ত্রিশ বছর পর সগিরা হত্যার রহস্য উন্মোচন

667

ডেস্ক রিপোর্টঃ
ত্রিশ বছর আগে খুন হোন গৃহবধু সগিরা মোর্শেদ। ওই খুনের ঘটনায় দায়ের করা মামলা একে একে ২০ জন কর্মকর্তার তদন্ত শেষে সর্বশেষ পিবিআইয়ের হাতে ঘটনার মূলরহস্য বেরিয়ে আসে। পারিবারিক কোন্দল ও ইজমের জেরে ভাই ও ভাইয়ের স্ত্রীর পরিকল্পনায় ছোট ভাইয়ের স্ত্রী সগিরা মোর্শেদ খুন হোন। তবে ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পরিকল্পনাকারী হিসেবে ভাই-ভাবীসহ চারজনকে গ্রেফতার করে পিবিআই।

পিবিআই বলছে, সগিরা মোর্শেদ হত্যায় নিজেদের সম্পৃক্ততা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন মূল পরিকল্পনাকারী আসামি ডা. হাসান আলী চৌধুরী (৭০) ও তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহিন (৬৪)। মূলত তাদের পরিকল্পনাতেই এ হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন আনাস মাহমুদ ওরফে রেজওয়ান (৫৯) এবং মারুফ রেজা।

বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) সন্ধ্যায় ধানমন্ডির পিবিআই সদর দফতরে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনোজ কুমার মজুমদার।

বনোজ কুমার বলেন, ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই। বিকেল ৫টায় মোসাম্মৎ সগিরা মোর্শেদ সালাম (৩৪) বাসা থেকে ভিকারুনানিসা স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী মেয়ে সারাহাত সালমাকে (৮) আনতে যান। স্কুলের সামনে পৌঁছামাত্রই অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতিকারীরা তাকে গুলি করে। গুরুতর অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে মারা যান তিনি। ওই ঘটনার রাতেই স্বামী আব্দুস ছালাম চৌধুরী রমনা থানায় একটি মামলা (মামলা নম্বর ৪৫) দায়ের করেন।

তিনি বলেন, প্রথমে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করে। ১৯৯০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তদন্ত শেষে ছিনতাইকারী মিন্টু ওরফে মন্টুকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। আদালত অভিযুক্তের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচারকার্য শুরু করেন। বিচারকার্য চলাকালে ছয়জন সাক্ষীর জবানবন্দিও গ্রহণ করা হয়।

সাক্ষীদের জবানবন্দিতে সন্দেহভাজন আসামি মারুফ রেজার নাম উঠে আসে। আদালত অধিকতর তদন্তের নির্দেশনা দেন। আদালতের ওই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে সন্দেহভাজন আসামি মারুফ রেজা হাইকোর্ট বিভাগে ১৯৯১ সালের ২৯ মে ক্রিমিনাল রিভিশন মামলা (নম্বর- ১০৪২/৯১) দায়ের করেন। এরপর ১৯৯০ সাল থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ২৬ জন তদন্তকারী কর্মকর্তা মামলাটি তদন্ত করেন।

চলতি বছরের গত ১১ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ক্রিমিনাল মামলাটি খারিজ করে মামলাটি অধিকতর তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেন। এরপর পিবিআইয়ের তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম সাক্ষী শনাক্ত ও হত্যার সংক্রান্তে জবানবন্দি আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় লিপিবদ্ধ করেন।

এরপর রবিবার (১০ নভেম্বর) সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে আনাস মাহমুদ ওরফে রেজওয়ানকে (৫৯) রাজধানীর রামপুরা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) ডা. হাসান আলী চৌধুরী ও তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহিনকে ধানমন্ডি থেকে গ্রেফতার করা হয়। বুধবার (১৩ নভেম্বর) আসামি মারুফ রেজাকে বেইলি রোডে তার বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার চারজনই সগিরা মোর্শেদ হত্যায় আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।

বনোজ কুমার আরও বলেন, মামলার বাদী আব্দুস ছালাম চৌধুরী তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার ছোট। অপর দুই ভাই যথাক্রমে বড় ভাই সামছুল আলম চৌধুরী, মেঝ ভাই ডা. হাসান আলী চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে লেখাপড়ার সূত্র ধরে ১৯৭৯ সালের ২৫ অক্টোবর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ছালাম ও সগিরা মোর্শেদ। দাম্পত্য জীবনে তাদের ছিল তিন কন্যা সন্তান।

অপর দিকে ডা. হাসান আলী চৌধুরী বারডেম হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি ১৯৮০ সালে সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহিনকে বিয়ে করে লিবিয়ায় চলে যান। ১৯৮৫ সালে স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ লিবিয়া থেকে দেশে ফিরে ৯৫৫ আউটার সার্কুলার রোডে রাজারবাগে বাবার বাসায় ওঠেন। সেখানেই বাড়ির দ্বিতীয়তলায় তার ছোট ভাই মামলার বাদী ছালাম চৌধুরীর বাসায় একটি রুমে সপরিবারে থাকতে শুরু করেন। এক বাসায় থাকার কারণে দুই ভাইয়ের স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা ও সগিরা মোর্শেদের মধ্যে নানা বিষয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।

১৯৮৬ সালের এপ্রিলে বাড়ির তৃতীয়তলার কাজ সম্পন্ন হলে ডা. হাসান আলী চৌধুরী স্ত্রী-পুত্রসহ তৃতীয় তলায় ওঠেন। এই সময়ে তৃতীয়তলা থেকে ময়লা ফেলা ও বিভিন্ন কারণে ডা. হাসান আলী চৌধুরীর স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদার সঙ্গে সগিরা মোর্শেদের দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করে। পারিবারিক তুচ্ছ বিষয়গুলো নিয়ে হাসান আলী দম্পতির মধ্যে এক ধরনের ইজমের সৃষ্টি হয়। ১৯৮৯ সালে স্ত্রীর প্ররোচনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সগিরা মোর্শেদকে শায়েস্তা করতে রাজি হোন ডা. হাসান।

আসামি মারুফ রেজা তৎকালীন সিদ্ধেশ্বরী এলাকার নামকরা সন্ত্রাসী এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাগ্নে ছিল অপর আসামি ডা. হাসানের রোগী। সগিরা মোর্শেদকে শায়েস্তার দায়িত্ব দেন। চুক্তি হয় ২৫ হাজার টাকা। ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই ডা. হাসান আলী চৌধুরী তার শ্যালক আনাস মাহমুদকেও ওই হত্যাকাণ্ডের সহযোগিতায় ব্যবহার করেন। আনাসই মৌচাক থেকে সন্ত্রাসী মারুফ রেজাকে নিয়ে সগিরা মোর্শেদকে অনুসরণ করেন। ভিকারুননিসার সামনে সগিরা মোর্শেদের রিকশা ব্যারিকেড দিয়ে গুলি করে মোটরসাইকেলযোগে পালিয়ে যায় তারা।