বিপ্লব একজন অভিনেতার নাম

ইন্দ্রজিৎ হাজরা

740
ইন্দ্রজিৎ হাজরা

আমার এখন এমন একটা বয়েস আর ঝুলপির আয়তন যে অনেকেই আমার কাছে উপদেশ নিতে আসেন৷ বেশির ভাগ লোকজনই পেশাদারি ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে প্রশ্ন করেন৷ কেউ কেউ লেখালেখি নিয়ে৷ আবার অনেকের ব্যক্তিগত জিজ্ঞাসা৷ ‘ইন্ডি-দা, আমি যদি ইয়ে করতে চাই, তা হলে কি আমায় আগে ইয়ে করতেই হবে? নাকি ইয়ে করলেও চলবে?’ আঁতলামি যে ক্যাওড়ামির ভায়রাভাই, এই তত্ত্বটি বজায় রেখে আমি যথাসাধ্য উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করি…কিছু দিন আগে, একটি যুবক আমায় জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, ইন্ডি-দা, বিপ্লবের সময় কি চলে গেছে?’ ‘কেন, তোমার বয়স কত?’ আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম৷ ‘না, মানে, বিপ্লবের যুগ কি চলে গেছে?’ অন্য কেউ এই প্রশ্নটি করলে হয়তো আমি গুরুগম্ভীর গলায় উত্তর দিতাম, ‘দেখো, বিপ্লবকে ওই শেষ দেখেছি ‘মিসেস সেন’ চলচ্চিত্রে ঋতুপর্ণা আর রোহিত রায়ের সঙ্গে৷ সে হবে চার -পাঁচ বছর আগে৷ তবে শেষ বড়ো রোলে বিপ্লবকে দেখেছিলাম ‘পাতালঘর’ ছবিতে, যেখানে তিনি ভিক নামে ন্যাপচা গ্রহের বাসিন্দা, পৃথিবীতে এসে…’ ‘না, মানে, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায় না, ইন্ডি-দা, বিপ্লব বলতে আমি বলছি ওই রাশিয়ান রেভোল্যুশন, নকশাল আন্দোলন, আরব্য বসন্ত, হোক কলরব…’ ‘এ সব কি অলুক্ষুনে কথা, ভাই৷ তুমি চাও মানুষ ওলাউঠায় ভোগে?’ ছেলেটি ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘না, না, তা কেন চাইব, বিপ্লব মানে তো সব মানুষ এক হয়ে দাঁড়াবে৷ সব গ্লানি, দুঃখ, কষ্ট থেকে মুক্ত হবে৷ ’ ‘তা হলে বললে কেন, হোক কলেরা?’ আমি একটু ভ্রূকুটি পাকিয়েই বললাম৷

‘না, না, ওটা তো ছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হুঙ্কার যখন ক্যাম্পাসে পুলিশ ডাকা হয়েছিল!’ ব্যাপারটা বুঝে কথা ঘোরালাম৷ ‘আচ্ছা, বিপ্লবের যুগের কথা বলছ৷ তাই বলো৷ ঐতিহাসিক এরিক হব্সবম-এর লেখা পড়েছ?’ ছেলেটির চোখ দুটো হব্সবম-এর নাম শুনেই কেমন জলে ভেজা বেগুনের মতন চক্চক্ করতে শুরু করল৷ এক এক করে বইয়ের নাম লিস্টি দিতে শুরু করলো৷ ওই ফাঁকে আমি একবার শৌচালয় ঘুরে এলাম৷ ফিরে এসে দেখি তখনও টীকাসহিত হব্সবম -এর লেখালেখির তালিকা দিয়ে যাচ্ছে৷

‘শোনো, বিপ্লবের যুগ তো পুঁজির যুগেরও আগে৷ আর তার পর তো এসেছে সাম্রাজ্যের যুগ আর অত্যন্তর যুগ৷ আমি এই ব্যাপারে হব্সবম -এর সঙ্গে এক মত৷ বিপ্লবের যুগ তো হাওড়া থেকে কবে বেরিয়ে পড়েছে৷’ অল্প দাড়ি -অল্প জ্যাজ মুখ কেমন ক্ষুণ্ণ হল ছেলেটার৷ ‘তা হলে এই যে সব অন্যায়, অবিচার দিনের পর দিন চলছে, এ সব রোখবার কোনও দরকার নেই? সবই অনর্থক?’ ‘তা আমি কখন বললাম? শুধু এই বলছি যে বিপ্লবের মাধ্যমে এইগুলোর মেরামত হবে না৷ রাজনীতি নানান প্রকার, প্রতিরোধের নানান পরিচ্ছদ৷ বিপ্লবের একটা আলাদা আবেগ আছে বইকি৷ ওটা মহাকুম্ভে হোক বা নিউরেমবার্গ হোক, জনস্রোতে নিজেকে মেশানোর এক আলাদা মাদকতা আছে৷ ওই অসাধারণ জনসাধারণের গোষ্ঠীতে বৈপ্লবিক কাজকর্মের প্রচেষ্টা হয়ে গেছে, হচ্ছে, হবে৷ কিন্তু তা বলে আসল উদ্দেশ্যটা কোনও অবিচারকে সংশোধন করার যে এই বিপ্লবের মাধ্যমে, বিশেষত এই যুগে হবে, আমার আশা কম৷’ ছেলেটির মুখে বিরক্তির ছাপ দেখলাম অফসাইড দিয়ে বল বেরিয়ে যাওয়ার মতন৷ ‘ইন্ডি-দা আপনি কি বলছেন! এখন তো আরওই সফল হওয়ার কথা৷ সোশ্যাল মিডিয়া তো প্রতিবাদের বিশাল রণক্ষেত্র৷’ ‘প্রতিবাদ, নিশ্চয়ই৷ কিন্তু তুমি যে প্রথমে বিপ্লবের কথা বলছিলে?’ ‘প্রতিবাদ থেকেই তো বিপ্লব আর বিপ্লব থেকেই তো…’ ‘একটা অমলেট খাবে?’ ছেলেটি যে হাংরি জেনারেশনের, সেটা ওর শরীরে চে গুয়েভারা টি-শার্ট দেখেই বুঝেছিলাম৷ আর বিপ্লব সম্বন্ধে এত কথাবার্তা হলে আমারই খিদে পেয়ে যায় তো জোয়ানের তো পাওয়ারই কথা৷ হ্যাঁ, বলে দিল ডবল ডিমের মামলেট৷ ওই ফাঁকে আমি একটু জ্ঞান রপ্তানি করলাম ‘বিপ্লব কিন্তু চালিয়ে যাচ্ছে সবাই৷ ওটা তো আবেগের ব্যাপার৷ তুমি কি ভাবছ যারা গো-রক্ষক হিসেবে নিজেদের ঘোষণা করে লোকজনদের ঠেঙিয়ে বেড়াচ্ছে, তারা নিজেদের বিপ্লবী ভাবে না? আমাদের অনেকেরই মাথায় এঁটে আছে যে বিপ্লব মানেই লেনিন-চারু-কানহাইয়া৷

কিন্তু বিপ্লব-বিপ্লব যে শুধু বামের-ব্যায়াম না, সেটা জানলে বিপ্লব পদ্ধতি একটু কম রোমান্টিক ভাবে দেখা যেতে পারে৷’ নিজের গলা শুনে নিজেই কেমন উত্তেজিত বোধ করতে শুরু করছিলাম৷ নিজেকে দমন করে একটু হেসে ছেলেটিকে ডিমের কামড়ের মধ্যে থেকে বললাম , ‘হ্যাঁ, কিন্তু আসল কি জানো তো ভায়া৷ জীবনে টানটান উত্তেজনা কার না ভালো লাগে! টিয়েরা ডেল ফুয়েগো না পৌঁছলেও যাত্রা -টাও তো রোমাঞ্চকর৷’ ‘আপনি ফুটবল দেখেন?!’ যুবক ঝুঁকে জিজ্ঞেস করল৷ ওই তখনই বুঝলাম যে , যে দক্ষিণ আমেরিকার অতি-প্রান্তকে ফুটবল খেলোয়াড় ভাবে, তার জন্য আপাতত ফেসবুকের বাইরে বিপ্লব প্রাণিদেহজ রসবিশেষের ক্রিয়া৷ ওরফে বিপ্লব চির-আগামী, ও আর রঞ্জনার মতনই আসবে না৷ (সৌজন্যে, এই সময়)

ইন্দ্রজিৎ হাজরা, ভারতীয় সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক৷