নয়াবাজার নওয়াব ইউসুফ মার্কেট বণিক সমিতি’র অত্যাচারে অতিষ্ঠ সাধারণ ব্যবসায়ীরা

পুরান ঢাকার নয়াবাজার নওয়াব ইউসুফ মার্কেটে বনিক সমিতি গঠন করা হয় সাধারণ ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখভালো করার জন্য। কিন্তু রক্ষকই এখন ভক্ষকের ভুমিকা অবতীর্ন হয়েছে। ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখার বদলে মার্কেট বণিক সমিতি সাধারণ ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন অত্যাচারের মাধ্যমে অতিষ্ঠ করে

794

ঢাকা: পুরান ঢাকার নয়াবাজার নওয়াব ইউসুফ মার্কেটে বনিক সমিতি গঠন করা হয় সাধারণ ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখভালো করার জন্য। কিন্তু রক্ষকই এখন ভক্ষকের ভুমিকা অবতীর্ন হয়েছে। ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখার বদলে মার্কেট বণিক সমিতি সাধারণ ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন অত্যাচারের মাধ্যমে অতিষ্ঠ করে তুলছে, এমন অভিযোগ করেছেন মার্কেটের ব্যবসায়ীরা। তারা বলেন, অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিল আদায় থেকে শুরু করে নাইট গার্ডের টাকা আত্মসাৎ পর্যন্ত সবই করছে বর্তমান কমিটি। এতে মার্কেটে ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়েছে বলেও তারা অভিযোগ করেন।

জানা গেছে, এসব কর্মকাণ্ড সমিতির সভাপতি মো. আজাদ হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক মো. আলী মোল্লার নেতৃত্বে হচ্ছে বলে তারা অভিযোগ করেন। ব্যবসায়ীরা বলেন, আজাদ হোসেনের পিতা হাজী মু. লালু মিয়া নয়াবাজার বিএনপি অফিসের প্রতিষ্ঠাতা। মো. আজাদ হোসেন বিএনপি নেতা হলেও এসব কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য নব্য আওয়ামী লীগার হয়েছেন বলে ব্যবসায়ীরা জানান।

জানা গেছে, তিনি আহমদ পাগল মার্ডারের এজাহারভুক্ত আসামি ছিলেন। এ মামলায় তিনি ২০১৩ সালে জেলেও ছিলেন। পরবর্তীতে বাদির সাথে টাকায় দফারফা করে এজাহার থেকে নাম কাটান। আজাদের দুর্নীতির কাজে সহযোগিতা করেন শরীফ হোসেন, সাবেক কমিশনার মোহনের ক্যাশিয়ার শহিদ হোসেন, রাজ্জাক ও ময়না। এরা সবাই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলেও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।

ব্যবসায়ীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, গত সাত বছর যাবত তারা বিভিন্ন কায়দায় শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে কমিটির অনুমোদন নিয়ে ব্যবসায়ীদের ওপর অত্যাচার করছেন। জানা গেছে, শ্রম অধিদপ্তরের অফিসারদের যোগসাজশে ২০১৩ সালে একটি কমিটি পাস করিয়ে এনে সেই সমিতির নামে সিটি কর্পোরেশন থেকে বিদ্যুৎ ব্যবহারের অনুমোদন নেয়। সাথে টয়লেটের ইজরাও নেয়।

এর পর থেকেই সাধারণ ব্যবসায়ীদের ওপর অবিচার শুরু করে। পরবর্তীতে ২০১৭ সালের ২৫ মে একটি ভোটারবিহীন নির্বাচন দেয়। সাধারণ ব্যবসায়ীরা এ নির্বাচনের প্রতিবাদ করলে শ্রম অধিদপ্তর এ নির্বাচন স্থগিত করে। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ১২ ডিসেম্বর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে। তখন আবারো সাধারণ ব্যবসায়ীরা এর প্রতিবাদ করলে শ্রম অধিদপ্তর সিটি কর্পোরেশন থেকে প্রকৃত দোকানদারদের একটি তালিকা সংগ্রহ করে। সিটি কর্পোরেশন ৪৬৯ জনের একটি তালিকা শ্রম ভবনকে প্রদান করে। এ তালিকা পাওয়ার পরও শ্রম ভবনের কয়েকজন অফিসারের যোগসাজশেই ৪৬৯ জন থেকে ২৫৩ জনের একটি ভোটার তালিকা প্রস্তুত করা হয়।

পরবর্তীতে ২ মে নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করে। সে অনুযায়ী ৯ মে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার তারিখ নির্ধারিত থাকে। সেদিন নয়টি পদে নয়টি মনোনয়ন জমা পড়ে। নির্বাচনে সাধারণ ব্যবসায়ীরা কেউ অংশ না নেয়ায় এবং কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় ১৯ মে আবারো মো. আজাদ হোসেন সভাপতি এবং আলি মোল্লা সাধারণ সম্পাদক হয়। নির্বাচনের পর থেকে সভাপতির নেতৃত্বে একটি দল বেপেরোয়া আচরণ করছে বলে তারা অভিযোগ করেন ব্যবসায়ীরা।

বিদ্যুৎ বিল নিয়ে অভিযোগ তুলে তারা বলেন, বিদ্যুৎ আনার পর থেকেই ট্রান্সফরমার লস এবং বিভিন্ন ব্যয় দেখিয়ে প্রতি দোকান থেকে ৯০০-৯৫০ টাকা করে বাড়তি বিল আদায় করে। এটা নির্ভর করে বিলের ওপর। মার্কেটে ৪৬৯টি দোকান রয়েছে সে হিসেবে প্রতি মাসে এ বাবদ টাকা আদায় হয় প্রায় চার লাখ ২২ হাজার ১০০ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। এছাড়াও সার্ভিস ও পরিচালন চার্জ প্রতি ইউনিট বাবদ ২০ পয়সা করে নিয়ে থাকে। যা প্রতি দোকান থেকে ৫০-১০০ টাকা করে আদায় হয়। এখাত থেকেও প্রতি মাসে প্রায় ৫০ হাজার টাকা আদায় করা হয়। এছাড়াও প্রতি ইউনিট বাবদ বিল আদায় করা হয় ১৫ টাকা ৩৬ পয়সা করে। যা মূল দামের চেয়ে এখানেও অতিরিক্ত টাকা আদায় করে বলে তারা অভিযোগ করেন। তারা বলেন, অন্যান্য মার্কেটে আমাদের দোকান আছে সেখানে ৯-১১ টাকা ইউনিট নিয়ে থাকে কিন্তু এখানে ১৫ টাকার উপর নেয়।

এ বিষয়ে শ্রম অধিদপ্তরের পরিচালক ও রেজিস্ট্রার অব ট্রেড ইউনিয়ন্স মো. বেল্লাল হোসেন শেখ বলেন, সাধারণ দোকানদাররা এ বিষয়ে লেবার কোর্টে মামলা করেছেন। এটার রায় হয়েছে। পরবর্তীতে রায়ে সন্তুষ্ট না হয়ে আবার আপিল করেছে সেটাও খারিজ হয়েছে। যেখানে কোর্ট রায় দিয়েছে সেখানে আমাদের আর কোনো কথা নেই।

এছাড়াও সিটি কর্পোরেশনের অনুমোদন না নিয়েই নয়াব ইউসুফ মার্কেটের বারান্দা ভেঙ্গে রেলিং করছে বলে অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। এর খরচ বাবদ ৫ হাজার টাকা করে প্রতি দোকান থেকে নিয়েছে বণিক সমিতি। যেখানে একটি দোকানের সামনে রেলিং করতে মাত্র ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা খরচ হয়। দোতলায় রেলিং লাগালেও নিচ তলার দোকান থেকেও টাকা নিয়েছেন।

এছাড়াও ২নং বিল্ডিংয়ের বাথরুম বন্ধ করে গোডাউন করে ভাড়া দিয়েছে। ৩ নং বিল্ডিংয়ের বাথরুম চালু থাকলেও অর্ধেকটা গোডাউন হিসেবে ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। বাথরুমের সুবিধা কম থাকার কারণে ২ নং এবং ৩ নং বিল্ডিংয়ের দোকানদারদের খুব কষ্ট হয় বলে জানিয়েছেন। মার্কেটের নিচ তলায় ডাস্টবিনের নির্ধারিত জায়গায় দোকান বসিয়েছে। প্রতি দোকান থেকে দৈনিক ২০০ টাকা করে মাসে ছয় হাজার টাকা নিয়ে থাকে। ২ নং বিল্ডিংয়ের নিচ তলার ৫৬ নং দোকানের মালিক সেন্টু মিয়া বলেন, রেলিং লাগানোর কথা বলে ৫ হাজার টাকা করে নিয়েছে। এছাড়াও মুক্ত টেইলার্স, আহমদ পাইপের মালিক হাজী শহিদ মিয়া, জাহিদ হোসেন খোকনসহ ৫ হাজার টাকা করে নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এ বিষয়ে বণিক সমিতির সভাপতি মো. আজাদ হোসেন বলেন, যে সমস্ত অভিযোগ করা হয়েছে তার সবই ভুয়া। এসবের কোনো ভিত্তি নেই। মার্কেট আমরা ভাঙ্গছি না বরং দোকানদাররাই ভেঙ্গে রেলিং করছে। এখানে আমাদের কোনো অংশগ্রহণ নেই। ট্রান্সফরমার লস বাবদ যে টাকাটা নেয়া হয়। এটা ট্রান্সফরমার লাগানোর কাজেই ব্যয় হয়। প্রায় সময় ট্রান্সফরমার নষ্ট হয়ে যায় তখন এই টাকা দিয়ে ঠিক করা হয়। আমরা বাড়তি কোনো টাকা কারো কাছ থেকে নেই না। এটা যারা বলেছে মিথ্যা বলেছে।

অন্যদিকে টাকা আদায় ও হুমকি প্রদান করার বিষয়ে তার বিরুদ্ধে দুটি জিডিও হয়েছে গত মাসে বংশাল থানায়। গত মাসের ৭ তারিখ ভয়ভীতি প্রদর্শন করায় গিয়াস উদ্দিন নামে এক নাইটগার্ড জিডি করেছেন। এতে দেখা যায়, মো. শহিদুল ইসলাম হানিফ (৪৫), মো. কোয়েল (৪২), আজাদ হোসেন (৩৫) ও মো. ময়না তাকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করায় তিনি নিরাপত্তা চেয়ে জিডি করেছেন। বংশাল থানার জিডি নং ৩৫৯। অন্যদিকে গত মাসের ১৫ তারিখ হাজী আরমান উদ্দিন বংশাল থানায় একটি জিডি করেন।

এতে তিনি উল্লেখ করেন, গত ১১ অক্টোবর মু. মস্তোফা, ধলা মিয়া, ময়না মিয়া তার কর্মচারী গিয়াস উদ্দিনের বেতনের টাকা জোরপূর্বক নিয়ে যায়। গিয়াস উদ্দিন প্রতি মাসে ৩০টি দোকান থেকে ৩০০ টাকা করে রাতে গার্ড দেয়ার জন্যে বেতন পেয়ে থাকে। সে টাকার পুরোটাই তারা নিয়ে যায় বলে অভিযোগ করা হয়। বংশাল থানার জিডি নং ৭৬২।

গিয়াস উদ্দিনের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, গত ১৩ বছর যাবত নয়াবাজার বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের নিরাপত্তা ইনচার্জ হিসেবে কর্মরত আছি। আমার গত মাসের বেতনের টাকাটা জোরপূর্বক নিয়ে যায় এবং হুমকি দেয়। এ বিষয়ে আমি থানায় জিডি করেছি। তিনি সরকারের কাছে নিরাপত্তা চান। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ইউসুফ আলী সরদারের সঙ্গে কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।