ফিফা ও বিশ্বকাপ নিয়ে কিছু কথা

1550

Kamrul Hasan Nasimকামরুল হাসান নাসিম

রাশিয়া বিশ্বকাপ ২০১৮। আর মাত্র চারটি খেলা বাকী। ফিফা অত্যন্ত সফলতার সহিত খেলা পরিচালনা করার দৃষ্টান্তে গেছে। এবার তাঁদের কালো হাত নয়, শুভ্র চিন্তার নৈতিকতায় আয়োজন সারতে দেখা গেছে এখনো পর্যন্ত। যদিও খেলা শেষ হতে এখনো বড় তিনটি ম্যাচ বাকী। খুব সম্ভবত ইনফান্টিনো এই বিশ্বকাপটাকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়েছিলেন। তিনি প্রমাণ করতে চাইছেন যে, সততার সাথেও বিশ্বকাপ আয়োজন করা যায়। একই সঙ্গে বাহবা রাশিয়াকে দিতে হবে, অতি অবশ্যই ভ্লাদিমির পুটিনকেও। তাঁরা নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা দেয়ার পাশাপাশি বিশ্বকাপ আয়োজন করতে যা যা অবকাঠামো থাকা দরকার ছিল তা তাঁরা দিতে পেরেছে বলে অনুমিত হয়। একটা কথা বলা দরকার। ফিফা, খেলার আকাশে গেল ৫২ বছরে যে সকল কালো মেঘ দাঁড় করিয়েছিল এবং একটা সময় সেফ ব্ল্যাটারের কুকীর্তি যখন ধরা পড়ে যায় তখন রাশিয়া বিশ্বকাপে সেটার ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে বিশ্বে ‘নতুন ফিফা’ জন্ম নেয়ার অবকাশ ছিল বলেই রাশিয়া বিশ্বকাপ এখনো পর্যন্ত কলংক্মুক্ত হয়ে দারুণ আঙ্গিকে চলছে। যা থেকে শিক্ষা নেয়ার সুযোগ আছে। ইনফান্টিনোকে ধন্যবাদ। তবে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে ফিফার উপর। এডিডাস ও নাইকির উপর এবং এখনো পর্যন্ত উল্লেখ করি নাই— সেই বাপেরও বাপের উপর !

3বাংলাদেশে বসবাস করা ফুটবল ভক্তদের জন্য ইতোমধ্যে নতুন কিছু বলার প্রাণান্ত চেষ্টায় গেল তিন বছর ধরে আমি ও ক্রীড়ালোক থেকেছি। ফুটবলের পেছনের শক্তি ইস্যুতে এমন লিখিত ধারাভাষ্য টানা চার বছর চলতে থাকবে। যাতে করে ২০২২ সালের বিশ্বকাপে আমরা সবাই কোয়ালিটি দর্শক কিংবা ভক্ত হতে পারি। আজ আমি আরেকটি বিষয়ের উপর আলোচনা করছি। যা বলা শুধু দরকার নয়, অতি প্রয়োজন।এতে করে দেশের অবুঝ ভক্তকূল নতুন একটা চিন্তা শক্তির খোরাকে ভেসে যেতে পারে। ফলশ্রুতিতে তাঁরা যেন ফুটবল বোদ্ধা হতে পারে। আর যারা ফুটবলের বিচক্ষণ দর্শক হিসাবে আছেন তাঁরা আরো খানিকটা পরিণত চিন্তায় পরিবেষ্টিত হওয়ার সুযোগ গ্রহণ করতেই পারে। যৌক্তিক কারণে তাই আজ তেমন উদাহরণে যেয়ে যুক্তি ও বক্তব্য তুলে ধরার প্রয়াসে থাকছি।

আচ্ছা, বিশ্বকাপ ফুটবলকে শ্রেষ্ঠ বলার যৌক্তিকতা কি ? কেনই বা বিশ্বকাপ ফুটবলের মাধ্যমে কোন বিশেষ বিশেষ দেশকে শ্রেষ্ঠ বলতে হবে ? কেন কাপ জয় করা দুই একজনকে সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় বলে মেনে নিতে হবে ? কী, কেমন কেমন লাগছে না ! লাগুক, তবু চলেন আলোচনাটা সারা যাক। তবে আজকের লেখাটা দেশিয় নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যাওয়া দরকার বিধায় এটির ইংরেজি ভার্সন পাওয়া যাবে।

4সারাবিশ্বের অতি উচ্চ পর্যায় হতে শুরু করে বাংলাদেশও ফুটবল খেলা সারা বছর চলে থাকে। উচ্চ পর্যায় টা কী ? হয়তো সেই উত্তর প্রচলিত রীতি অনুযায়ী উয়েফা বলবে, তোমরা বোঝ না ? আমাদের লা লীগা, বুন্দেসলীগা, সিরি আ, লীগ ওয়ান দেখো না তোমরা ? তোমরা কি মুড়ি খাও ? তোমরা বুঝতে পারো না যে ইউরোপে খেলার জন্য তাবৎ পৃথিবীর উন্নত খেলোয়াড়েরা অপেক্ষারত থাকে। তাঁরা এখানে অস্বাভাবিক, অকল্পনীয় ফুটবল খেলে যেমন অর্থ পেয়ে নিজেরা সুখী হয়, আর আমরাও তেমন সুখী হই, স্বস্তিতে থাকি– কি দিচ্ছি না আমরা ফুটবলের জন্য !

খেলা ইউরোপের গ্রীসেও হচ্ছে, সুইস লীগও আছে, চমৎকার লীগ ও অন্যান্য আসর আছে ইউরোপের সব দেশে। পর্তুগালের বেনফিকারাও বলছে তাই, লীগ হিসাবে আমাদের দিকেও তাকাও। আমাদের ৫টা দলকেও সুযোগ দাও উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ খেলতে দিতে ! লাভ নেই। অতি প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এখনেও গ্রেডিং আছে। একেক লীগের একেক মর্যাদা। এই ইউরোপের দেশসমুহের একটা হয়ে হঠাত করে গ্যালাটেসারাই এসেও বলবে, কী রুমানিয়াকে পছন্দ হয় না ?

কথা সংক্ষিপ্ত করি। ইউরোপের প্রায় ২৩টি দেশের শীর্ষ ফুটবল লীগকে ছোট করে দেখার ফলত সুযোগ নেই। অথচ আমরা রাত জেগে কয়েকটা লীগ পরখ করার সুযোগ পাচ্ছি। এসব লীগে ইউরোপ, ল্যাটিন, আফ্রিকা, কনকা থেকে– এমন কি এশিয়া থেকেও দুই একজন খেলার সুযোগ পাচ্ছে। সারাবিশ্বের মিডিয়া সারাটা বছর স্পেনের লা লীগার খবর পরিবেশনে সচেষ্ট থাকে— ওখানে যে গেল ৮/৯ বছর ধরে ফুটবলের দুই অতি জনপ্রিয় রোনালদো আর মেসি খেলেন ! সবাইকে ছাপিয়ে তাই লা লীগা। ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগও সেই রকম জনপ্রিয়। একসময় ছিল ইটালির সিরি আ । তাহলে ইউরোপের লীগ এবং তাঁদের সেরা দল নিয়ে প্রত্যেক বছর যে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ হচ্ছে তাঁর মানকে অতি উচ্চ পর্যায়ের বলা হচ্ছে। না বলার সুযোগও আসলে নেই। তাই অনেক সময় বিশ্বকাপ জিতিয়েও কোন খেলোয়াড় ব্যালন ডি ওর পর্যন্ত পাচ্ছে না। কারণ, আকস্মিকভাবে নিজ দেশের হয়ে বিশ্বকাপ খেলতে যেয়ে দেশের হয়ে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহ( বিগত ৮/৯ মাস তিনি ক্লাব ফুটবল নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন) নিয়ে ৭টা ম্যাচের ফলাফলের উপর নির্ভর করে ভাগ্যের উপর জিতে যাওয়া বা হেরে যাওয়া খেলোয়াড়ি সত্তাকে বিশ্বসেরার বলার সুযোগ কোথায় ? তা সে কোন দেশ হোক কিংবা খেলোয়াড় হোক। হ্যাঁ, ব্রাজিলের পেলের ব্যাপারটা আসলেই আলাদা ছিল। নিজের ঘরের স্যান্টোসের হয়ে গোল মেশিন হয়ে ওঠা তার একটাই লক্ষ্য ছিল সব দেশের অংশগ্রহণে হওয়া বিশ্বকাপের উপর। কারণ, তিনি ইউরোপে তো খেলেন নি। বড় ক্লাবে যেয়ে আজকের মেসিদের মত করে প্রতি মওসুমে ৫০টা গোল করার চ্যালেঞ্জ ছিল না। তিনি লোকাল হিরো যেমন ছিলেন, হয়েছিলেন বিশ্বসেরাও ! কারণ, সারা বছর তাকে সেরার সেরা হওয়ার জন্য লড়তে হয়নি। চার বছর সময় পেয়েছেন। এরপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। উপরন্ত তার চেয়েও ভাল খেলোয়াড় তার স্কোয়াডে থাকাই তার জন্য অনেক কিছু সহজ হয়ে যায়। আজ যেমন একজন ক্রিশ্চিয়ানো কে লীগের কথা চিন্তা করতে হয়, মেসিকে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ নিয়ে চিন্তা করতে হয়— দুই তিন ম্যাচে গোল না পেলেই আমরা কলম ধরে ফেলি যে, এই বুঝি তাঁদের দিন শেষ হয়ে আসছে ! আর তখনই মধ্যরাতের খবর, রোনালদোর অভিনব হ্যাট্রিকে রিয়েলের জয় অথবা মেসিযাদুডটকমের সংবাদ, মেসি যাদুতে বার্সার দারুণ বিজয় ! অর্থাৎ তাঁদের প্রতি সপ্তাহে নিজেদের প্রমাণ করতে হয়। লীগের ৩৮টা ম্যাচ, কোপা ডেল রের মত আসরে অন্তত ৬টা ম্যাচ আর উয়েফায় ১০টা ম্যাচ খেলার বছরজুড়ে এই অবিরাম ফুটবল খেলার জন্য সামর্থ্য থাকতে হয়। এর উপর প্রতি ম্যাচ ঘিরেই প্রত্যাশার চাদর। সে চাদরে ঢেকে ঘুমিয়ে থাকা যায় না। উপরন্ত দেশের হয়ে বছরে অন্তত ৭ থেকে ৮ ম্যাচ তো থাকেই।6

পাঠকবৃন্দ একবার ভাবুন তো যারা চারটা ফুটবল মৌসুমের ৩৬টা মাস নিজের শ্রেষ্ঠত্বের জন্য লড়ে, এখনো পর্যন্ত গেল দশ বছরে ৬০০-৫০০ গোল করছে সারাবিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া লীগ ফুটবলে বা অন্য মাত্রার আসরে— তাঁদের চেয়ে পেলে কিংবা ম্যারাডোনা কেন বড় হবে ? হয়তো বলবেন, পেলে তো এক হাজারের বেশী গোল করেছে ! হ্যাঁ, করেছেন। কা’দের বিরুদ্ধে? দেশের হয়ে ৭৭ গোল করেছেন। আর বড়দের বিরুদ্ধে ক্লাব পর্যায়ে আরো ৫০টা গোল আছে তাঁর। আর সব গোল তাঁর নিজের ক্লাবের হয়ে, পাড়ায় মাঠে গোল করাটাকেও হিসাব করেছেন তিনি। সব কিছু তো গোল দিয়ে বিবেচনা হয় না। তাও জাত দল বা ক্লাবের বিরুদ্ধে হলেও কথা। পেলের খেলার মান টা দেখুন। ইচ্ছে করলেই ইউটিউবে ঢুকে তাঁর সবকিছু দেখতে পারবেন। আমার মনে হয় উত্তর পেয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ঠ।

ম্যারাডোনা এক সৃষ্টিশীল খেলোয়াড়। দেশ বিবেচনায় নেতৃত্বের দিক বিবেচনা করলে, ক্লাব পর্যায়ে দুই থেকে তিন মওসুমের কথা চিন্তা করলে, নক আউট রাউন্ড নামক খেলা চিন্তা করলে দেশের হয়ে এমন খেলোয়াড় পৃথিবীতে এখনো পর্যন্ত দেখা যায় নাই। কিন্তু ম্যারাডোনা গোল মেশিন ছিলেন না। তাঁর চেয়ে স্বদেশী স্টেফানো ও আজকের মেসি এদিক দিয়ে যোজন যোজন এগিয়ে। মেসির মত চাপ তাঁর উপরে ছিলও না। মেসিকে এক রাত পরেই লড়তে হয়। ক্রিশ্চিয়ানো না জানি কাল রাতে কী করে বসেছে ! এটা ম্যারাডোনার ব্যাপারে ছিল না। হ্যাঁ, প্লাটিনি ও জিকো তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী থাকলেও দুর্বল স্কোয়াডের এক দেশ আর্জেন্টিনাকে তিনি যখন কয়েকটা গুটি কয়েক ম্যাচে ধারাবাহিকভাবে ভাল খেলিয়ে বিশ্বকাপ জিতিয়ে দেন— তখন হতেই পেলের সাথে তাঁর তুলনাটা চলে আসে। যেহেতু ১৯৫৮ ও ১৯৬২ সালের বিশ্বকাপে গারিঞ্চাই ছিল ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক— সে কারণে পেলে ঝামেলায় পড়ে যায়। তাঁর সম্বল ছিল হ্যাভেল্যাঞ্জের গিফট করা ১৯৭০ সালের জুলেরিমে ট্রফি ! কিন্তু ম্যারাডোনা আবারো ১৯৯০ এবং ১৯৯৪ সালের জন্য তৈরি হতে থাকেন। যৌক্তিক কারণেই ম্যারাডোনার সাথে সমসাময়িক নয়, পেলের মত ল্যাটিনের পূর্বসূরীর সাথে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়েছিল। ভাগ্যও ছিল ম্যারাডোনার। সেটা না হলে ১৯৯০ সালে একের পর এক ম্যাচে টাইব্রেকারে জিতে যাচ্ছিল কেন তাঁর দেশ ! কিন্তু খেলোয়াড়ী জীবনে তিনি কি মেসির চাইতে বড় ক্যারিয়ার নিয়ে বসবাসে ছিলেন। হ্যাঁ, ন্যাপোলিকে জিতিয়েছিলেন। বার্সা ও বোকা জুনিয়রে খেলেছেন। দারুণ খেলেছেন। কিন্তু প্রতি মওসুমে ৫০ টা গোল করে অতি মানবিক চরিত্র হতে হয়নি। ৪ বছরের ৩৬( প্রতি মওসুমের ৯ মাস) মাসে প্রতিটা অহোরাত্রে চ্যালেঞ্জ ছিল না। কাজেই জিনেদিন জিদান যদি বলে বসেন, আমি আর ম্যারাডোনা কেও কারো চেয়ে কম নই। এমন কী আমাদের দু’জনার পেলের চেয়ে বল দখলে রাখার ক্ষমতা বেশী ছিল। আমরা দুই জনাই একবার করে নিজ দেশকে বিশ্বকাপে জিতিয়েছি। একবার করে আমরা উভয়েই দেশকে ফাইনালে নিয়ে গিয়েছি। তাহলে ?সর্বকালের সেরা নির্ধারিত হওয়ার রায় কে দিবেন? বিশ্বকাপ ট্রফি দিবে?

