গাছেরও চাই বেঁচে থাকার অধিকার —সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

1059

সাম্প্রতিক সময়ে যশোরে সড়ক সম্প্রসারণের নামে দুই হাজারেরও বেশি শতবর্ষী গাছ কাটার প্রস্তাবনা নিয়ে গণমাধ্যম সরব। বিভিন্ন গণমাধ্যমে অন্যতম শীর্ষ সংবাদ হিসেবে প্রচারিত হওয়ায় কেবল যশোরেই নয়, দেশব্যাপী বৃক্ষ নিধনের এ পরিকল্পনার বিরোধিতা চলছে। সামাজিক গণমাধ্যমে বেশির ভাগ মতামতই গাছ কেটে ফেলার বিপক্ষে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সড়ক উন্নয়ন, ড্রেনেজ সংস্কার, গ্যাসলাইন স্থাপন ইত্যাদি উন্নয়নের নামে বৃক্ষহত্যা নিত্যদিনের ঘটনা। গত কয়েক মাসে ফুটপাত সম্প্রসারণের অজুহাতে গুলশান, বনানী, উত্তরায় চলছে গণহারে বৃক্ষ নিধন। কোনো রকম নিয়মনীতির প্রচলন ও তোয়াক্কা না করে নির্বিচারে গাছ কাটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে সেসব অভিজাত এলাকার অধিবাসী, যদিও ফলাফল তেমন আশাব্যঞ্জক হয়নি, সরকারের উন্নয়ন সিদ্ধান্তের কাছে নাগরিকদের প্রতিবাদ মূল্যহীন প্রমাণিত হয়েছে। ধূসর এ নগরীর অভিজাত এলাকাগুলোর মুষ্টিমেয় কিছু গাছও তাই রক্ষা করা যায়নি উন্নয়নের দাপটে।

সুখের কথা, যশোর সড়কের শতবর্ষী গাছগুলো অন্তত ছয় মাসের জন্য হলেও রক্ষা করা গেছে মহামান্য হাইকোর্টের এক অন্তর্বর্তীকালীন আদেশে। কিন্তু গাছ কাটার পরিকল্পনা থেকে সরকার সরে এসেছে এমন কোনো ঘোষণা এখন পর্যন্ত আমরা পাইনি। সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এটি স্পষ্ট করেছে যে, রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য পরিবেশগত কোনো ছাড়পত্র দেয়া হয়নি এবং গাছ কাটার বিষয়েও প্রচলিত বন আইনের অধীনে কোনো অনুমোদন নেয়া হয়নি।

যশোর এলাকার গাছ কাটা আপাতত স্থগিত হলেও দেশের অন্যান্য এলাকায় আরো ব্যাপক বৃক্ষ নিধনের বিষয়ে তেমন কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়নি। আমি এখানে এ সংক্রান্ত কয়েকটি উদ্বেগজনক উদ্যোগ উল্লেখ করতে চাই, যা উন্নয়নের নামে বৃক্ষ নিধনকে উৎসাহিত করছে এবং দেশের বিদ্যমান মাত্র ৬-৮ শতাংশ সবুজ আবরণকে আরো কমিয়ে আনছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে মন্ত্রিপরিষদ গাজীপুর বন বিভাগ কর্তৃক রোপিত প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে থাকা ১৪ হাজার গাছ কর্তনের অনুমতি দিয়েছে গ্যাসলাইন সম্প্রসারণের জন্য। মন্ত্রিপরিষদের এ অনুমোদনের প্রয়োজন হলো এজন্য যে, এক প্রশাসনিক আদেশবলে ২০২২ সাল পর্যন্ত সব বনে গাছ কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছিল। অনুমতি প্রদানের সময় মন্ত্রিপরিষদ তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষকে ১৪ হাজার গাছের বিপরীতে ২৬ হাজার চারা রোপণের নির্দেশ দিলেও কোথায়, কখন এ চারা রোপণ হবে এবং তা বৃক্ষে পরিণত হয়ে বনের আবহ সৃষ্টি করবে তা বলা হয়নি। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে জনগণকে কিছু জানানোর প্রয়োজন বোধ করছে না। বন বিভাগও তিতাস কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো পরিকল্পনা চেয়েছে বলে জানা যায়নি। মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে গাজীপুরের গাছ কাটা নিয়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয় কোনো জোরালো বিরোধিতা করেছে বলে কোনো সংবাদ পরিবেশন হয়নি।

উন্নয়ন বনাম বৃক্ষ নিধনের আরো একটি মর্মান্তিক দৃষ্টান্ত হলো, রাজউক কর্তৃক প্রস্তাবিত পূর্বাচল আবাসিক প্রকল্পের দ্বিতীয় সম্প্রসারণ ধাপ, যেখানে গাজীপুরের গড় এলাকার কাউনিয়া ও পারাবার্থা মৌজায় ‘সম্মানিত নাগরিক’দের জন্য প্লট তৈরি করতে ১২ লাখ গাছ কাটার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পূর্বাচলের এ প্রকল্পের বৃক্ষ নিধনের যজ্ঞ এতই ভয়াবহ যে, এখানে অধিগ্রহণকৃত জমির তুলনায় বৃক্ষের বিপরীতে দেয়া ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বেশি। এ গাছগুলো কেটে ফেলার পাশাপাশি ধ্বংস করা হবে একটি সমৃদ্ধ গড় এলাকাকে, যা প্রতিস্থাপনের ক্ষমতা রাজউকের নেই। এমনকি এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আদেশ মানেনি রাজউক, সর্বোচ্চ আদালত রাজউককে তার প্রকল্পের সপক্ষে পরিবেশগত ছাড়পত্র নিতে নির্দেশ দিলেও রাজউক এখনো তা নেয়নি। কিন্তু তাই বলে গাছ কাটা থামায়নি তারা। এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় রহস্যজনকভাবে নীরব। সম্মানিত নাগরিকদের মধ্যে কিছু গণমাধ্যমকর্মী আছেন বলেই কি এ বিষয়ে গণমাধ্যমে তেমন কোনো প্রচার-প্রচারণাও নেই?

