পেহেলগাম…

1298
  • স্নিগ্ধা বাউল

আগের রাতে যখন জ্বলছিল সবুজ অন্ধকার পাহাড়, আমরা খুলে বসি ব্যক্তিগত জীবনের ঝা্ঁপ। রাত পোহাতে এদিন বেশি দেরীই হলো। সকাল নটায় বাইরে এসে চোখ চড়কগাছে।আমাদের রিসোর্টের পিছনেই যেন ব্যক্তিগত ঝর্ণা। বড় বড় পাথরগুলো বেয়ে জল যখন নামছে একটানা এক ছন্দধারা। এদিকে হালকা রোদ এবং বাতাসের এক একটা ছটা। ঠাণ্ডাটা বপশ উপভোগ্য। রোদে পিঠ পেতে অবাক তাকিয়ে থাকা আমাদের, এবং চাইলেও আপনি নির্বাক হবেনই হবেন। প্রকৃতির এটাই হয়তো খেলা, এক কথায় তব্দা। কিছু ডাকাডাকিতে আমাদের সম্বিৎ হলো; রিসোর্টের বাইরে কাঁটাতার ধরে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি ছেলে, এবং তাদের পরনে সেই ফিরান। রাতে এই পোশাকের জন্যই তাদের আমরা ভয় পেয়েছিলাম। এরা সবাই ঘোড়ার মালিক। পর্যটকদের কাছাকাছি এরা নানা তথ্য নিয়ে আসবেন।

s4এবার বের হবার পালা। আজ সারাদিন আমাদের হাতে। যদিও ঘুম আর রিসোর্ট মিলিয়ে আমরা সকালটা পার করে দিলাম। এখনও ইলেক্ট্রিসিটি আসেনি। জেনারেটর চালু হয়েছে, কিন্তু গিজার কাজ করছে কম, এবং সুখবর কিছু সময়ের জন্য আমরা ওয়াইফাই পেলাম।

কাশ্মীরের পুরো পর্যটন কেন্দ্রের মধ্যমণি এই পেহেলগাম। এখানে দেখার এত এত জায়গা যে বলে শেষ করা যাবে না। তবু আমাদের অনেক বেশি খিদা পেটে গিয়ে ঢুকলাম আমির- জিনাতের কাছে। কাশ্মীরী ভেড়ার সাথে সুগন্ধি চালের বিরিয়ানি এখনও আমার জিভে লেগে আছে। খাওয়া শেষ হতেই আমাদের চালক এসে হাজির। আজ আমাদের সাথে জাবেদ। শখ এবং আবদার করে বসে গেলাম সামনের সিটে।

বাইশ তেইশ বছরের জাবেদ কথা খুব কম বলে। প্রথমেই সরি হলো, ওকে দশ মিনিট সময় দিতে হবে, ওর বাড়িতে একটা ব্যাগ রেখে আসতে হবে।আমরা রাজি, এবং এই সুযোগে আমরা লোকালয়ে গেলাম, পর্যটন কেন্দ্র ছেড়ে। স্হানীয় বাড়িঘর খুব একটা অভিজাত নয়, যদিও গতরাতে খাওয়ার সময় একটি পরিবার আমাদের পাশে ডিনার করছিল, এবং তাদের গাড়ি দেখে মিতু অবাক, এমন গাড়ি বাংলাদেশে নেই। যাই হোক, জাবেদ গাড়ি রেখে নামতেই এতগুলো শিশু, একদম ফুল আর ফুলের মতো এসে আমাদের গাড়ি ঘিরে ফেললো,,আমার ব্যাগ ভর্তি ছিল চকলেট, দিতেই সব সেই আনন্দ। জাবেদও এসে খুশি। এবার জাবেদের সাথে আমাদের জমলো।

প্রথম গন্তব্য চন্দেরয়ারী, এটি অত্যন্ত পুণ্যময় একটি স্হান।অমরনাথ যাত্রার জন্য এ পথেই অসংখ্য যাত্রী আসেন।আমরা তীর্থযাত্রী নই,তবুও দেখছিলাম তীর্থময় ব্যবস্হাপনা। জাবেদ বলছিল কোন কোন জায়গাগুলিতে এসে যাত্রীরা থামেন, কোথাও ঘোড়ায় কোথাও হেঁটে চলেন তারা। আমি তাকিয়ে আছি সীমার বাইরে। পাইনগুলো যেন কাঠির শলাকা, পুতে আছে জীবন্ত বীজ। লাল হলদে সেঞ্চুরি পাতায় বিছানো পথগুলো এ কোন জগতে নিয়ে যাচ্ছে আমায়। পাহাড়ের পর পাহাড়ের যেন এক অসম্ভব হাতছানি। বাঁকগুলো ঘুরতেই এক একটা আসমান সামনে নেমে আসে। সপ্তর্ষিমণ্ডল যেন এখানেই ভূপাতিত। আরও আছে প্রেম, ওখানে যেখানে কেবল দূরই আমায় ডাকছিল।

s5ঠিক প্রথম আমরা গাড়ি থেকে নামি চন্দরয়ারী। উফফ…জানতে চাইবেন না ওখানে কী দেখলাম! অথচ আমি ভাবছিলাম ওখানে কী না দেখলাম! বলে রাখছি, এখানে এসে অমরনাথ যাবার জন্য সমস্ত যানবাহনকে থামতে হবে। এরপর যাই হোক, পা একমাত্র ভরসা। আমি গাড়ি থেকে নেমেই একটা দৌড় দিলাম। বিশ্বাস করেন দৌড়। এবং আমি জানছিলাম না আমি কোনদিকে আর কেন যাবো! থেমে গেলাম বড় পাথরটার পাশে, পা ডুবাতেই কনকনে জল আমায় ছুঁয়ে গেলো। ততক্ষণে সবাই আমরা বিচ্ছিন্ন।ওরা আরও সামনে এগিয়ে গেলো। আমি বসে গেলাম পাহাড়টার পায়ের কাছে, জানতে চাইলাম কোথায় তার শিয়র!! সে হাসলো, অবাক হয়ে আমি শুনলাম শুধু,কল কল কল কল,,,,এত অহংকার পাহাড়েরই সাজে,,কী দরকার আমার ওর শিয়রে গিয়ে, নত হলাম পায়রের কাছে,,স্বীকার করলাম আমিই ক্ষুদ্র,,,

এতক্ষণে দেখলাম একটা চাঙারি দিয়ে পাঁচজন নামিয়ে আনছে একটি সাত আট বছরের বাচ্চাকে, অক্ষম শিশুটি, বাবা মা শেষ ভরসায় মানত নিয়ে গেলেন অমরনাথে। ত্রিশ মিনিট পর আমরা আবার গাড়িতে উঠবো, কিন্তু বিড়ম্বনা যেতে মন চাইছেনা,। হিমালয় এখানে এক খেলা খেলছিল, ওখানে কেবল যেন স্বর্গ দ্বার, এবং আমি একে পৃথিবী বলে ভাবছিলামও না,,আর স্বর্গ থেকে তিরিশ মিনিটে কীভাবে আসা যায়!!!
জাবেদ ডাকছে,,আভি অর বাকী হে!!

এবার ফিরতি পথে প্রথমেই বেতাব ভ্যালি। বেতাব ভ্যালি মূলত কৃত্রিম পার্ক।উপর থেকে তা দেখেই আমরা ছুটলাম অরু ভ্যালি দেখতে। এ পথটাই যেন সোজা নিয়ে যাবে আপনাকে কোন স্বপ্নজগতে। এবং এ পথে আপনি কেন থামবেন তার যথেষ্ট কোন কারণ নেই। টারশিয়ারির ভাঁজ নারীর ভাঁজের চেয়েই জটিল এখানে। এখানে কেবলি ধূপছায়াগুলো খেলা করে।
অরু ভ্যালি এখন বিখ্যাত বাজরেঙ্গি ভাইজান সিনেমার জন্য। এছাড় সব সিনেমার শুটিং এখানে হয়েছে। এটি সিনেমা শুটিং এর জন্যও খ্যাত। পুরো ভ্যালিটি দেখতে আপনাকে ঘোড়া নিতেই হবে, তবে সাবধান, কেডস জাতীয় জুতা ছাড়া যাবেন না।অরু ভ্যালিতে পুরো সন্ধ্যাটা আমরা কাটিয়ে দিলাম।চা আর গোবি কা পাকোড়া আর কাশ্মীরী কাহোয়া খেয়ে আমরা ফিরতি পথে। আটটা নাগাদ এবার শহরে। জাবেদ নিয়ে গেলো শাল কেনার দোকানে। এখানে প্রচুর এনটিক ও লোকাল জিনিসপত্র পাবেন, দামও ঠিকঠাক। বাংলাদেশীদের খুব কদর করা হয়। সুযোগটা নিতেই পারেন।
রাতে ফিরে আজ বেড হিটার পেলাম।ক্লান্তি আর শ্রান্তিতে সব আর্লি ঘুম।

s1পেহেলগামে দ্বিতীয়দিন
ঘুম থেকে জেগেই টের পেলাম আমার জ্বর। সবাই রেডি বাইসরন যাবে। বাইসরনকে বলা হয় মিনি সুইজারল্যাণ্ড। আমি বাদ গেলাম, আজ বেশি হলে হাতে আরও দুদিন। ওরা বেরিয়ে পরলে আমি স্নান সেরে রিসোর্ট ঘুরে দেখছিলাম। অনেকগুলো কটেজ। একদিকে খেলা করছিল একটি ন দশ ভছরের মেয়ে। ডাকতেই কাছে এলো। আকসা ওর নাম।পাশেই ওদের বাড়ি। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম আকসাদের ওখানে। ওর মা ফুপি আর বাবার সাথেও গল্প হলো। আকসা ওদের গাছের আখরোট আনলো। জানলাম ওর স্কুলে যেতে খুব কষ্ট হয়। তবুও ও ডাক্তার হতে চায়।

বাকিরা ফিরলে আমিও ফিরে আসি। বাইসরেনের বর্ণনা শুনে মনখারাপ হলো। যাই হোক আকসাও সেরা পাওনা। আমি ওকে আমার লাল টুপিটা গিফট করলাম, আকসা আমায় মেহেদী পরিয়ে দিল। এ এক অন্য অনুভূতি। মানুষের সৌন্দর্য বোধ করি প্রকৃতির সব সুন্দরের উর্ধ্বে।

রশিদ ভাই এসে হাজির। দুটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম শ্রীনগরের পথে। পেহেলগাম ক্লাব আর গার্ডেন পেরিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে থেমে গেলাম দুপুরের খাবারের জন্য। তন্দুরি চিকেন আমরা, আর রশিদ ভাই খেলেন ভাত আর মরিচ। এখানে পরিচয় একদল তরুণ শিক্ষকদের সাথে। আলাপ জমানোর আগেই আমদের বের হতে হলো।

শ্রীনগরের পথে ছুটছি, তবে রশিদ ভাই কথা দিলেন আপেল বাগানে থামবেন ই…।

লেখক: কবি ও শিক্ষক
কাশ্মির কাহিনী-৩ আসছে…