রোনালদো নাজারিও তো পেলের মৃত্যুর পর বলতে পারেন, আমি বিশ্বকাপ জিতিয়েছি একবার। আরেকবার দেশকে ফাইনালে তুলেছিলাম। আমি পেলের চেয়ে বড়। কী বলার আছে ! তিনি বললেন, পেলে তো তিনবার বিশ্বজয়ী স্কোয়াডে ছিলেন–এটা সত্য। কিন্তু খেলেছে তো গারিঞ্চা ও রিভেলিনোরা। আমিও তো ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ স্কোয়াডে ছিলেম ! এই রোনালদো তাঁর খেলোয়াড়ি জীবনে আর কি করেছেন? যেখানে ক্রিশ্চিয়ানো ও মেসিরা খেলছে ১৪/১৫ বছর ধরে। আর বিশ্বসেরা হয়ে ১০ বছর— রোনালদো নাজারিও কি তা করতে পেরেছেন? ইনজুরি ও ফিটনেস সমস্যা তাঁকেও দুই তিনটা মওসুমে ব্যতিরকে কয়েকবছর ধরে সেরা করে রাখতে পারে নাই। সে কারণেই জিদান, ফিগো, রোনালদিনহো ও তাঁর মধ্যে ব্যালন ডি ওর ভাগাভাগি হয়েছে। লক্ষ্য করে দেখুন। তিনি অবিসংবাদিত হয়ে শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে পারেন নি। বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল কিংবা বুট জয় করা খেলোয়াড়কে তাহলে সর্বকালের সেরা বলবেন কিভাবে? এখানেই উত্তর রয়েছে। ব্যালন ডি অর— তোমার শ্রেষ্ঠত্ব নির্ণয়ের আধুনিক সমাধানপত্র হয়ে পাশ করার ঠিকানা ! তোমাকে সারা বছর ভাল খেলতে হবে। যত বছর খেলবে— সবচেয়ে বেশী ব্যালন যার কাছে , তিনিই শ্রেষ্ঠ হবেন। সর্বকালের সেরা হবেন।

এই প্রসঙ্গেই একদিন পেলে বলছিলেন, আমি ইউরোপে খেললে ব্যালন আমিও ৫/৬টা জিততাম। এটা তিনি জোর করে বলেছেন। ‘যদি’ দিয়ে শ্রেষ্ঠ হওয়া যায় না। সে সময় ১৯৫৮ সাল হতে ১৯৭০ সালের দিকে তাকালে স্টেফানো, পুস্কাস, গারিঞ্চা, ববি চারল্টনেরা কেও কারো চেয়ে কম ছিল না। গভীর বাস্তবতায় গেলে ১৯৫৮ সাল হতে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ব্যালন তাঁর জন্য প্রযোজ্য থাকলে তিনি তিনজনের নামের তালিকায় আসতে পারতেন না। এরপরে ১৯৬৬ সাল হতে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত যদি ধরা হয় ওই চার বছরে তিনি কী বেকেনবাওয়ার,জর্জি বেস্ট, ইউসেবিওর চেয়ে ক্লাব পর্যায়ে বড় ছিলেন ? ব্যালন তখন ওই তিনজনের মধ্যে ভাগাভাগি হত। বাস্তবতায় থাকলে তিনি ১৯৭০ সালের ব্যালন জয়ী খেলোয়াড় হতে পারতেন। সেটা তখন ওঠে গার্ড মুলারের কাছে। অথচ তিনবারের বিশ্বকাপজয়ী দেশের হয়ে সর্বকালের সেরা হিসাবে হ্যাভেলাঞ্জেরা ক্যাম্পেইন করেছে বলেই তিনি ‘পেলে’। যেটা আক্ষরিক অর্থে কথিত হয়ে পড়ার জন্য যথেষ্ঠ। পেলে তো স্ট্রাইকার ছিলেন। তিনি কী কোন বিশ্বকাপের টপ স্কোরার হতে পেরেছিলেন? ১৪ ম্যাচে ১২ গোল করেছেন। তাহলে একটু ভাবুন। ১৪ ম্যাচ খেলে তিনি সর্বকালের সেরা ? এটা হাস্যকর। তাঁকে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ খেলতে হয় নি। যেখানে ইউরোপের ক্লাবগুলোকে শীর্ষ ৫-৪-৩-২–১টার হতে হয়। এরপর গ্রুপ পর্ব শুরু হয়। নিজেদের মাঠে। পরের মাঠে। দ্বিতীয় রাউন্ড, কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমি ফাইনাল দুই লেগে খেলে ফাইনালে যেতে হয়। অর্থাৎ এক মওসুমে ১৩টা ম্যাচ খেলে উয়েফা জিততে হয়। আর তাঁরা সারা জীবনে ১৪ ম্যাচ খেলে সর্বকালের সেরা হয়ে যাবেন— এটা কল্পনা করাও পাপ। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোদের তাহলে ৩৯ ম্যাচ খেলে হ্যাট্রিক শিরোপা পেতে হয়েছে। খেলার মানের প্রশ্ন ? ওখানে বিশ্বসেরা খেলোয়াড়েরা ক্লাবের হয়ে জীবন দিয়ে খেলেন। ভাল খেললেই টাকা আছে, সেটা না হলে বিদায় করে দেয়া হয় পরের মওসুমে।

অন্যদিকে ম্যারাডোনার কথা বললে দেশের হয়ে ৩৪টা গোল করেছেন। বিশ্বকাপে ২১ ম্যাচে করেছেন ৮ গোল । ধরে নেয়া যেতেই পারে তিনি প্লে মেকার ছিলেন। কিন্তু টানা সাড়ে তিনটা বিশ্বকাপ খেলে ৮ গোল ও এসিস্ট করে তাঁকে সর্বকালের সেরা বলতে হবে কেন? ন্যাপোলিকে দুইবার লীগ টাইটেল জেতানো এবং একবার উয়েফা জেতানো ম্যারাদোনার ক্যারিয়ার লিও মেসির চেয়ে বড় হয় কিভাবে ? হ্যাঁ, ম্যারাডোনা হয়তো মেসির চেয়ে মানসিকভাবে শক্তিশালী। নেতৃত্বের বিরাট একটা দিক তাঁর চরিত্রে ছিল। ব্যালনও তিনি অন্তত ৮৬, ৮৮, ৮৯ সালে পেতে পারতেন। হিসাবে তিনি ৩টি ব্যালন পান। যদি তাঁকে অতি বড় করে দেখতেও হয়। পেলের চেয়ে দুটি বেশী। তবে কথা আছে। সে সময় ইউরোপে বাস্তেন ও গুলিত ছিল অতি সেরা পর্যায়ের ফর্মে। তাঁরাই তখন ইউরো শাসন করেছিল। কাজেই ম্যারাডোনাও প্রকারন্তরে ওই একটা ব্যালনই পাওয়ার যোগ্য। তা ওই ১৯৮৬ সালে কাপ জিতিয়ে। ম্যারাডোনা মেসির মত অনেক গোল করেন নি জীবনে তবে অধিনায়কত্ব এবং কিলিং পাস দিয়ে কার্যকরী ভুমিকা রেখে হয়তো মেসির চেয়ে তিনিই সেরা তবে সর্বকালের সেরা হতে পারেন না। জর্জি বেস্ট সে কারণেই বলতেন, ম্যারাডোনা বেশ ভাল, পেলে যাচ্ছেতাই কিন্তু আমার সাথে তুলনা করেন নিরপেক্ষভাবে— আমিই সেরা !

4এদিক দিয়ে জিদান, বেকেনবাওয়ার, ইউসেবিও, প্লাটিনি, ক্রুয়েফ, রোনালদো নাজারিও বরং সম্মান দেখিয়েছেন পেলে ও ম্যারাডোনার প্রতি। তাঁরা কেহই একক ভাবে সেরা তা বলেন নি। কিন্তু পুস্কাস বেশিদিন ধরে বাঁচলে তা কী মানতেন ? তথ্য ও প্রযুক্তির যুগে ঠিকই মুখ খুলতেন তিনি। তিনিও তো পারেন নি হাঙ্গেরিকে ফাইনালে উঠিয়ে বিশ্বকাপ জিততে ! জর্জি বেস্ট তাই চুপ থাকেন নি। বলেছেন, বিশ্বকাপ জিতলেই আমার চেয়ে বড় হয়ে গেল ? আর আজকের ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো তো বলেই দিয়েছেন, ইতিহাসে আমার চেয়ে কোন বড় খেলোয়াড় আসেনি। আমার চেয়ে ভাল খেলতে কাউকে দেখিনি।