অতিসম্প্রতি মহেশখালীতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ১৯১ একর সংরক্ষিত বনভূমি অধিগ্রহণের প্রস্তাবনা দিয়েছে। বন বিভাগ প্রথমে ১৯১ একর বনভূমির বিপরীতে ২৭৭ কোটি টাকা দাবি করলেও পরবর্তীতে সে দাবি নেমে এসেছে ৪৭ কোটি টাকায়। দরকষাকষিতে বিপিসি প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা দিতে রাজি হয়েছে। কেননা এ ১৯১ একর বনভূমিতে তারা ‘বৃহত্তর জনস্বার্থে’ একটি তেলের টার্মিনাল নির্মাণ করবে!

আমরা যখন যশোরে বৃক্ষ নিধন রোধে সোচ্চার, সরকারের সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ঠিকাদার তখন ঠাকুরগাঁও শহর থেকে রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত ৪ দশমিক ৩৪ কিলোমিটার এলাকার দুই হাজারের বেশি প্রাচীন গাছ নিধনে ব্যস্ত। অজুহাত হাইওয়ে সম্প্রসারণ।

এই হচ্ছে বন, গাছ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থার বিষয়ে সরকারের প্রকাশ্য অবস্থান। এ অবস্থান অগ্রহণযোগ্য। কেননা তা টেকসই উন্নয়নের বিরোধী। এখানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেয়া হচ্ছে টাকার বিপরীতে, এসব উন্নয়নে জনগণের কোনো অংশগ্রহণ নেই, তাদের মতামত কখনো যাচাইও করা হয় না। অংশীদারিত্ববিহীন উন্নয়ন যে কখনো টেকসই হয় না, তার বড় উদাহরণ হচ্ছে চকরিয়া-সুন্দরবন। যেখানে রফতানিমুখী চিংড়ি চাষ হত্যা করেছে ২১ হাজার একর উপকূলীয় বনের সব বৃক্ষকে। এখানে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের দ্বারা সুন্দরবনের ক্ষতির আশঙ্কার কথা নতুন করে আর নাই-বা বললাম।

রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পই যদি সরকারের উন্নয়ন মডেল হয়, তবে গাজীপুরের বন, ঠাকুরগাঁওয়ের গাছ, যশোরের শতবর্ষী গাছগুলো আর গড় এলাকার ১২ লাখ গাছের কান্না প্রশাসনে, রাজনীতিতে সত্যিই কি কেউ শুনবে?

একজন পরিবেশকর্মী হিসেবে আমার দাবি হচ্ছে, বৃক্ষ ও বনের প্রাণ ব্যবস্থাকে তথাকথিত উন্নয়নের ওপর অবস্থান দেয়ার। একটি সড়ক, একটি আবাসন প্রকল্প কিংবা একটি তেলের টার্মিনাল হয়তো জরুরি এবং সরকার তা তৈরি করতে পারবে কিন্তু কোনো প্রতিবেশ ব্যবস্থা, যা প্রাণের আধার এবং সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক, তা তৈরি করা কোনো মানুষের পক্ষে অসম্ভব। আমি তাই বৃক্ষ রক্ষা বিষয়ে সুস্পষ্ট আইনি নির্দেশনা চাই। আমি চাই সুস্থ পরিবেশের অধিকার, যা ছাড়া উন্নয়ন অর্থহীন। আমি চাই সব উন্নয়নের সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য সব প্রয়োজনীয় আইনি ও প্রশাসনিক আয়োজন। আমি অংশগ্রহণমূলক ও জবাবদিহিমূলক উন্নয়ন চাই, যাতে উন্নয়নের নামে প্রাণ-প্রকৃতি আর ধ্বংস না হয়। আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান অধ্যাপক ক্রিস্টোফার ডি স্টোনের সঙ্গে একমত হয়ে আমিও গাছ-গাছালির আইনি সত্তার স্বীকৃতি চাই।

বলাই বাহুল্য, এসব দাবি সরকারের বর্তমান উন্নয়ন মডেলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তবে তা জনসমর্থনহীন নয়।

সবার উদ্যোগে শুধু যশোরে নয়, পূর্বাচল, গাজীপুর, ঠাকুরগাঁও, মহেশখালী, উত্তরা, বারিধারা, গুলশান, বনানীর সব বৃক্ষ বেঁচে থাকুক শতাব্দী শতাব্দী ধরে।

লেখক: পরিবেশবিদ; প্রধান নির্বাহী, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা)