে জড়িত ডাক্তার, উকিল, পুলিশ এমনকি বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের নৈতিকতা, আন্তরিকতা ও পেশাদারিত্বসহ যথাসময়ে বিচার প্রাপ্তির বিষয়টি কতটুকু নিশ্চিত করা গেছে এখনো পর্যন্ত সেগুলো বিবেচ্য।

-মানবতা আজ থমকে গেছে/বিশ্ব বিবেক উল্টে গেছে শিরোনামে রোহিঙ্গাদের জন্য গান গেয়ে আপনি আলোচনায় এসেছিলেন, বিষয়টি নিয়ে অনভূতি কেমন?
জাহাঙ্গীর সরকার : গানটির মাধ্যমে প্রাপ্ত প্রসংশাটুকু আরো কিছু ভালো গান করতে আমাকে তাড়িত করছে। এভাবে হয়ত মানুষ ভালো কাজের প্রতি উৎসাহ বেড়ে চলে। সম্প্রতি ‘সোনার দেশে ডাকাত পড়েছে’ শিরোনামে মাদক বিরোধী আরেকটি শক্তিশালী গান নির্মিত হয়েছে। মিউজিক্যাল ড্রামার মাধ্যমে গল্প উপস্থাপিত হবে।

-সঙ্গীত, কবিতা, সুরের মধ্য দিয়ে শিল্পীরা মূলত সবাইবে কী বার্তাটি দিতে চান?
জাহাঙ্গীর সরকার : যুদ্ধের মাঝে শান্তকে মানা, মন্দের মাঝে ভালোকে জানা আর বিচিত্রের মাঝে এককে পূজা করা। শিল্পী এই বার্তাটি তার শ্রোতাদের মাঝে পৌঁছে দিতে চান। যুদ্ধেরও প্রয়োজন রয়েছে তবে যত কম রক্তাক্ত করে যুদ্ধ করা যায়, যত কম সহিংসতা করে যুদ্ধ করা যায়, যত কম ক্ষতি করে যুদ্ধ শেষ করা যায় তার চেষ্ঠা করা, অনেক মন্দের মাঝে ও কিভাবে কম মন্দের মধ্য সেরে উঠা যায়। এবং জগতের যে বৈচিত্রতা রয়েছে, এই বৈচিত্রতার মধ্য দিয়ে এককে পূজা, একের মাঝে নিবেদিত রাখা…ইত্যাদি ইত্যাদি সমাজকে বার্তা দেয় তার সুর-সঙ্গীত, কবিতার মধ্য দিয়ে।

-আপনি বলেছিলেন- বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ যতটা রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক ভিত্তি ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত ঠিক ততটা সাংস্কৃতিক ভিত্তি ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত। ব্যাখ্যা করবেন কী?
জাহাঙ্গীর সরকার : আমি বলতে চেয়েছিলাম যে আমাদের সরকার মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক পদক হিসেবে বীরশ্রেষ্ঠ, বীর উত্তম, বীর বিক্রম ও বীর প্রতীক দিয়েছেন। সামরিক ক্ষেত্রে এটি অনেক বড় বিষয়। ঠিক কিন্তু আমাদের দেশটা প্রতিষ্ঠা হওয়ার পেছনে রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ভিত্তির উপর যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো সেভাবে সাংস্কৃতিকর্মীদের মুল্যায়ন করা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধোত্তর এ অঙ্গণটি যথাযথ স্বীকৃতি পেয়েছে বলে আমার গবেষনায় তা মনে হয়নি। রাজনৈতিক শক্তি, অর্থনৈতিক মুক্তি ইত্যাদি যেমন বঞ্চনার বিরুদ্ধে শক্তি সঞ্চার করেছে তেমনি যে সাংস্কৃতিক চেতনা হাজার বছর ধরে কর্ষিত হয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি রচনা করেছে ঠিক তারই সঞ্চিত শক্তি প্রতিবাদী হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছে এটি ঐতিহাসিক সত্য। ঠিক আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিটার বেশিরটাই ছিলো সাংস্কৃতিক, যেমন ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৬৫র শিক্ষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের সময় গান গেয়ে, কনসার্ট করে মানুষের সমর্থন আদায়, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোটা শিল্পী, সাহিত্যিক সাংবাদিক এরাই আসলে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলো সে হিসেবে তাদের মুল্যায়ন করা হয়নি।

আমি মনে করি, সামরিক পদক যেভাবে দেয়া হয়েছে সেভাবে সাংস্কৃতিকর্মীদের এরকম পদক দেয়া দরকার। কারণ, এ দেশটা স্বাধীন হওয়ার ক্ষেত্রে সাংস্কৃতির বিষয়টি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণার অন্যতম উৎস ছিল সঙ্গীত। বাংলাদেশের অবরুদ্ধ মানুষের মনে জাগিয়েছে আশার আলো, শরণার্থীদের জুগিয়েছে প্রেরণা। কণ্ঠশিল্পীরা কখনো সম্মিলিতভাবে, কখনো দ্বৈত কখনো বা একক সঙ্গীত পরিবেশন করে মুক্তিকামী বাঙালির যুদ্ধজয়ে প্রেরণা জুগিয়েছেন। অসংখ্য গান বেজেছে স্বাধীন বাংলা বেতারে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—’মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে’, তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর, নোঙর তোলো তোলো, ক্ত দিয়ে নাম লিখেছি’, ‘সোনায় মোড়ানো বাংলা’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, শোনো একটি মুজিবরের থেকে’, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘দুর্গমগিরি’, ‘আমরা করবো জয়’, ‘বাধ ভেঙে দাও’, ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই’, ‘ছোটদের বড়দের সকলের’, ‘মাগো ভাবনা কেন’। জর্জ হ্যারিসনের ‘দু’চোখে দু:খ নিয়ে বন্ধু এলো/ কাঁদে সাহায্য চাই, দেশ বুঝি যায় ভেসে/ যদিও অনুভব করতে পারি নাই তার দুঃখ/ তবু জানতাম আমার কাছে প্রয়াসের প্রয়োজন।’ গানটিতে আবেগাপ্লুত হয়েছিল বিবেক সম্পন্ন মানুষ। জাপানের তাকামামা সুজুকি মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে জর্জ হ্যারিসনের গান শুনিয়ে সংগ্রহ করেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ।

পরিশেষে তর্কের খাতিরে বলতেই হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের শত্রুশক্তি ছিলো। কারণ, এখানে আমাদের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক শক্তিকে তারা সমর্থন করেনি। তদুপরি সাংগীতিক শক্তি তাঁর অসীমত্তা দিয়ে সে দেশের জনগণকে প্রেষিত করে অর্থ আদায় করে আনতে সক্ষম হয়েছিলো। যা ব্যয় করা হয়েছিলো শরণার্র্থী শিবিরে ক্ষুধার্ত মানুষের ক্ষুধা মেটাতে।

– অনেক ধন্যবাদ।
জাহাঙ্গীর সরকার : ধন্যবাদ আপনাকে।

ছবি তুলেছেন : নাজিম চৌধুরী