এক বিশ্বকাপ খেলে গার্ড মুলারেরা , ফন্টেইনেরা, শিলাচিরা কিংবা লিনেকার কী বলতে পারবেন, তিনিই ইতিহাসের সেরা স্কোরার। পারবেন না। ৭টা ম্যাচের মধ্যে কয়েকটা ম্যাচের ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়ে বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হয়ে গিয়ে তাঁকে সর্বকালের সেরা বলার যৌক্তিকতা কী? এটা চার বছর পর হয়। হ্যাঁ, বিশ্বকাপের এক বছর আগ হতে বাছাই পর্ব খেলতে হয়। সেখানে ল্যাটিনে তো তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই । ১০টা দেশ খেলছে। দুর্বল ৫টা বাদ যাবে, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা নিয়মিত খেলবে। আর একটা কোটা বাড়ালে হয়তো এবার চিলির মত দেশ বাদ পড়ত না। বরং ইউরোপ থেকে কোয়ালিফাই করে আসুক না ! ইটালি, হল্যান্ড , বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, হাঙ্গেরিদের তো দেখতে পারলাম না এই বিশ্বকাপে। ইউরোপের এমন আরো ১০টা দেশ আছে যারা বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা রাখে। তাহলে পেলে ও ম্যারাডোনাদের কষ্ট করতে হয়নি। বাছাই পর্ব আছে ঠিকই– সেটা ইউরোপে কঠিন। এবার যেমন পোল্যান্ডের লেভা ও পর্তুগালের রোনালদো ১৫টা গোল বাছাই পর্বে করে বিশ্বকাপে এসেছিল। এটার গুরুত্ব অনেক। কা’দের বিরুদ্ধে খেলছে সেটা দেখার দিক আছে। আমিতো মনে করি, বিশ্বকাপে সেরা গোলদাতা হিসাবে বাছাই পর্বের গোল কাউন্ট করা উচিত। নতুন একটা সূত্র দিলাম। একটা দেশ অনেক কাঠখড় পেরিয়ে বিশ্বকাপে আসছে। সেই খেলাগুলোকে গুরুত্ব না দেয়ার কী আছে ? সেটা বিশ্বকাপের অংশ। অবিচ্ছেদ্য অংশ !

অনেক আগেই বলেছি, মহাদেশ ভিত্তিক বাছাই পর্ব ঠিক নয়— প্রত্যেকটি ফিফা দেশের ক্যালেন্ডার তিন বছরের জন্য নির্ধারিত করা হোক। একটা নির্দিষ্ট তারিখ পর্যন্ত। যেমন, ২০২২ সালের বিশ্বকাপ। সেটার জন্য ধরুন ২০২১ সালের ডিসেম্বর ৩১ পর্যন্ত শিডিউল। এই তিন বছরে মোট ২৭ টা খেলা তাঁদেরকে খেলতে হবে। প্রত্যেক বছরে ৯টা করে আন্তর্জাতিক ম্যাচ। এশিয়ার দেশ শুধু এশিয়ার সাথে খেলবে এমন নয়। তাঁরা এশিয়া এবং ল্যাটিন, ইউরোপ, আফ্রিকা, কনকার দুটো দেশের সাথে লড়বে তখন। আর একটা ম্যাচ লটারিতে নির্ধারিত হবে।সেটা অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের সাথে পড়তে পারে বা যেকোন মহাদেশের সাথে। আবার অন্য একটি বছরে এভাবেই অন্যান্য পৃথক দেশের সাথে লড়বে। লটারি ভিত্তিক ফিকচার করে ম্যাচ জয়ের উপর র‍্যাংকিং উঠানামা করবে। ওই ৩১ ডিসেম্বর ২০২১ সালে নির্ধারিত হবে কারা আছে শীর্ষ ৩১ দলের মধ্যে। স্বাগতিক কাতার সহ তখন ওই ৩১টি দেশ বিশ্বকাপে চলে যাবে। এতে করে বিশ্বকাপে কোয়ালিটি দেশ সমূহকে দেখতে পারা যাবে। প্যানামা, সৌদির আসা তখন নিশ্চিত হবে না। আর এখন বাছাই পর্বে বড়দেশগুলোর মধ্যে ইউরোপ ঝুঁকিতে থাকছে। সেটা কিভাবে হয় ? এই পন্থায় বলা বাহুল্য যে, ফিফা র‍্যাংকিং এর প্রথম ১২০টা দেশ রেখে বাকী ৮০টা দেশকে প্রাক বাছাই পর্ব খেলাতে পারে মহাদেশীয় ভিত্তিক । সেটা না হলে আমাদের বাংলাদেশের খেলা যদি এখন জার্মানির সাথে পড়ে — বিষয়টা কেমন দাঁড়ায় ! যদিও এমন পদ্ধতি ফুটবলের সব দেশকে উজ্জীবিত করবে। তাঁরা তখন ইউরোপ- ল্যাটিনের দেশগুলোর সাথে খেলতে জীবন দিয়ে ফুটবল খেলার মানসে যাবে। প্রত্যেকটি দেশের ফেডারেশন নড়েচড়ে বসবে। আমাদের কাজী সালাহউদ্দিনদের তখন আর মেয়ে আর মদ নিয়ে পড়ে থাকার সুযোগ নেই। বন্ধ হয়ে যাবে।

