বিনিয়োগের বিনিময়ে রাজধানী ঘোষণা

জেরুজালেম

587

এমন এক সময় ছিল, যখন সবাই এই রূপকথায় বিশ্বাস করত যে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনদের শান্তিরক্ষা কার্যক্রম নিরপেক্ষ ছিল, তাতে ধর্মের প্রভাব ছিল না। শান্তিরক্ষীদের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক পরিচয়ের প্রভাব এতে পড়ত না। এমনকি ক্লিনটন প্রশাসনের সময়ও যুক্তরাষ্ট্রের চারজন মূল শান্তিরক্ষীর সবাই ছিলেন ইহুদি। শুধু ইসরায়েলেই এই খবর ছাপা হয়েছিল। মারিভ পত্রিকা এটিকে ‘ইহুদিদের মিশন’ বলে আখ্যা দিয়েছিল।

ইসরায়েলি লেখক ও কর্মী মেরন বেনভেনসিতিহারেৎজ পত্রিকায় লিখেছেন, ওই চার মার্কিন কূটনীতিকের ধর্মীয় পরিচয় অপ্রাসঙ্গিক হলেও এই সত্য অগ্রাহ্য করা কঠিন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইহুদিদের হাতেই এই শান্তিপ্রক্রিয়ার ভার তুলে দিয়েছিল। আর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন কর্মকর্তাকে এই কাজের জন্য বাছাই করা হয়েছিল। কারণ, তিনি মার্কিন ইহুদি সম্প্রদায়ের মতের সঙ্গে একমত পোষণ করতেন। ক্লিনটন প্রশাসনের ওপর ইহুদি ক্ষমতাবানদের যে ব্যাপক প্রভাব ছিল, তার সবচেয়ে মূর্ত বহিঃপ্রকাশ হলো ‘দখলকৃত ভূমি’কে ‘বিতর্কিত ভূমি’ হিসেবে ‘পুনঃসংজ্ঞায়িত করা’।

কিন্তু বেনভেনসিতি বলেন, পাছে তাদের সেমিটীয়বিরোধী আখ্যা দেওয়া হয়, তাই ফিলিস্তিনিরা ক্লিনটন প্রশাসনের ‘ইহুদি সংযোগ’ নিয়ে কথা বলতে পারে না। পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েলের নৃশংসতা ও দখলদারির কেবল সমালোচনা করার জন্য তাদের এখনো সেমিটীয়বিরোধী আখ্যা দেওয়া হয়। এই ভয় এখনো প্যালেস্টিনিয়ান অথরিটির সাহস কুরে কুরে খাচ্ছে। ট্রাম্পের ইহুদি জামাতা জ্যারেড কুশনার যখন শান্তি ‘দূত’ হলেন, তখন তিনি যে আরব ভূমির ঔপনিবেশিকীকরণের সমর্থক, সেটা জেনেও ফিলিস্তিনিরা তাঁকে ভদ্রভাবে স্বাগত জানিয়েছে। ইসরায়েলি গণমাধ্যমই প্রথম জানায়, মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে তিনি কতটা কম জানেন এবং কত কম মানুষ তাঁকে চেনে।

কিন্তু সেই চারজন শান্তিরক্ষীর একজন ডেনিস রস কুশনারের নিয়োগ সমর্থন করেছেন। ইসরায়েলের প্রতি পক্ষপাতের জন্য সহকর্মী ও আরবদের সমালোচনার পাত্র হয়েছিলেন তিনি। আর জ্যারেড কুশনার সম্পর্কে ট্রাম্পের ধারণার আনুষ্ঠানিক রূপটি এ রকম, ‘জানেন কি, জ্যারেড খুব ভালো ছেলে। ও ইসরায়েলের সঙ্গে এমন চুক্তি করবে, যা অন্যরা করতে পারবে না। সে স্বভাবগত মানুষ, চুক্তি করার ব্যাপারে তার সহজাত ক্ষমতা আছে। সবাই তাকে পছন্দ করে।’

রিয়েল এস্টেট খাতের বিনিয়োগকারী হিসেবে কুশনার হয়তো ‘সহজাত চুক্তিবিশারদ’। কিন্তু কেউ এটা আবিষ্কার করতে হবে ভাবেনি যে মে মাসে ট্রাম্পের সঙ্গে প্রথম কূটনৈতিক সফরে ইসরায়েলে যাওয়ার আগে কুশনারের পারিবারিক রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় ইসরায়েলের বৃহত্তম বিমাকারী ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান মেনোরা মিভতাচিম তিন কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে; নিউইয়র্ক টাইমস কদিন আগে এই খবর ছেপেছে। এই চুক্তির খবর বিস্ময়করভাবে প্রকাশ করা হয়নি। এমন প্রমাণও নেই যে কুশনার এই চুক্তিতে সরাসরি জড়িত ছিলেন। নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, এতে যে আবার ফেডারেল নৈতিক আইনের লঙ্ঘন হয়েছে, তা-ও নয়।

কিন্তু পত্রিকাটি বলেছে, জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে মার্কিন স্বীকৃতির প্রসঙ্গ বাদ দিলেও এই চুক্তি ‘মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীন দূতিয়ালির সক্ষমতা নষ্ট করবে।’ কিন্তু সেটা কীভাবে ঘটবে? নিউইয়র্ক টাইমস কি মনে করে না, কুশনার ‘নৈতিকতার ব্যাপারে খুবই আন্তরিক’। আর কুশনার যেমন মার্কিন প্রশাসনে কাজ করেন বলেই তাঁকে বৈদেশিক বাণিজ্য করা থেকে বিরত রাখা যায় না, তেমনি ‘বিদেশি সরকার ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের সঙ্গে’ এর সম্পর্ক নেই।

জ্যারেড কুশনার কোম্পানির সুবিধাভোগী, যদিও গত বছর তিনি এর প্রধান নির্বাহীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। কুশনারের আইনজীবী আব্বে ডি লাওয়েলের একটি কথা আমার দারুণ পছন্দ হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে কুশনারের বহুল প্রচারিত সফরের সঙ্গে তাঁর ব্যবসা জড়িয়ে ফেলাটা কাজের কথা নয়। এটা অনেকটা গালগল্পের মতো, যার মধ্যে বাস্তবতার ঘাটতি আছে।’ সে জন্য এটা ঠিক আছে। আর ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক মার্কিন আলোচকদের মধ্যে কেউ যদি মুসলমান হন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্টের হয়ে কাজ করার সময় তিনি যদি সৌদি আরব, মিসর বা ঈশ্বর না করুন রামাল্লা বা পশ্চিম তীরের কোনো কোম্পানির সুবিধাভোগী হন, তাহলেও সেটা নিয়ে কারও মাথাব্যথা থাকবে না, যদি তাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয় ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের জীবনে শান্তি নিয়ে আসা। আর আরব কোম্পানিগুলো যদি সেই ব্যক্তির রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে, তাহলেও কেউ হয়তো মাথা ঘামাবে না বা তাকে ‘অনৈতিক’ বলবে না। কিন্তু এটা ঠিক নয়।

সর্বোপরি নির্বাচিত মার্কিন কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আরবদের আর্থিক সহায়তার ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন, এমনকি তা যদি বিনা সুদেও দেওয়া হয়। সৌদি যুবরাজ আল-ওয়াহিদ বিন তালালের কথাই ধরুন। দুনিয়ার অন্যতম ধনী এই ব্যক্তি রিয়াদের রিটজ হোটেলের মোহাম্মদ বিন সালমানের অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি হিসেবে তোশকে শুয়ে দিন কাটাচ্ছেন। এই ব্যক্তি ২০০১ সালে ৯/১১-এর ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের পরিবারের জন্য এক কোটি ডলার অনুদান দিয়েছিলেন। তিনি ফিলিস্তিনের লক্ষ্যের কথাও বলেছিলেন, কারণ ‘সাংবাদিকেরা আক্রমণের পর থেকে বারবার সন্ত্রাসবাদ উৎখাতের ব্যাপারে প্রশ্ন করেছেন’। তিনি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝতে হবে, ‘তাকে যদি এই হাস্যকর ও ভয়ংকর জিনিসের মূলোৎপাটন করতে হয়, তাহলে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।’

তবে এই স্বতঃসিদ্ধ সত্যের ভার নিউইয়র্কের মেয়র রুডলফ গুইলিয়ানির জন্য বহন করা কঠিন। ফলে তিনি যুবরাজ আল-ওয়াহিদ বিন তালালকে দ্রুতই বলেন, তিনি যেন চেকটি নিজের কাছেই রেখে দেন। একই সঙ্গে টাকা ও রাজনীতির প্রস্তাব দেওয়া যায় না। কিন্তু এতে বোঝা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন-সৌদি বন্ধনে টাকা ও রাজনীতির সম্পর্ক কতটা সংবেদনশীল। তবে জ্যারেড কুশনারের বেলায় এসব কিছুর বালাই নেই। তিনি শ্বশুর ট্রাম্পের জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতির ঘোষণা মেনে নিলেন। আর সবচেয়ে নিশ্চিত ব্যাপার হলো কুশনারের রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে ইসরায়েলি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই!

রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্ট–এরমধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি।

প্রতীক বর্ধন অনূদিত।