আলোচনায় ছিল বিশ্বকাপে এসে হাতে গোনা কয়েকটা ম্যাচ খেলে বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হয়ে বা গোল্ডেন বুট জিতে সর্বকালের সেরা কিভাবে হতে পারেন? বছর জুড়ে প্রত্যেকটা দিনে যেখানে ইউরোপ জুড়ে, ল্যাটিন জুড়ে ক্লাব ফুটবলের আয়োজন— সেটায় তুমি কি করতে পারছো? ওই সকল দিক বিবেচনা করলে এবং খেলার মান নিয়ে চিন্তা করলে স্টেফানোর পরে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ও মেসি ক্লাব ফুটবলে সফল হওয়া চরিত্র। কারণ তাঁরা বারো মাসের অতি প্রতিভা। জিদান ও ম্যারাডোনা প্লে মেকার ছিলেন। গোল পান নি তেমন। কিন্তু দুইজনাই দেশ ও ক্লাবের হয়ে অনেক কিছু দিয়েছেন। অন্যদিকে মেসি এক পয়েন্টের খেলোয়াড় হয়েও প্রতিপক্ষ কোচেরা ও খেলোয়াড়েরা তাঁকে নিত্য রুখায় ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি প্লে মেকার ও গোল মেশিনও। হয়তো মেসি এই জায়গায় জিদান কে হারাবেন তো বটেই, ম্যারাডোনাও চাপের মুখে পড়ে যায়। তবে ম্যারাডোনার বড় কিছুতে সামর্থ্য থাকায় তিনি মেসিকে পিছু ফেলবেন। তবে ক্রিশ্চিয়ানো কে বড় করে দেখতে হবে। তিনি একসময় ছিলেন প্লে মেকার, ইলেক্ট্রো ড্রিব্লার— এখন গোল মেশিন। তিনি এই কারণেই বলতে পেরেছেন, তিনিই সর্বকালের সেরা। জীবনে আরো কত গোল করবেন বলা মুশকিল। দেশের হয়ে করেছেন ৮৫টি গোল। অনেকেই বলেন ম্যাচতো বেশি খেলেছে। কিন্তু রোনালদো তো ক্যারিয়ারের শুরু দিকে প্লে মেকার ছিলেন। সেটা ভুলে যাচ্ছেন? মেসির চেয়েও গোল করায় সে এগিয়ে। তা সে জাতীয় দল হোক কি ক্লাব ফুটবলে হোক। জর্জি বেস্ট, পুস্কাস ও ইউসেবিও পেলের চেয়ে বড় ছিলেন। ছিলেন গারিঞ্চাও পেলের চেয়ে বড়। তবু এই তর্ক থাকবে। তবে বিশ্বকাপে ভাল খেলে ওয়ান টাইম সেরা ফুটবলার হয়ে সর্বকালের সেরা কিভাবে হয় তা আপনারাও নির্ণয় করুন।

চলুন, বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন আর বিশ্বচ্যাম্পিয়নের মধ্যকার পার্থক্যটা বুঝে আসি। চার বছর পর ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে বড় উৎসব। সেটা বিশ্বকাপ ফুটবল। কাপ জিতলেন। হয়ে গেলেন বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু ফিফা র‍্যাংকিং এ পাঁচেই রয়ে গেলেন। পরের ছয় মাসে হারতেই থাকলেন আন্তর্জাতিক অন্যান্য আসরে কিংবা ফ্রেন্ডলি ম্যাচে অংশ নিয়ে। র‍্যাংকিং বাড়লো না। অর্থাৎ ৫এ থাকলেন কিংবা ৬-৭ এ নেমে আসলেন। টাইটেলটা জুটবে তখন ২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন। ইংরেজিতে বললে, রাশিয়া ওয়ার্ল্ড কাপ চ্যাম্প ! যারা এক নম্বরে থাকবে তখন তাঁরাই সেই মাসের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। তা যদি টানা দুই বছর ধরে থাকেন— কথাই নেই। তাঁরাই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। এর অর্থ এই নয় যে যারা বিশ্বকাপ জিতলো তাঁরাও এক নম্বর দেশ হয়ে ফিফা র‍্যাংকিং এ যেতে পারবে না। ধরুন তাঁরাই চলে গেল। থাকলো প্রায় তিন বছর। তখন তাঁরাই বিশ্বকাপ ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। তুমি বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবে এমন কোন কথা নেই। এখানেও সেই ৭ ম্যাচের উদাহরণ দিতে হচ্ছে। সারা বছর জুড়ে তোমার দেশের ছেলেরা বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে খেলে জীর্ণ অবস্থায় থেকে যে বিশ্বকাপটায় ক্লাব মওসুম শেষ করে খেলতে আসে এবং ভাগ্য ও দলের মধ্যকার উপস্থিত সমন্বয়ে যখন বিজয়গুলো তরান্বিত হয়— সেটাকে খুব করে বড় হিসাবে দেখার সুযোগ নেই। বরং এটা পরিকল্পিত ফুটবল নয়। দিনের পর দিন এক বছর জুড়ে একসাথে থাকার মাধ্যমে এই ‘টিম’ টা হয় না কিন্তু। একরকম জোর করে অতি প্রতিভাবানদের নিয়ে শুরু করা। কাজেই এই আসরে জিতে সর্বকালের সেরা ফুটবল খেলুড়ে দেশ হওয়া যায় না। ব্রাজিল একাধিকবার সাফল্য পেয়েছে অতীতে— সেটার সবিশেষ কারণ ছিল। তাঁদের খেলোয়াড়েরা ইউরোপে যেয়ে তখন খেলত না। নিজ দেশে প্রস্তুতি নিত বিশ্বকাপ জিতব বলে ! সাথে পেয়েছিলেন বিশ্ব চোর জোয়ান হ্যাভেলাঞ্জকে। আরো পরে ব্ল্যাটারদের। কী করেনি তাঁরা ? আর অন্যদিকে এডিডাসের কল্যাণে জার্মানির ফুটবল সাফল্য। এক সময়কার ফুটবল মাফিয়ার জন্যই ইটালির বিশ্বকাপে ফুটবল অন্য মাত্রার প্রভাব। তবে ঘুরেফিরে সেই সাত ম্যাচ। সেটা আনমনে আবার ছোট্ট মেয়াদী পরিকল্পনা করে জেতা যায়।এটা বড় কিছু নয়। বহুজাতিক সংস্থা, দীর্ঘ সময় জুড়ে ফিফার দুর্নীতি,দুষ্টু দিক ফুটবলের পেছনের শক্তি পুঁজিবাদের গোপনকক্ষকে অবৈধ কোষাগার করেছে ঠিকই— কারণ, বাপেরও বাপ আছে এই ফুটবলে। এই বাপেরও বাপ কারা সে শীর্ষক একটা লেখা আমি বিশ্বকাপের পরেই লিখব।

বিশ্বকাপে কয়েকবার করে ট্রফি নেয়ার মধ্যে তাঁদের প্রতি গভীর প্রেমে মগ্ন হওয়ার দিক নেই ফলত। এখানে নোংরামী অতীতে ছিল আর ৭টা ম্যাচের সমসাময়িক ফিকচার সব সময়ের জন্য সেরা কোন দেশকে বা ব্যক্তিকে করে না। এটা বরং আকস্মিক সাতটা টি টুয়েন্টি ম্যাচ। ছক্কার ফুলঝুরি দেখেই আমরা চার বছর ধরে মনে রাখি। এর বাইরে কিছু নয়। সারা বছর পারফর্ম করা সেই স্টেফানোর রিয়েল কে জেতানো, পুস্কাসের অদম্য দিক, ন্যাপোলির হয়ে ওই ম্যারাডোনা, ম্যানচেস্টার ইউনাটেডের হয়ে জর্জি বেস্ট, জুভেন্টাসের হয়ে জিদান অনন্য মানের ছিলেন। তাঁরা শুধু বিশ্বকাপের টি টুয়েন্টি ম্যাচ নয়– লীগ খেলে, উয়েফা খেলে টেস্ট ম্যাচ খেলে গেছে। আর আজকের রোনালদোরাই সর্বকালের সেরা। ঘুম থেকে উঠে মেসি পুত্র মাতেও যখন জানান দিচ্ছে, বাবা কাল রাতে রোনালদো হ্যাট্রিক করেছে — পরক্ষনেই মেসি একটু তাকিয়ে শপথ করে বসে আজ ন্যু ক্যাম্পে জ্বলে উঠতেই হবে। অন্যদিকে ক্রিশ্চিয়ানো জুনিয়র কটাক্ষ করে যখন বলে, মেসি কাল রাতে খুব ভাল খেলে জিতে গেছে ! রোনালদো বলে, বাবার সাথে কাউকে তুলনা করতে যেও না, আমাকে রাগিও না— রাগালেই জানো আমি জাল ভেদ করে শরীর দেখিয়ে বুনো উল্লাসে মেতে উঠি !

এই লড়াই যখন ৩৬৫০ দিন ধরে তাঁদের মধ্যকার চলছে সেখানে তাঁরা দুইজন মিলে ৮ টা দিবস ( ২০০৬-২০১৮) ফ্লপ করলেই পেলে কিংবা ম্যারাডোনা বড় হয়ে যায় কি ? ব্রাজিলের সাফল্য রহস্য, জার্মানির এডিডাস ভাগ্য, ইটালির ফুটবল মাফিয়া, স্পেনের নব্য মাফিয়া হয়ে পড়া, আর্জেন্টিনার সামরিক জান্তার হস্তক্ষেপ, উরুগুয়ের অপরিণত আয়োজনের দুটো বিশ্বকাপ ট্রফি জয়, ইংল্যান্ডের মহাচুরির বিশ্বকাপ জয় ও মিশেল প্লাটিনির উদ্যোগে ফ্রান্সের চুরি করা বিশ্বকাপ জয় করা নিয়ে কার্যত উচ্ছ্বাসের কিছু নেই। বরং ১৯৮৬, ১৯৯৪ সালের পর এখনো পর্যন্ত রাশিয়া বিশ্বকাপ খুব স্বচ্ছ করে এগোচ্ছে। যারা টিকেছে খেলছেও বেচারারা উজাড় করে। উপভোগ করার মত। বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স আর ক্রোয়েশিয়া। ওরাও বলছে, আয় সেরাটা করি। সামনে লিওও নেই, নেই ছয় ফুট ২ ইঞ্চির ওই ক্ষ্যাপাটে পাগলা ক্রিশ্চিয়ানোও !

লেখক: প্রধান সম্পাদক, ক্রীড়ালোক।